মতামত

ডিলেমা

-বিজন সাহা

প্রথমে কে বলেছিল মনে নেই, তবে নাইন ইলেভেনের পরে জর্জ বুশ বলেছিলেন “তুমি হয় আমাদের সাথে, না হয় আমাদের বিপক্ষে।” মানে মাঝামাঝি কোন পথ নেই। পৃথিবীকে সাদাকালো দু রঙে দেখা এদিন থেকে শুরু হয়নি ঠিকই, তবে এর পর থেকে সেই দেখা আরও বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। এটাই দেশে দেশে বাড়িয়েছে পরমতের প্রতি অসহিষ্ণুতার মাত্রা।

কয়েকদিন আগে আমার এক বন্ধু একটা স্ট্যাটাস শেয়ার করেছিল। সেখানে অন্য এক বন্ধু প্রশ্ন করেছে “মুসলিম বিরোধের অপর নাম কি ধর্মনিরপেক্ষতা?” যদিও সেই লেখাটা ছিল একটা ঘটনার নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ। তার অর্থ দাঁড়াচ্ছে এখন আর নিরপেক্ষ থাকা সম্ভব নয়, নিরপেক্ষ মানেই আপনি আমার বিরুদ্ধে।

একটা সময় ছিল যখন দ্বিধাহীন চিত্তে প্যালেস্টাইনের মানুষের মুক্তির দাবিতে মিটিং মিছিল করেছি, লিখেছি। এখন দিকে দিকে রাজনৈতিক দল আর পুঁজিপতিদের দ্বারা জনগণের স্বাধীনতা চুরি হয়ে যাওয়ার ঘটনা দেখে এসব আর নির্দ্বিধায় করতে পারিনা। বিশেষ করে রাজনৈতিক নেতৃত্ব যখন হঠকারী হয় তখন ভয় হয় আমাদের সমর্থন জনগণের উপর আরও বিপদ ডেকে আনবে না তো।

আমার প্রায়ই মনে পড়ে নব্বইয়ের দশকে চেচনিয়ার যুদ্ধের কথা। অনেকের ধারণা বরিস ইয়েলৎসিন নিজের এগো ত্যাগ করে দুদায়েভের সাথে বিনা রক্তপাতে সমস্যা মিটিয়ে নিতে পারতেন। তবে সে যাই হোক, চেচনিয়া এক সময় বলতে গেলে স্বাধীনতা পেয়েছিল। কিন্তু তাদের স্বাধীনতা দরকার ছিল না,  তাহলে তারা দেশের উন্নয়নে মনোযোগ দিত। সেটা না করে তারা বিভিন্ন রকম বেআইনি কাজে লিপ্ত হয়, পাশের রাজ্য দাগিস্তান আক্রমণ করে। ফলাফল এখন সবার জ্ঞাত।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ আর ১৯৭৩ সালে ভিয়েতনাম ছাড়া খুব কম দেশই স্বাধীন হয়েছে যার ফলাফল সে দেশের জনগণের ভাগ্য পরিবর্তন করেছে, তারা কোন না কোন ভাবে স্বাধীনতার সুফল উপভোগ করতে পেরেছে। এখানে জনগণ বলতে আমি সরকারি বা অন্য কোন রাজনৈতিক  দলের নেতাকর্মীদের না বুঝিয়ে সেই সব সাধারণ মানুষকে বুঝিয়েছি যারা রাজনৈতিক খেলার বাইরে থেকে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কৃষি, শিল্প এসব উৎপাদনশীল সেক্টরে কাজ করে দেশকে সচল রাখে। আফ্রিকার প্রায় সব দেশই  স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী দল বা নেতার ক্ষমতা ও অর্থলিপ্সার শিকার হয়েছে। কসোবার নেতৃত্ব নিয়েও খুব বেশি কিছু বলার নেই। প্রায় একই কথা বলা চলে সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলো সম্পর্কে। এসব দেশের নেতৃত্বের  অধিকাংশই রাশিয়া ও আমেরিকার সাথে দর কষাকষি করে নিজেদের ব্যক্তিগত অবস্থার উন্নতি করতে ব্যস্ত।

আসলে ইদানিং কালে প্রায় সব দেশেই রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের কথা বলে জনগণের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে খায়। তাই আমাদের মত সাধারণ মানুষ যখন মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জনগণের মুক্তির জন্য মিটিং মিছিল করে, লেখালেখি করে তখন আসলে সে বাঘের মুখ থেকে তাদের সিংহের মুখে ঠেলে দেয়, অথবা বলা যায় জনগণের স্বাধীনতার মালিকানার পরিবর্তন করতে সাহায্য করে, জনগণকে স্বাধীন করে না।

