শিল্প সাহিত্য

স্বপন দত্তের কবিতা

১★
শিলালিপি থেকে যে ইতিহাস পুনরুদ্ধার করা হয়েছিলো

গেরোটা লাগিয়ে দিয়েছিলেন আমাদের দত্তমশায়। কুমিল্লার ওই সে-ই রাজনীতিবিদ, দ্বিখণ্ডিত পূর্ববঙ্গের কংগ্রেস সদস্য, নির্বাচিত সাংসদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত।

আসলে, রোপণ করে গিয়েছিলেন বাকবন্দী বাংলার মুক্তির স্বপ্ন দেখার বীজধান, মীরজাফরের অধঃস্তন জ্ঞাতিগুষ্টির অবাধ বিচরণের পথে-প্রান্তরে। তীক্ষ্ণ বেয়নেটের সমান ভয়ঙ্কর করে তুলেছিলেন সবুজ কোমল দুর্বাঘাসের পেলবতাকে।

উড়িয়ে দিয়েছিলেন দ্বিধাহীন বিশ্বাসে, কষ্ট-বুকের ভেতরে ডানামেলা পায়রাগুলোকে, ঝাঁকে ঝাঁকে।

মায়ের মুখে গল্প-শোনার ভাষাটাকে, স্ব-রাজত্বের মুখর আওয়াজ তুলতে, ডেকে নিয়ে গেলেন আমাদের প্রাণের বান্ধব স্বর-ব্যঞ্জন অ, আ, ক, খ, ং, ঃ নামের অতিশয় উপেক্ষিত বর্ণমালাদের – কুটিল সব ষড়যন্ত্রকারীদের অতিশয় সুরক্ষিত ক্ষমতার শকুনি-সিদ্ধান্তশালায়।

সহসা সেখানে অধিকার শব্দটির ধ্বনি-প্রতিধ্বনিময় ভাষণের  স্ফুলিঙ্গ-বচন, কাঁপিয়ে দিতে থাকে, কুমন্ত্রণা গৃহের চার দেয়ালের ভীত খিলান ও অন্তরাত্মা।
জলা-জংলার দেশটিতে সে মুহূর্তে, পুরোপুরি চেতনায়  আত্মপরিচয়ের চাষাবাদের জমি-জিরেতে বীজ থেকে চোখ মেলতে থাকে হরিৎ রঙের ধান্যশিশুরা।
সুস্বাদু জল সিঞ্চনের তাগিদে, অতঃপর দৃঢ পা ফেলে, উঠে দাঁড়াতে থাকে সব ধরনের আগল ভেঙে, বাংলার  জনসভায়, মঞ্চে, মাঠে, ভাষণে-ভাষায়, বইপত্রে আর পত্র-পত্রিকায় কালো কালো অক্ষরে, সংস্কৃতির প্রগাঢ় চাষাবাদে বহ্নিমান দীপ্ত কয়লার আগুন।

বঙ্গোপসাগরের লবণ বাতাস এসে তখন সর্বত্র বিতরণ করছিলো মাতৃভূমির আস্বাদ। অন্যত্র, চলছিলো জাতি নির্মূলের ষড়যন্ত্র-গৃহের ওই গণপরিষদে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রভাষার নাককাটার জোর-জবরদস্তির তত্ত্ব-তালাশ।

ঔপনিবেশিক শৃঙ্খলের আরেক অদৃশ্য চক্রফাঁসে বেঁধে রাখতে, বঙ্গভূমির কাঁধের উপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছে এক বি-ভাষী সিন্দাবাদী অনড় দৈত্যকে।চেয়েছ, হাজার বছর ধরে বহমান সুমিষ্ট ধ্বনির কণ্ঠভাষায় সুনাব্য, ভরা নদীটাকে  মরা সোঁতায় পরিণত করতে।

রাজনৈতিক দাবাখেলার কৌশলী খেলোয়াড় ধীরেন দত্ত সে মুহূর্তে ঘোড়ার আড়াই-ঘরের মোক্ষম চালটাই দিয়ে ফেললেন।

