মতামত

কেন মার্কস পড়বো? (২য় পর্ব)

-এম . এম . আকাশ

মার্কস জীবনে নানারকম কাজ করেছেন। অধ্যাপক হওয়ার বাসনা বাধ্য হয়ে ত্যাগ করার পর প্রথম দিকে র‌্যাডিকেল একটি পত্রিকা প্রকাশ করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এ ধরণের প্রতিটি উদ্যোগেই তাঁর ব্যর্থ হয়েছে। তাকে তাড়া করেছে রাষ্ট্র। একবার প্যারিস, একবার ব্রাসেলস, একবার পুনরায় জার্মানী, তারপর পুনরায় প্যারিস হয়ে তিনি অবশেষে ইংল্যান্ডে এসে প্রবাসী শরনার্থী বিপ্লবী হিসাবে স্থিতিশীল হয়েছেন। সেটাও সম্ভব হয়েছিল তার বুর্জোয়া  বন্ধু ফ্রেডারিক এংগেলসের (উত্তরাধিকারী হিসাবে প্রাপ্ত কারখানার মালিক) সক্ষমতা, অকৃত্রিম ভালবাসা ও আর্থিক সাহায্যের ফলে।

যদিও “বিপ্লবী শরনার্থীর” জীবন কোন আরাম দায়ক জীবন ছিল না, কিন্তু তিনি তা স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছিলেন এবং চেষ্টা করেছিলেন লেখনীর মাধ্যমে ইউরোপ ও জার্মানীর শ্রমিক বিপ্লবকে উদ্দীপ্ত করতে এবং মোটামুটি একটি জীবিকার্জন করে সাধ্যমত বেঁচে থাকতে। বলা বাহুল্য যে একসংগে এই দুটি উদ্দেশ্য অর্জন বেশ কঠিন ছিল। তাঁর যুগের চেয়ে অগ্রসর লেখাগুলির রোজগার যে যথেষ্ট ছিল না তা আগেই আমি উল্লেখ করেছি। কিন্তু মার্কসের চরিত্রের মধ্যে ছিল এক ভীষণ একরোখা স্বাধীনচেতা মনোভাব। তিনি প্রায়ই মচকে গেছেন কিন্তু কখনো ভাংগেন নি। তখনকার ইউরোপীয় সাংস্কৃতিতে একটি “আত্মস্বীকারোক্তির” ইন্টারেস্টিং প্রথা চালু ছিল। ১৮৬৫ সালে মার্কসের দেয়া “ব্যক্তিগত স্বীকারোক্তিমূলক প্রশ্নোত্তরটি” এখানে তুলে ধরা হোল। পাঠক এ থেকে মার্কসের একরোখা চারিত্র্য বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পেতে পারেন।

 

মার্কসের ব্যক্তিগত স্বীকারোক্তি

আমার অভীষ্ট গুন      …………..  সারল্য।

পুরুষের মধ্যে আমার প্রিয় গুন    ………….. সবলতা।

মেয়ের মধ্যে আমার অভীষ্ট গুন    …………..    দুর্বলতা।

আমার প্রধান চারিত্র্য বৈশিষ্ট্য …………..    আদর্শে নিষ্ঠা।

আমার মতে সুখ কি    …………..  লড়াই করা।

আমার মতে দুঃখ কি   …………..    পরবশ্যতা।

আমার কাছে সবচেয়ে নমনীয় দোষ  …………..   সহজ বিশ্বাস প্রবনতা।

আমার কাছে সবচেয়ে ঘৃন্য দোষ ………….. দাস মনোভাব।

আমার কাছে যা অরুচিকর  ………….. মার্টিন ট্যপার।

প্রিয় কাজ    ………….. গ্রন্থকীট বৃত্তি।

প্রিয় কবি ব    ……………    সেক্সপীয়ার, ইস্কাইলস, গ্যায়টে।

প্রিয় গদ্য লেখক  ……………    দিদেরো।

[উৎসঃ “মার্কস -এংগেলস স্মৃতি”, প্রগতি প্রকাশক পৃ: ২৫৪]

এই স্বীকারোক্তিটি অকপট সত্য নাকি খামখেয়ালী কিছু কথা এ নিয়ে আজো মার্কসবাদী ফেমিনিস্টদের মধ্যে তর্ক অব্যাহত আছে!

