মতামত

কেন মার্কস পড়বো? ( শেষ পর্ব)

-এম . এম . আকাশ
এম এম আকাশ

লেনিনের মার্কস পাঠের পদ্ধতি

লেনিন নিজে মার্কস পাঠ করেছিলেন গভীর অভিনিবেশ সহ, দ্বান্দিক ও সৃজনশীল পদ্ধতিতে। তার মার্কস পাঠের পদ্ধতি নিয়ে স্মৃতিচারন করতে গিয়ে তাঁর স্ত্রী নাদেজদা ক্রুপস্কায়া “শিক্ষা-দীক্ষা” গ্রন্থে লিখেছিলেন,

“মার্কস পড়ার সময় তিনি  (লেনিন) অগনিত অংশ উধৃত করে রাখতেন। মার্কসের রচনা থেকে উধৃত অংশে ভরা বহু খাতা ‘লেনিন ইনষ্টিটিউটে’ আছে। ভ্লাদিমির ইলিচ এগুলি তাঁর লেখায় ব্যবহার করতেন, ফিরে ফিরে পড়তেন, টীকা লিখতেন।” ( নাদেজদা স্ক্রুপস্কায়া , শিক্ষা-দীক্ষা, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, পৃ: ৫৮)

ক্রুপস্কায়া আরো লিখেছেন, মার্কসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পাঠক লেনিন ১৯২০ সালে কমসমলের (বলশেভিকদের কিশোর সংগঠন) তৃতীয় নিখিল রুশ কংগ্রেসে বলেন,

“আমাদের প্রয়োজন মানবিক জ্ঞানের সারাংশ আয়ত্ব করতে পারা এবং এমনভাবে আয়ত্ব করা যাতে কমিউনিজম মুখস্ত করা একটা ব্যাপার হয়ে না থেকে, হয় এমন একটা বস্তু যা আপনারাই নিজে ভেবে বার করেছেন, তার মধ্যে অংগীকৃত হবে এমন সব সিদ্ধান্ত যা আধুনিক দৃষ্টিভংগী থেকে অনিবার্য।” (শিক্ষা-দীক্ষা, প্রগতি, পৃ: ৫৯)

ক্রুপস্কায়া আরো লিখেছেন লেনিনের একটি প্রিয় বাক্য ছিল “আসুন মার্কসের সংগে পরামর্শ করা যাক।” সুতরাং নিঃসন্দেহে বলা যায় লেনিন গভীর মনোযোগ দিয়ে, সৃজনশীল সমালোচকের দৃষ্টিতে মার্কস পাঠ করেছিলেন। তার এই পাঠ পদ্ধতি সম্পর্কে ক্রুপস্কায়ার আরেকটি শিক্ষনীয় উক্তি হচ্ছে,

“লেনিনের পদ্ধতি ছিল অনুরূপ পরিস্থিতির ক্ষেত্রে মার্কস যা লিখেছেন তা বেছে নিয়ে সযত্নে বিশ্লেষন করে বর্তমান পরিস্থিতির সংগে তার তুলনা দ্বারা উভয়কার মিল-গরমিলগুলি বের করে আনা। লেনিন তা কী করে করতেন তার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হল ১৯০৫-১৯০৭ সালের বিপ্লবে (রুশ দেশের প্রথম বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কথা বলা হচ্ছে – যেটি অসমাপ্ত অবস্থাতেই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব তাকে takeover করেছিল।)  (শিক্ষা-দীক্ষা, প্রগতি, পৃ: ৬৩)

মার্কসের থেকে কি পড়বো?

এতক্ষণ আমরা মার্কস পড়ার সঠিক পাঠ-পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেছি।

একটি প্রশ্ন সংগত ভাবেই আসবে, তা হচ্ছে মার্কস প্রকাশিত-অপ্রকাশিত যে হাজার হাজার পৃষ্ঠার লিখিত পান্ডুলিপি রেখে গিযেছেন এগুলি সবই কি সমান প্রাসংগিক বা সমান মূল্যবান? মার্কস এর চিন্তাকে বোঝার জন্য এগুলি সবই কি আমাদের পড়তে হবে? আধুনিক জীবনে অত সময় কি কারো আদৌ আছে?