অধিবেশন কক্ষের আলো-হাওয়া সহসাই পাল্টে গেলো, উল্টে গেলো ষড়যন্ত্রের গণেশ, সেখানে শ্যামলী বাঙলার দোয়েল কোয়েল ফিঙে ডাহুকেরা মুখরতায় কোলাহল তুলে বঞ্চনার কথা বলতে লাগলো।
তাদের প্রত্যেকের ওড়াউড়ির পাখা ঝাপটানোর প্রবল প্রতিবাদের ঝড় অতঃপর বাড়তে বাড়তে, ষড়যন্ত্র কক্ষ ছাপিয়ে, দেয়াল ফুঁড়ে, দরোজা-জানালা খুলে, শিকড়ে শিকড়ে ছড়িয়ে গেলো বাঙলার ঘরে ঘরে।

জাতি পরিচয়ের পতাকা তুলতে গিয়ে দত্তবাবু হয়ে গেলেন ভিনদেশের দালাল। ’৪৭-এর দেশভাগের সাম্প্রদায়িক ভাগ-বাটোয়ারার সুবিধাভোগী সমমতের দাঁতাল সদস্যদের পুঁতিগন্ধময় অশ্রাব্য ভাষা-নর্দমার বিষাক্ত দুর্গন্ধ জলে ভাসতে ভাসতে উদ্ধার হয়ে গেলো ধীরেন্দ্রনাথের চৌদ্দগুষ্টি।

তাতেও কিন্তু গাঙ্গেয় বদ্বীপের জনপদবাসীর চৈতন্যের  নদ-নদীতে জোয়ারের ঢল সঞ্চারে, কোনোই দ্বিধাদ্বন্দ্বের হেলদোল দেখা গেলো না। পলিমাটির স্নেহের পরিচর্যায় সেখানে একে একে চোখ মেললো জাগরণের অঙ্কুর, বীজ থেকে কুঁড়ি ও পাতা, তারপর বৃক্ষ, বৃক্ষ থেকে মহীরুহ, মহীরুহের ছায়ার তলে আশায় বসতি। জন ও জনতা থেকে নেতা ও নেতৃত্ব।

সেই শুরু, তারপর আত্মপরিচয়ের লণ্ঠন দোলাতে দোলাতে অবিরাম উত্তরণ।
বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নোর যুক্তফ্রন্ট, ছয় দফা, ঊনসত্তর – গণ-অভ্যুত্থান, জনারণ্য রেসকোর্স, অভ্রভেদী নির্ভীক আঙুল, সাতই মার্চ, মুক্তিযুদ্ধ, দীপ্ত  স্বাধীনতা, সার্বভৌম স্বদেশ নির্মাণ।

মহানায়কের ডাক : ‘ভায়েরা আমার’ – অনির্বাণ শিখার উত্থান মস্তিষ্কে র কোষে কোষে, বুকের গহীনে চিরন্তন শিলালিপি। সুমধুর – আত্মলীন ডাক দিয়ে যায়।

নিপীড়িত মানবের নশ্বর জীবনে এ সঙ্গীত সতত নদীর মতো নিরবধি ধীর বহমান। অনিঃশেষ মহিমায় সৃজনে ও বিনির্মাণে প্রাণে প্রাণে – অবিনশ্বর।

★১৫ই মে ২০১৯★

২★
তোমাকে যেতে হবে সভ্যতার পথে

সময়ের তো বদল হওয়ার কথা। অতীত গেছে, বর্তমান যচ্ছে। ভবিষ্যৎও যাবে বদল ঘটাতে ঘটাতে।
ঐতরেয় ব্রাহ্মণ বলেছেন – “এগিয়ে যাও… চরৈবেতি চরৈবেতি….চরৈবেতি…..

যাচ্ছি তো এগিয়ে। উড়ালপথ। চক্ররেল। পৃথিবী ফুঁড়ে তৈরি করছি লক্ষণরেখা চূর্ণকরা গতিপথ।
শক্তহাতের মুঠোয় সূক্ষ্ম নাটাই ঘুরিয়ে ওড়াচ্ছি আকাশ পেরোনো বন্ধুঘুড়ি।

খবদ্দার, বলতে পারবে না যে আমার পায়ের নীচে ভূমি নেই। চোখটা খোলো।
দেখতে পাচ্ছো ? কাঠামো আর অবকাঠামো সব কিছু আমার পায়ের তলায় সাঁটা।
ফাঁকা-ফক্কিকার করে এগেচ্ছি না। না, ফক্করতন্ত্রম্ করে কোনো ভিত্তিপ্রস্তরও গাঁথছি না।