মার্কস পাঠের সঠিক পদ্ধতিটি কী?

মার্কসের জীবন ও চারিত্র্য বৈশিষ্ট্যের সংক্ষিপ্ত বিবরণের পর আমি আবার আমাদের মূল প্রশ্নে ফিরে যেতে চাই “কেন মার্কস পড়বো?” আগেই উল্লেখ করেছি যে মার্কসবাদীদের জন্য  মার্কস অবশ্য পাঠ্য কারণ তারা এই ভাবাদর্শে বিশ্বাসী। কিন্তু মার্কস নিজে কখনোই  ”মার্কসবাদী” ছিলেন না, ছিলেন ভয়ংকর ভাবে শুদ্ধতাবাদী, যে কোন লেখা প্রকাশের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মার্কস সর্বশেষ তথ্যের জন্য অপেক্ষা করে থাকতেন, যাঁচাই করতেন সর্বশেষ তথ্য তাঁর বক্তল্যকে সমর্থন করে কিনা। মার্কস “আত্মপরায়ন” বা নিজের “ভাবাদর্শে” নিজেই মোহিত কোন “নার্সিসাস” বক্তি ছিলেন না। তিনি ছিলেন খুবই “দ্বা›িদ্বক” ও ”সংশয়ী” মনোভাবের লোক এবং নিজে দ্বা›িদ্বক ভাবে সবকিছু পড়তেন এবং আশা করতেন অন্য সবাই দ্বা›িদ্বক ভাবেই তাকে পাঠ করবেন। তিনি নিজে যেমন গভীর মনোযোগসহ “হেগেলকে” পাঠ করেছিলেন এবং সেই পাঠের নাম দিয়েছিলেন “দ্বান্দ্বিকভাবে বা সমালোচনামূলক ভাবে” হেগেলের পাঠ”। পাঠকের মনে প্রশ্ন উঠতে পারে দ্বান্দ্বিক পাঠটি কি রকম?

“দ্বান্দ্বিক পাঠের” প্রথম শর্ত হোল যা বা যেই বিষয়ে আমরা পাঠ করছি তার যতগুলি দিক (aspects) আছে, বিশেষতঃ সে সম্পর্কে যত পরস্পর বিরোধী বক্তব্য বা মত আছে, সবগুলিকে পাশাপাশি বিবেচনায় নিয়ে তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে সত্যে উপনীত হওয়ার বা জন্য পঠন-পাঠন পরিচালনা। যদিও এ কাজটি কখোনোই শেষ হবে না! অর্থাৎ সর্বদা  মনকে মুক্ত করে পাঠ। সুতরাং দ্বান্দ্বিক পাঠের উদ্দেশ্য কোন পূর্বনির্ধারিত পবিত্র ধর্মীয় বিশ্বাস বা কোন “cut and dried truth” আয়ত্ত¡ করা, মুখস্থ করা বা বিশ্বাস করা নয়। এই পাঠের উদ্দেশ্য হচ্ছে পাঠ্য বিষয়ের সারমর্ম ( Essence)  এবং সারমর্মের চলমান অসীম বহুমুখী প্রকাশ ( Appearance)   উভয়কে অনুধাবন করে গতিশীল সত্যকে নিরন্তর অনুধাবন করা।

পাঠ্য বিষয়ের কোন অংশ কোন স্থান-কাল-পত্রের ক্ষেত্রে সত্য রূপে প্রতিষ্ঠিত, এবং কোথায় ও কখন তা কার্যকরী করা যায় বা প্রতিষ্ঠিত করা যায় বা কোথায় কখন তা মিথ্যায় পরিণত হবে সেটাই নিরন্তর যাঁচাই করে পাঠ অব্যাহত রাখাই হচ্ছে দ্বান্দ্বিক পাঠ। মার্কস প্রায়ই তাই তাঁর প্রিয় কবি গ্যেটের একটি বক্তব্য তুলে ধরতে  ভালবাসতেন। বক্তব্যটি সংক্ষেপে  হচ্ছে, ‘জীবনের বৃক্ষ সর্বাদাই চির সবুজ