যারা মার্কস নিয়ে গবেষণা করতে চান বা চেয়েছেন তারা মার্কসের অপ্রকাশিত পান্ডুলিপি ও নানা চিঠিপত্র নিয়ে আজো প্রবল উৎসাহে গবেষণা ও তত্ত্ব চর্চা অব্যাহত রেখেছেন। ভারতের দেশ পত্রিকায় যেমন আজও রবীন্দ্র চর্চা রবীন্দ্র ভক্তরা কিছুদিন পরপরই  অব্যাহত রেখেছেন অনেকটা সেরকম। কিন্তু সাধারণ পাঠকদের জন্য মার্কসের সবকিছু পড়ার দরকার নেই। তাদের জন্য দুটি বই অবশ্যই পড়ার সুপারিশ পন্ডিতরা করে থাকেন। একটি হচ্ছে তাঁর “পুঁজি” গ্রন্থটি। অপরটি এর আগে লেখা “কমিউনিষ্ট” পার্টির ইশতেহার” নামক ক্ষুদ্র একটি পুস্তিকা যার সহলেখক ছিলেন এংগেলস। এই দুটি বই সহজলভ্য এবং বহু ভাষায় অনুদিত হয়েছে। “পুঁজি” গ্রন্থটির চার খন্ডে প্রণয়নের একটি মহাপরিকল্পনা ছিল মার্কসের। মহাপরিকল্পনার পর একমাত্র প্রথম খন্ডটি মার্কস লিখে শেষ করে, প্রকাশ করে যেতে পেরেছিলেন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় খন্ড এংগেলস সম্পাদনা করে তাঁর মৃত্যুও পর প্রকাশ করেন। অনেকে মনে করেন “Theories of Surplus Value” নামে মার্কসের যে আরো তিনটি খন্ড বাজারে পাওয়া যায় সেগুলি ছিল আসলে সব মিলিয়ে পুঁজি গ্রন্থেÍর অপ্রকাশিত চতুর্থ খন্ড যা এংগেলস সম্পাদনা করে যেতে পারেন নি। আজকাল অবশ্য “পুঁজি” গ্রন্থের নানা জানপ্রিয় ছোট সংস্করন বা Short Version প্রকাশিত হয়েছে।

পুঁজি গ্রন্থের মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে এর ভ‚মিকায় মার্কস লিখেছিলেন যে এর উদ্দেশ্য হচ্ছে “পুঁজিবাদী সমাজের গতির নিয়মটি “উদ্ঘাটিত করা” এবং তার এই উদ্ঘাটন পদ্ধতিটি ছিল দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী পদ্ধতি। তিনি দেখিয়েছিলেন কিভাবে বাজারে পণ্য ক্রয় বিক্রয় ব্যবস্থা থেকে, মুদ্রার উদ্ভব হয় এবং কিভাবে মুদ্রা পুঁজিতে পরিণত হয় এবং অবশেষে পুঁজি তার নিজের নিয়মেই বিকশিত হয়ে সংকটে পড়ে এবং অবশেষে শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবের মাধ্যমে অনিবার্য ভাবে তার মৃত্যু ঘটে-পুঁজির এই সমগ্র ঐতিহাসিক জীবনবৃত্তান্তটি একটি প্রাকৃতিক-ঐতিহাসিক (Natural-Historical Law)  নিয়ম হিসাবে সারা বিশ্ব থেকে আহরিত তথ্য ও যুক্তি দিয়ে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন মার্কস। মার্কসের এই প্রকল্প ছিল তাই খুবই উচ্চাকাংখী এক প্রকল্প। অনেকেই তাই মার্কসের এই কাজকে জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ডারউইনের আবিষ্কারের সংগে তুলনা করে- থাকেন। মার্কস নিজেও প্রথমে পুঁজি গ্রন্থকে ডারউইনের নামে উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন! এই গ্রন্থে মার্কস এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে পুঁজিবাদী সমাজের মৃত্যুবান পুঁজিবাদের ভেতরেই নিহিত আছে এবং কেউ চাক্ বা না চাক তার হাত থেকে পুঁজিবাদের কোন রক্ষা নেই।

