মতামত

রুশ-চীন সম্পর্কের এপিঠ ওপিঠ

-রবীন গুহ

রবীন গুহ

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে মার্কিন-চীন সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবকের ভূমিকা রেখেছিল। কিন্তু ৯১ সালে সোভিয়েত সংঘরাষ্ট্র ভেংগে যে নতুন রুশ প্রজাতন্ত্রের আবির্ভাব হয়, তার সাথে চীনের সম্পর্কের এক নাটকীয় সূত্রপাত হয়। ৯২ সালেই দুটি দেশ অতীতের পরস্পর বিরোধী অবস্হান থেকে সরে এসে নিজেদের মধ্যে ‘গঠনমূলক সম্পর্ক’ তৈরীর প্রত্যয় ব্যক্ত করে। যার ফলে দুটি দেশের কূটনৈতিক,অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পায়। দুটি দেশের ‘কৌশলগত অংশীদারিত্ব’ এর পথ পেরিয়ে ২০০১ সালে ‘বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা’ নামক একটি কাগজে-কলমে চুক্তি করে। সাম্প্রতিক সময়টাকে বেইজিং ও মস্কোর সম্পর্কের মাহেন্দ্রক্ষন বললেও অত্যুক্তি করা হবেনা। ২০১৯ এর জুন মাসে  চীনা প্রেসিডেন্ট কোন রাখ-ঢাক না রেখেই ভ্লাদিমির পুতিনকে তার ‘সেরা বন্ধু ও সহকর্মী’ বলে সম্ভাষণ করলেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীতে যুদ্ধে বিজয়ী দুই শক্তিধর রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকা নিজেদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের জন্য ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’তে অবতীর্ণ হয়। ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’ চলাকালীন সময়ে ‘আমেরিকা-চীন-সোভিয়েত ইউনিয়ন’ এর ত্রিপাক্ষিক সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। মার্কিনীরা সোভিয়েতকে ঘায়েল করার জন্য চীনাদের ব্যবহার করতে থাকেন। আর এতগুলি বছর পরও বিশ্ব রাজনীতিতে ত্রিদেশীয় আন্ত:সম্পর্ক অনেকটা আগের মতই গুরুত্ব বহন করে। বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকেরা তাকিয়ে থাকে দেশ তিনটির সম্পর্কের পারদের উঠানামার দিকে। তবে এখন পরিস্হিতি একশত আশি ডিগ্রীতে ঘুরে গেছে। এখন চীন-রুশ যৌথভাবে আমেরিকাকে একটা নির্দিস্ট বলয়ের ভিতরে বেঁধে দিতে চায়। নানাক্ষেত্রে মার্কিনীদের একচেটিয়া মাতব্বরী যৌথভাবে ঠেকিয়ে দিতে দুটি দেশই ঐক্যবদ্ধ। বিগত বছরগুলোতে নানা আন্তর্জাতিক ফোরামগুলিতে সিদ্ধান্ত প্রণয়নের ক্ষেত্রে দুটি দেশ যুগপৎভাবে নিজেদের স্বার্থের পক্ষে বা মার্কিন ও তাদের মিত্রদেশগুলোর বিরুদ্ধে অবস্হান নিচ্ছে।

বিদ্যমান চীন-রাশিয়ার বন্ধুত্বমূলক সম্পর্কের ভিত্তি হলো, দীর্ঘ সীমান্তে উত্তেজনবিহীন শান্তিপূর্ণ সহাবস্হান, ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য, আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে আমেরিকার ঔদ্ধত্বপূর্ণ আচরন রুখে দাঁড়ানোসহ বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই যুগপৎ ভূমিকা, যৌথ সামরিক সহযোগিতা, মার্কিন ডলারের নির্ভরযোগ্যতা কমিয়ে ইয়েন ও রুবলে লেনদেন, চীনে জায়ান্ট গ্যাসলাইনে সরাসরি গ্যাস সরবরাহ যা চীনকে জ্বালানী নিরাপত্তা আর রাশিয়ার জন্য ইউরোপের বিকল্প জ্বালানীর বাজার সৃষ্টি করে। বিশেষ করে, রাশিয়ার ক্রিমিয়াকে অধিগ্রহন করে রাখার পর থেকে পশ্চিমাদের দ্বারা আরোপিত বাণিজ্য অবরোধ মোকাবেলা করার জন্য চীনের সাথে তার বাণিজ্য বৃদ্ধির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ক্রিমিয়া অধিগ্রহণের পরপরই রাশিয়া চীনের সঙ্গে ৩০ বছরের জন্য ৪০০ বিলিয়ন ডলারের একটি গ্যাস চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ফলে ২০১৯ সাল থেকে রাশিয়ার ৩০ বছরে বার্ষিক ৩৮ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় জ্বালানি প্রতিষ্ঠান গাজপ্রমের সঙ্গে চীনের ন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের এই চুক্তির আওতায় চীনের হেইলঙগিজাঙ প্রদেশ পর্যন্ত ২ হাজার ৫০০ মাইল লম্বা পাইপলাইন নির্মাণ করেছে।একদিকে রাশিয়া চীনকে গ্যাসসহ নানা কাঁচামাল সরবরাহ করছে আর অন্যদিকে চীনা উৎপাদিত বিভিন্ন পণ্য কিনছে।