তোমরা তো জানোই ভালো কিছু গড়ার আগে ভাঙতে হয়। বিপ্লব তো সবসময় আমার কানে কানে তা-ই বলে যায়।
বাস্তিল তো বলেই, আব্রাহাম লিংকনও ঘৃণ্য দাসপ্রথা উচ্ছেদে আমেরিকার গৃহযুদ্ধের উদাহরণ শোনায়।

বলে, বিনির্মাণ… বিনির্মাণ…। ভাঙো, এবং চুরমার করে দাও সবকিছু ।
নির্মোহ নিড়ানি দাও, আগাছা সব উপড়ে ফ্যালো বেছে, দেউরী ঘরে মোসাহেব জ্ঞাতিগুষ্টিসহ।

যে তোমাকে পিছে টানছে, ছিঁড়ে ফ্যালো সে বাঁধন রশি।
তোমার চলার পথে ব্যারিকেড যারা, তাহাদের ভাঙো।

ভাঙো তাকে, যে তোমাকে অহর্নিশ ক্রুরতায় বেয়নেটে বেড়াজালে আটকে দিতে চায়,
চূর্ণ করো তাকে।
দাও তাকে হাতুড়ির যুক্তি-ঘূর্ণি হাওয়ার মাতম, শাবলের ক্রুদ্ধ বর্ণমালা।
ভেঙে দাও। উৎখাতে উচ্ছেদে হও নির্মোহ পাথর, সব করো দূর, চোখে চোখ রেখে।

তোমাকে এগিয়ে যেতে হবে।
বিচ্ছিন্নতা খরতর নদী, পার হতে হবে, যেতে হবে মানুষের কাছে।
যেতে হবে মানুষের হাত ধরে ধরে, সভ্যতার পথে।

★ ২৮শে ফেব্রুয়ারি ২০২১ ★

৩★
পুতুলকথা, ও মাস্টারনী

তুমি এমন ননীর পুতুল, ছোঁয়া যায় না, ধরা যায় না, বলা যায় না ধরন-ধারণ,
তোমার গড়ন ঠুনকো এমন, ধ্যেৎতেরিকা।

আঘাত লাগে যখন-তখন, মুখ খুললে মহাবিপদ,
আঘাত লাগে আঘাত লাগে আঘাত লাগে ও মানিনী।
তুমি কেমন বীণাপাণি ?
গ্রন্থ ধরো একটি হাতে, অন্য হাতে বেতের ছড়ি,
রবোটকান্তি পুতুল গড়তে পারদর্শী
      তুমি কেবল, ও মাস্টারনী।

অর্থ শর্ত বোঝার আগেই মাথায় ভেতর
ব্ল্যাকবোর্ড-এ,
পেরেক ঠুকে দাগিয়ে দাও
বেমক্কা সব পাতকুড়ানো কথাবাত্রা – শব্দনুড়ি।

হাতে তোমার বীণাটা কই, স্বরের মিঠাই সুরের
স্রোতে মগ্নপাঠে
দুলে দুলে, যুক্তিতক্কে গ্রহণ করি।

না কি তুমি বালিয়াড়ির লু-হাওয়াতে গড়ে ওঠা
বালির মহল,
পথে বেভুল চোখে ধাঁধা – মরীচিকা, প্রশ্ন করলে
ঝাপট প্রবল, গায়ে লাগে –
      ভয়ে থাকো যাবে ধসে।

পরিব্রাজক হাজার একটা জিজ্ঞাসাকে, তোমার
সামনে লেখে যখন ব্ল্যাকবোর্ডে – ঝড়ো হাওয়া।

সরস্বতী নও তো তুমি বীণাপাণি, শেখো নি যে বীণাবাদন – মেঘমল্লার, ভিজিয়ে দিয়ে
ঝড়ের বেদন উড়িয়ে নিতে,
তুমি কেবল রবোটকান্তি পুতুল বানাও,
                    ও মাস্টারনী।

★ ১৭ ই অক্টোবর ২০২০ ★

স্বপন দত্তঃ কবি ও সাংবাদিক