স্বাস্থ্য

মহামারীর দিনগুলোতে শিশুদের সান্নিধ্যে 

-রবীন গুহ

সরকার করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় আবার লকডাউন ঘোষণা করেছে। অনেকের মতই মহামারীর কারণে গত প্রায় দেড় বছরে সবার মত আমার যাপিত জীবনেও একটা পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে।প্রত্যেক কিছুরই একটা খারাপ দিক যেমন থাকে,তেমন ভাল দিকও থাকতে পারে। যেমন, একটা পরিবারে যদি তাদের সন্তান অসুস্হ হয়,তবে সেই পরিবারে দু:খের সীমা থাকেনা।তখন সেখানে বাবা-মায়েরা সাধারনত: তাদের মধ্য যদি বড় ধরণের কোন ঝগড়া বা বোঝাপড়ার সমস্যা থাকে,তা নিজেদের মধ্য মিটিয়ে ফেলে তাদের সন্তানকে সুস্হ করে তোলার জন্য সমন্বিত উদ্যোগ নিতে দেখা যায়।এতে সংকটের সময়টাতে পরিবারে নিজেদের বন্ধনটা আরেকটু শক্ত হয়। তবে, কারো সন্তান অসুস্হ হোক সেটা নিশ্চয়ই কারো কাম্য নয়। সবার সন্তান সুস্হ থাকুক,ভাল থাকুক। পরিবারের মধ্যকার বন্ধনও অসম্ভব শক্ত থাকুক-এ কামনা করি।

গোটা বিশ্বের মানবজাতির জন্য করোনার মহামারী যে একটা কতবড় অভিশাপ তা বর্ণনা করে বোঝানোর কিছুই নেই।তবুও কঠিন সময়েও জীবন কিন্তু থেমে থাকেনা। জীবন চলে যায় জীবনের নিয়মে। আর সেই জীবন  যেমনই হোক,জীবনের চাইতে সুন্দর আর কিছুই নেই। করোনার মহামারীতে পৃথিবী থেকে কত মানুষ মারা গেলো। আমরা তো বেঁচেই আছি। এটাও তো অনেক।

অনেক খারাপ কিছুর পরও মহামারীর একটা ভাল রকমের আছর আমার উপর পড়েছে! মানে টানা দেড়টা বছর পরিবারের সাথে দিনের বেশির ভাগ সময় কাটানোর বিরল সুযোগ তৈরী হয়েছে।অবসরপ্রাপ্ত মা-কে নিয়ে আমাদের দু’ভায়ের পরিবার। দু’ভায়ের দুটো বাচ্চা আর বাকী সবাইকে নিয়ে এমন অখন্ড অবসর কাটানোর সুযোগ আগে কখনো আসেনি! কারো নিয়মিত অফিসে যাবার তাড়া নেই, নিয়ম-মাফিক স্কুলে হাজিরা দেবার দায় নেই। সামাজিকতা রক্ষা করার তাগিদ নেই! পারিবারিক বা পেশাগত অল্প কিছু কাজ বাদ দিলে বাকী সময়টা শুধু নিজেদের নিয়েই পুরোটা সময় কাটিয়ে দেয়া যায়।

সকালে স্কুলে যাবার তাড়া না থাকাতে বাচ্চাদের ভোরে উঠার জন্য পীড়াপীড়ি করিনা। তবে একটা রুটিন তো মেনে চলতেই হবে। যখন খুশী তখন ঘুম বা খেয়াল খুশীমত খাওয়া দাওয়া করা কেন কাজের কথা নয়।মোটামুটি সকাল আটটা থেকে সাড়ে আটটায় ঘুম থেকে উঠে। সকালের প্রাতকার্য্য সেরে সকাল নয়টার দিকে সবাই মিলে নাশতা সারি।এরপর প্রতিদিনকার অনলাইন ক্লাসের পড়া তৈরী করতে বসা। সেদিন যদি নতুন অনলাইন ক্লাস থাকে তবে তা শেষ করতে প্রায় বারোটা বেজে যায়। আর ক্লাস না থাকলে এগারোটার দিকেই পড়া শেষ হয়ে যায়। তবে অনলাইন ক্লাসের ব্যাপারে জোর-জবরদস্তি করিনা। আমার ছেলে রোহিন ক্লাস ফোরে আর ভাতিজা রূপো ওর দুক্লাস নিচে পড়ে।মানে ক্লাস টু’তে। অনেক সময়েই বাচ্চাদের অনলাইন ক্লাসের জন্য এতক্ষন টানা লেপটপের সামনে বসে থাকার জন্য ধৈর্য্য থাকেনা, বিরক্ত হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে অনলাইন ক্লাসের পড়াটুকু আমরা বড়রা টুকে রাখি। পরে ওদের বুঝিয়ে দেয়া হয়। এমনিতে দীর্ঘদিন ধরে ঘরবন্দি থাকার কারণে বাচ্চাদের মানসিক চাপ থাকতে পারে, তাই নিজেরা  বুঝিয়ে-শুনিয়ে যতটুকু করানো যায়। নতুন করে কোনরকমের চাপ সৃস্টি করতে চাইনা।

বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবি অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান তাঁর এক বক্তব্যে বলছেন, শিক্ষা হলো ‘তোমাকে উচিৎ শিক্ষা দেবো’ টাইপের, মানে শাস্তি দেবার মত একটা বিষয়। তবে এর ফল সাধারনত: ভাল হয়। যাক সকাল এগারোটা থেকে বারোটার ভিতর ওরা পড়াশুনার যন্ত্রনা থেকে মুক্ত হয়ে যায়। এরপরের সময়টুকু এরা সুযোগ পেলেই মোবাইলে গেম খেলাতে লেগে যায়। কখনো টিভিতে কার্টুন দেখা। মোবাইল আর টিভি থেকে দূরে রাখার জন্য কিছু বিকল্প প্রস্তাব দিই। একেক সময় একেক রকম।যেমন, আমাদের চার ফ্ল্যাটের মাজখানটার ছোট্ট করিডোরে একটা বাস্কেটবলের বাস্কেট ঝুলিয়ে দিই। ওরা কখনো কখনো সেখানে বাস্কেটবল খেলে। অনেক সময় আমিও যোগ দেই ওদের সাথে। কখনো ঠাম্মার সাথে কেরাম বা দাবা খেলেও সময় কাটায়।