রাশিয়া-চীনের এই বন্ধুত্বে কৌশলগত ও অভিন্ন যৌথ স্বার্থের ব্যাপার থাকলেও আদর্শ বা মূল্যবোধের একতা না থাকায় সম্পর্কটা বাগাড়ম্বরের দিক বিবেচনায় যতটা নিঁখুত, বাস্তবে অতটা নয়। তাই এই সম্পর্ক টেকসই বলা যায়না-স্বার্থের টানাপোড়নে যে কোন সময় ভেংগেও যেতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা আশংকা করেন। কয়েকটা কারণের মধ্যে হতে পারে—রুশ প্রভাবাধীন মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে চীনের প্রভাব বৃদ্ধির তৎপরতা। কাজাখস্তান, তাজিকিস্তানের মতো দেশগুলোতে চীন ব্যাপক হারে বিনিয়োগ করছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ কার্যকর করার জন্যই মধ্য এশিয়ার দেশগুলোকে দরকার চীনের। রুশ প্রভাব কাজে লাগিয়েই মধ্য এশিয়ায় অবাধ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করছে চীনা সরকার। মধ্য এশিয়ার দেশগুলো অনেকটা রাশিয়ার বাড়ির পেছনের উঠানের মতো। আবার সীমান্ত–সংলগ্ন ও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় চীনেরও তাদের সমর্থন প্রয়োজন। তাই ঢালা হচ্ছে বিলিয়ন বিলিয়ন ইউয়ান। আর মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর পথেঘাটে চোখে পড়ে বড় বড় অক্ষরে লেখা ‘চায়না এইড’। অর্থাৎ, গত শতাব্দীতে সোভিয়েত ইউনিয়ন যা করত, সেই ভূমিকাই এবার নিয়েছে চীন। নিজের বাড়ির পিছনের উঠানে চীনাদের এত বেশিমাত্রায় প্রভাব রুশ কুটনৈতিক মহলের স্নায়ুচাপ বাড়াচ্ছে।

চীন এখন বিশ্বময় একটি আগ্রাসী জাতি হিসেবে পরিচিত লাভ করেছে। সমুদ্রসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তিসমূহ লংঘন করে সে দক্ষিণ চীন সাগর এবং সেখানকার কয়েকটি দ্বীপ দখলের চেষ্টায় লিপ্ত। যার জন্য ওই অঞ্চলের ২০টি দেশের সাথে তার যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে।এসব দেশের মধ্যে রয়েছে সমাজতান্ত্রিক ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ব্রুনাই, অস্ট্রেলিয়া প্রমুখ। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী এই সাগর এবং সাগরতলের সম্পদ সব দেশের সম্পদ হওয়ায় বিশ্বের সব দেশ চীনের এই আগ্রাসী ভূমিকার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এছাড়াও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ বা দক্ষিন এশিয়ার দেশ শ্রীলংকাতেও বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের নামে দেশগুলোকে ঋনের জালে আটকে নিজেদের আর্থ-রাজনৈতিক ফায়দা আদায়ের চেস্টা চালিয়ে যাচ্ছে, তা দেশে দেশে কুটনীতিকদের ভাবিয়ে তুলছে। বহুপক্ষীয় বিভিন্ন ফোরামগুলোতে চীন-রাশিয়া সম্পর্ক ভারসাম্য রক্ষা করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, চীনের অর্থনীতি ব্রিকসের রাশিয়াসহ অন্য চার সদস্যের অর্থনীতির সম্মিলিত আকারের চেয়েও বড়। তাদের উন্নয়ন ব্যাংকেও চীনের অংশীদারি এদের সবার মিলিত অংশীদারির চেয়ে বড়। এরকম আরো বিভিন্ন ক্ষেত্রেই মহাপরাক্রমশালী চীন ক্ষয়িষ্ণু রাশিয়াকে দুর্বার গতিতে পিছনে ফেলে দিচ্ছে। যার ফলশ্রুতিতে চীনের অসম প্রভাব বিস্তারের সকল প্রচেষ্টা রাশিয়ার কাছে গ্রহনযোগ্য নয়। চীনের ফুলে-ফেঁপে উঠা অর্থনীতির তুলনায় রাশিয়ার বর্তমান অর্থনীতি কিছুটা হলেও ক্ষয়িষ্ণু। চীন চায় আপাতত: রুশদের সাথে সুসম্পর্ক রেখে আমেরিকাকে পিছনে ফেলে বিশ্বের প্রধান শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে,আর রাশিয়া চায় চীনের সাথে গাঁটছাড়া বেঁধে মহাপরাক্রমশালী আমেরিকাকে মোকাবেলা করে তার অতীতের বিশ্বনেতার আসন ফিরে পেতে। কিন্তু, ‘এক ঘর মে-দো’পীর’ এর সহাবস্হান কতটা সম্ভব? দুদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে কে বেশি লাভবান হবে? সময়ই বলে দেবে।