কিন্তু পুঁজি গ্রন্থ প্রকাশের প্রায় দেড়শত বছর পর আমরা বর্তমানে দেখতে পাচ্ছি যে পুঁজিবাদ নানা সংকট সত্ত্বেও এখনো টিঁকে আছে। সেহেতু মার্কসের পুঁজি বইটি পড়তে হবে দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিতে অর্থাৎ পুঁজিবাদের কি ভাবে ধ্বংস হবে বলে মার্কস ভেবেছিলেন, তার কতটুকু হোল, কতটুকু হোল না, কেন হোল না, ইত্যাদি খুঁজে বার করার জন্য পুঁজিবাদবিরোধী বিপ্লবী  অবস্থান থেকে পড়বেন তারা যারা পুঁজিবাদের বৈষম্য-বেকারত্ব ও অন্যান্য নানা সংকটের জন্য পুঁজিবাদকে প্রত্যাখান করতে আগ্রহী এবং পুঁজিবাদের ধ্বংস চান। আর যারা বৈষম্যমূলক শ্রেনীবিভক্ত পুঁজিবাদের সংকটের সংস্কার করে তাকে মানবিক চেহারা দিতে চান ও তা সম্ভব বলে মনে করেন তারা পড়বেন মার্কস পুঁজিবাদের কাঠামোতে যে অসংগতিগুলো চিহ্নিত করেছিলেন সেগুলি পুঁজিবাদের কাঠামো বজায় রেখেই কোনভাবে সমাধানের উপায় আছে কি না-তা খুঁজে দেখার জন্য। তাদের অবস্থান বিপ্লবী হবে না, হবে রক্ষনশীল।  এই দুই ধরণের পাঠকই আজ “ক্যাপিটাল” পড়ছেন এবং পরস্পরের সংগে আজো নানাভাবে তর্কযুদ্ধে (Discourse) অবতীর্ন হচ্ছেন।

সুতরাং যারা মার্কসের বিরোধী ও পুঁজিবাদের পক্ষে এবং যারা মার্কসের পক্ষে ও পুঁজিবাদের বিরোধী উভয়ের জন্য মার্কসের “ক্যাপিটাল” একটি অন্যতম শিক্ষনীয় চিরায়াত গ্রন্থ। পুঁজিবাদ যেহেতু এখনো বিদ্যমান সে জন্য “পুঁজি” গ্রন্থও এখনো এই উভয় স্কুলের জন্য একটি অন্যতম পাঠ্য বই বটে।

অনেকের ধারণা “সমাজতন্ত্র” বোঝার জন্য মার্কসের লেখা পড়তে হবে। এটি সম্পূর্ণ ভুল একটি ধারণা। এখন পর্যন্ত প্রকাশিত মার্কস রচিত ৬০ খন্ড বইয়ের মধ্যে মাত্র একটি অতি ক্ষুদ্র ত্রিশ-চল্লিশ পৃষ্টার তন্বী পুস্তিকা আছে যার প্রত্যক্ষ বিষয়বস্তু হচ্ছে পুঁজিবাদ উত্তর সমাজতান্ত্রিক সমাজ। এই বইয়ে সমাজতন্ত্রকে  আবার তিনি দুই স্তরে ভাগ করেছিলেন। প্রথম স্তরকে তিনি তার কিছুটা  ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতার কারণে নাম দিয়েছিলেন “সমাজতন্ত্র” বা ”সাম্যবাদের নিম্নতর স্তর” (Lower Phase of Communism)। মার্কসের আদর্শ সমাজের নাম তাই সমাজতন্ত্র নয়, তার নাম সাম্যবাদ (Communism)। সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ নিয়ে মার্কসের যে ছ্ট্টো একটি মাত্র সিরিয়াস লেখার কথা উপরে উল্লেখ করা হোল, তার নাম হচ্ছে,

“গোথা কর্মসূচীর সমালোচনা প্রসংগে।” (Marx, “A critique of Gotha Programme”, Marx-Engels selected works, volume-2, Foreign language publishing house, Moscow, 1949, PP-17-34)

এই লেখাটি সম্ভবতঃ তারাই পড়বেন যারা পুঁজিবাদ উত্তর নতুন মানবিক সমাজ নির্মানে আগ্রহী। আর যেসব দেশে সমাজতন্ত্রের নানারকম পরীক্ষা-নীরিক্ষা হয়েছে, সাফল্য-ব্যর্থতার নানা রেকর্ড রয়েছে, সেসব দেশের সমাজ বিকাশের “ডাইনামিক্স” বোঝার জন্যও মার্কসের এই ছোট বইটি কাজে লাগতে পারে।