জানি, নিরপেক্ষতা আজকাল আর কেউ কেনে না, কিনতে চায় না। কিন্তু নিরপেক্ষতা না থাকলে পৃথিবী চলবে কেমনে, সমাজ চলবে কেমনে? আমাদের ঠিক করতে হবে আমরা ন্যায় বিচার চাই নাকি আমাদের পক্ষে বিচার চাই। আজ যদি আমরা আমাদের পক্ষে বিচারের ফলাফল চাই (যদি সেটা ন্যায় নাও হয়) একদিন আমরা নিজেরাই ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হব। নিরপেক্ষতা মানে indifference বা উদাসীনতা নয়, নিরপেক্ষতা মানে সবার জন্য ন্যায় বিচার, সবার ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই।

কথায় আছে এক হাতে তালি বাজে না। যুদ্ধ যখন হচ্ছে সেখানে দুই পক্ষেরই দায়িত্ব আছে। মা হিন্দু না মুসলিম, বৌদ্ধ না খৃস্টান, ইহুদি বা অন্য কেউ – সব মাই সন্তানের মৃত্যুতে একই রকম ব্যথা পায়।  মরার আগে পর্যন্ত মানুষের জাতি, ধর্ম যাই থাকুক না কেন, মরার পর সে শুধুই লাশ। তাই আমাদের কথা বলতে হবে যুদ্ধের বিরুদ্ধে। আমাদের কথা বলতে হবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে তা বিশ্বের যেকোনো প্রান্তেই ঘটুক না কেন। যখন ধর্মীয় বা কারণে পাশের বাড়ির লোক গৃহহারা, দেশ ছাড়া হয় সেটার বিরুদ্ধে কথা না বললে আমরা বিশ্বের অন্য যেকোনো জায়গায় একই অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার নৈতিক অধিকার হারাই। যখন আদর্শের কারণে কেউ নির্যাতিত হয় তখন তার পাশে না দাঁড়াতে পারলে একই কারণে অন্য জায়গায় অন্য কেউ নির্যাতিত হলে তার পক্ষে কথা বলার নৈতিক অধিকারও আমরা হারিয়ে ফেলি তা তার আদর্শ আমার যতই কাছের হোক না কেন!  কালো হোক আর ধলা হোক, হলুদ হোক আর তামাটে হোক, এশিয়ান হোক আর ইউরোপিয়ান হোক, ধার্মিক হোক আর নাস্তিক হোক – সব জীবনই গুরুত্বপূর্ণ। যতক্ষণ আমরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সিলেক্টিভ থাকব, যতদিন না আমরা জাতি, ধর্ম, গোত্র এসব সংকীর্ণতার উপরে উঠে শুধুই মানুষ হতে শিখব ততদিন এসব সমস্যা থাকবেই আর আমাদের এই সংকীর্ণতাকে পুঁজি করে ধূর্ত রাজনীতিবিদ, ধর্ম ব্যবসায়ী আর অর্থলোভী শকুনেরা সাধারণ মানুষকে যুগের পর যুগ ধরে শোষণ করবে।  হিংসা দিয়ে হিংসা সাময়িক ভাবে ঠেকানো যায়, তবে আজ হোক কাল হোক হিংসার আগুন জ্বলে উঠেই। একমাত্র অহিংসাই হিংসাকে চিরতরে জয় করতে পারে।  নিজ নিজ দেশের সাধারণ মানুষের দুর্দশার কথা মাথায় রেখে ইসরাইল আর প্যালেস্টাইনের নেতারা যাতে যুদ্ধ বন্ধ করে, যুদ্ধকে নিজেদের রাজনৈতিক জনপ্রিয়তা বাড়াতে কাজে না লাগাতে পারে সেটাকে যদি আমরা নিশ্চিত করতে পারি তবেই শুধু এ অঞ্চলেই নয়, পৃথিবীর সর্বত্রই যুদ্ধের সম্ভাবনা কমবে। যতদিন যুদ্ধ লাভজনক বিভিন্ন অজুহাতে সে আসবেই, তাকে আমাদের উপর চাপিয়ে দেবেই। কিন্তু মানুষ পারে যুদ্ধকে না বলতে আর না বলার মাধ্যমে একে অলাভজনক করতে। একমাত্র তখনই সম্ভব হবে যুদ্ধকে হটানো।
রাজনীতিবিদ বা মুনাফা লোভী অস্ত্র ব্যবসায়ী নয়, আরব আর ইসরাইলের সব শান্তিপ্রিয় মানুষের পক্ষে আসুন গলা মেলাই, তাদের জন্য একসাথে সবাই শান্তি কমনা করি।

দুবনা, ১৬ মে ২০২১

গবেষক  ও শিক্ষক