আরেকটা খেলা ওদের খুব পছন্দ। মাঝে মাঝে খেলি বাচ্চাদের নিয়ে। সেটা হলো বড় একটা ম্যাপ মেঝেতে বিছিয়ে নতুন নতুন দেশ খুঁজে বের করা। খেলতে খেলতে কিছু জিনিস শিখিয়ে দিয়েছি। যেমন,ম্যাপের উপরের দিকটা উত্তর দিক আর নিচের দিকটা দক্ষিন দিক।দক্ষিন হস্ত মানে হলো ডান হাত,দক্ষিন যদি ডান হাত  হয় তবে উত্তর হলো বাম হাত। দক্ষিন দিকে ডান হাত আর উত্তর দিকে বাম হাত রেখে সামনে দিকে তাকালে সামনে হবে পূর্বদিক আর পিছনে হবে পশ্চিম দিক। পূর্বদিকে প্রথম সূর্য্য ওঠে, মানে জাপানে সবার আগে সূয্যিমামা উকি দেয়। পশ্চিমে মানে আমেরিকার দিকে সবার শেষে দিন হয়।ততক্ষনে জাপানসহ আমাদের দেশে রাত হয়ে যায়। ম্যাপে দুই রকমের রেখা থাকে। শোয়ানো আর দন্ডায়মান। শোয়ানো রেখা হচ্ছে অক্ষরেখা। পৃথিবীর কেন্দ্র দিয়ে উত্তর-দক্ষিণে কল্পিত রেখাকে অক্ষরেখা বলে। এ অক্ষরেখার উত্তর-প্রান্ত বিন্দুকে উত্তর মেরু বা সুমেরু এবং দক্ষিণ-প্রান্ত বিন্দুকে দক্ষিণ মেরু বা কুমেরু বলে। এরেখার উপরে মানে উত্তরে যেতে থাকলে ঠান্ডা বাড়তে থাকে। আর নিচে মানে দক্ষিনে একটা নির্দিস্ট এলাকা অব্দি তাপমাত্রা বেশি বা গরম থাকে। দন্ডায়মান রেখা হচ্ছে দ্রাঘিমা রেখা। এদের বিস্তার উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত অর্থাৎ এরা উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত। একটি দ্রাঘিমার উপরিস্থিত সমস্ত বিন্দুর দ্রাঘিমাংশ সমান হয়। প্রতিটি দ্রাঘিমারেখা সমস্ত সমাক্ষরেখার সাথে লম্বভাবে অবস্থান করে। কোন দেশ খুঁজে পেতে দেরি হলে টিপস হিসেবে বলে দিই কোন মহাদেশে হবে বা পূর্বপশ্চিম বা উত্তরদক্ষিন দিকে।

মহামারী শুরু হওয়ার প্রথম দিকে প্রায় ছয়-সাত মাস বাচ্চাদের ছাদে যাওয়া বন্ধ ছিল। একসময় আর পারা গেলনা! আজকাল দুপুরের খাবার পর্ব সেরে একটু বিশ্রাম নেবার পর বিকেলে সবার মুখে মাস্ক লাগিয়ে ছাদে যাই বাচ্চাদের। অন্য বাসায় দু-তিন জন বাচ্চাও যায়। সবাই নির্দিস্ট দূরত্ব ও স্বাস্হ্যবিধি মেনে ছাদে সাইকেল চালায়। তবে খেয়াল রাখতে হয় ওরা যাতে নিজেদের মধ্য দূরত্ব বজায় রাখে। যদিও জানি কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ, তারপরও অনেকটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাচ্চাদের পীড়াপীড়িতে ছাদে নিয়ে যেতেই হয়।

করোনাকালীন সময়ে বিশেষ দিনগুলো একটু ঘটা করেই পালন করি। যেমন কারো জন্মদিন বা নিউ ইয়ার, কিংবা পহেলা বৈশাখ। সবাই মিলে ঘরে তৈরী হয় কেক, পুডিং কিংবা রাশান সালাদের মত বিশেষ কোন খাবার। আবার রঙীন কাগজ কেটে আর বেলুন দিয়ে ঘর সাজানোর মত কাজ। এসব কিছুই বাচ্চারা বেশ আনন্দের সাথেই করে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তাদের সমবয়সী ভাই-বন্ধু, বা প্রিয় দিদা-দাদু, মাসী-পিষীদের সাথে কিছুটা সময় কাটানোর সুযোগ করে দেই। আর  মাঝে মাঝে টিভি দেখা, বইপড়া, ছবি আঁকাতেও সময় কাটাতে ওরা দারুণ পছন্দ করে।

আমরা বড়রা  যেভাবেই হোক, কোন না কোন কারণে ঘর থেকে বের হই, সবার সাথে যোগাযোগ কথাবার্তা হয়। কিন্তু বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একদম অন্যরকম। তারা দীর্ঘ একটা সময় ঘরবন্দীই থাকে। তাই এই টানা এতটা সময়  ঘরে থাকার সময়টুকু যতটা সম্ভব সক্রিয়, উপভোগ্য ও আনন্দদায়ক রাখা চাই, যাতে তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্হ থাকে।