তবে পুঁজিবাদের যাঁতাকলে যে শ্রমিক, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত শোষিত জনগণ ধুঁকছে, যে কালবর্ণের মানুষ, উপনিবেশের মানুষ, সংখ্যালঘু মানুষ, নির্যাতিত নারী, অধিকার হারা সর্বহারা ম্লান-মুঢ়-মুক মুখ নিয়ে মুক্তির দিন গুনছেন – তারাও মার্কস পড়বেন কিন্তু তাদের কাছে পুঁজি নয়, আরো গুরুত্বপূর্ণ প্রেরণাদায়ক বই হচ্ছে “কমিউস্টি পার্টির ইশতেহার”। এই বই মার্কস এংগেলস দুজনে মিলে লিখেছিলেন। বইটি খুবই ছোট কিন্তু এর প্রতিক্রিয়া হয়েছিল “Electrifying”.  বইটি তাঁরা রচনা করেছিলেন আন্তর্জাতিক বিপ্লবীদের আন্তর্জাতিক সংগঠন “কমিউনিস্ট লীগের” একটি ঘোষনাপত্র ও কর্মসূচী রচনার দায়িত্ব পাওয়ার পর। এটি হচ্ছে সাম্যবাদীদের ইশতেহার। এই বইটি  প্রকাশিত হওয়ার পর লক্ষ লক্ষ কপি ছাপা হয়েছে, পৃথিবীর প্রায় সব ভাষাতেই এই বই অনুদিত ও পঠিত হয়েছে। বি.বি.সি.-র জরীপ অনুযায়ী মার্কসের এই বইটির কদর পৃথিবীর হাতে গোনা অল্প কয়েকটি বইয়ের সমপর্যায়ভুক্ত।

উপসংহার

আমরা এই প্রবন্ধে বলার চেষ্টা করেছি যে মার্কস আজো প্রাসংগিক কারন পৃথিবীতে আজও পুঁজিবাদ টিকে আছে এবং মার্কসের লেখার অন্যতম বিষয় ছিল “পুঁজিবাদের গতির নিয়ম আবিষ্কার”। সুতরাং আমরা মনে করি পুঁজিবাদকে যারা রক্ষা করতে চান তারা যেমন মার্কস পাঠ করছেন। তেমনি যারা পুঁজিবাদকে ধ্বংস করতে চান তারাও মার্কস পাঠ করবেন। যদিও তাদের উভয়ের পাঠের দৃষ্টিভংগী ও উদ্দেশ্য হবে সম্পূর্ণ পরস্পর বিরোধী।

আমরা আরো বলেছি যারা ভবিষ্যতের নবায়িত সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদ অথবা বৈষম্যহীণ-শোষনহীন-গণতান্ত্রিক-সমৃদ্ধ একটি সমাজের স্বপ্ন দেখেন তাদেরকেও আজ আত্মসমালোচনা সহ দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতে মার্কসের মূল রচনাগুলি পাঠ করতে হবে। তবে বেশী করে পড়তে হবে এই বিষয়ে মার্কসবাদী ও অমার্কসবাদী সকল গুরুত্ত্বপুর্ন তাত্ত্বিকদের বিতর্কমূলক রচনাসমূহ। আর এই পাঠকে হতে হবে মুক্ত মনা পাঠ।

আমরা আরো বলেছি মার্কসকে পড়ার পদ্ধতিটি হবে দ্বান্দ্বিক । সর্বশেষ তথ্যের সাহায্যে মার্কসের তত্ত¡গুলিকে যাঁচাই সাপেক্ষে ক্রমাগত সৃজনশীলভাবে তত্ত্বকে বিকশিত করতে হবে।

মার্কসের রচনা পাঠের সময় সর্বদা কোনটি মার্কসের লেখার সারমর্ম আর কোনটি তার আপেক্ষিক পরিবর্তনযোগ্য প্রকাশ সে বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা নিয়ে মার্কস পাঠ করলে আমরা  মার্কসকে কখনো ঈশ্বর বা নবী বা absolute idea – র প্রবক্তা বানাবো না আবার তাকে শয়তানের চেলা বা পরিপূর্ণ মিথ্যা ও ভুলে ভরপুর বলেও মনে করবো না। হেগেল যেমন তার দর্শনকে absolute idea বলে দাবী করেছিলেন, মার্কস কিন্তু নিজে কখনো তার “আদর্শকে”absolute বলেন নি।

তবে মার্কসকে শুধু পড়ার জন্য পড়া এক কথা আর মার্কস পড়ে তার আলোকে দুনিয়াকে বদলানোর চেষ্ট করা হচ্ছে সম্পুর্ন ভিন্ন আরেকটি কথা।

(লেখকঃ রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, শিক্ষক ও গবেষক)