কিন্তু চিন্তা সবসময় ধুসর’।

তার সবচেয়ে অন্তরংগ বন্ধু এংগেলসের অত্যন্ত বিখ্যাত একটি উক্তি হচ্ছে, “Nothing is eternal but eternally changing.” ( “ কোন কিছুই চিরন্তন নয়, কিন্তু সবই চির পারবর্তনশীল”-দেখুন এংগেলস , Dialectics of Nature, Moscow, 1961, P=40)

অর্থাৎ জীবন সবসময় চিন্তাকে অতিক্রম করে এগিয়ে যাবে। তাই সব চিন্তাই কোন না কোন সময় ধুসর হয়ে কালের গর্ভে লীন হয়ে যাবে। সুতরাং আমরা প্রথম যে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি তা হচ্ছে মার্কস আমাদেরকে তাঁর লেখাগুলিকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে বিজ্ঞানের মত পড়তে বলেছেন। আমরা যেমন Physics পড়ি পদার্থ সম্পর্কে ক্রমবিকাশমান জ্ঞানকে গভীর থেকে গভীরতর ভাবে জানার জন্য, সে জন্য যেমন আমরা নিউনকেও পড়ি, আইনষ্টাইনকেও পড়ি, কোয়ান্টম মোকনিক্সও পড়ি তেমনি মার্কস প্রণীত বিজ্ঞানকে ক্রমবিকাশমান জ্ঞানের একটি শাখা হিসাবে Thesis -Antithesis -Synthesis এই পদ্ধতিতে আমাদের পাঠ করতে হবে।

মার্কসের একটি বিখ্যাত বক্তব্য হচ্ছে “এ যাবৎ দার্শনিকেরা শুধু পৃথিবীকে ব্যাখ্যা করে গেছে, আসল বিষয় হচ্ছে পৃথিবীকে বদলে দেয়া।” (দেখুন ঞযবংরং ড়হ ঋবঁৎনধপয এর শেষ ১১ নম্বর থিসিসটি!) এই দিক থেকে দেখলে মার্কসের লেখাগুলি পড়া উচিৎ সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি এবং মানব সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়কে সঠিকভাবে শুধু ব্যাখ্যার জন্য নয় ব্যাখ্যাগুলিকে কাজে লাগিয়ে মানবকল্যাণের জন্য মানুষের প্রয়োজন অনুযায়ি কাজ করার জন্যও বটে। যদি দেখা যায় অনুশীলনমূলক যাঁচাই মাকর্সের সূত্রকে ভ্রান্ত বা অকল্যানকর প্রমাণিত করেছে, তাহলে মার্কসের পরামর্শটি হবে মার্কসকে ত্যাগ করা।

যতটুকু অংশ ভুল বা সেকেলে হয়ে গেছে ততটুকু বাদ দিয়ে নতুন তত্তে¡র সৃজনশীল বিকাশের মাধ্যমে আরো সামনে এগিয়ে নিয়ে গেলেই মার্কস ঠিক মত পাঠ করা সম্ভব হবে। আমরাও তখন দাবী করতে পারবো মার্কসকে আমরা মার্কসের পন্থাতেই পাঠ করেছি। এই প্রসংগে দুটি ঐতিহাসিক তথ্য তুলে ধরতে চাই। ১৮৮৩ সালে কার্ল মার্কস যখন জীবিত ছিলেন তখন মার্কসের ভক্তরা তার ঐতিহাসিক বস্তুবাদের অর্থনৈতিক কার্যাকরণকে হেগেলের “চরম ধারণার”(Absolute Idea) মত “চরম” ভেবে যত্র তত্র তার ভুল প্রয়োগ শুরু করেন। আনাড়িদের হাতে পরে তাঁর তত্তে¡র এই দুদর্শা দেখে তখন মার্কস নিজেই বলেছিলেন,

“What is certain is that, I myself am not a Marxist”

[দেখুনEngel’s letter to Conrad Schmidt (1890), Marx-Engels Selected Correspondence, Progress Publishers, Moscow. P-393]

দ্বিতীয় তথ্যটি বিখ্যাত সৃজনশীল মার্কসীয় তাত্তি¡ক আন্তোনীয় গ্রামসীর একটি প্রবন্ধ থেকে নেয়া। গ্রামসী যখন দেখলেন ইউরোপের সবচেয়ে উন্নত দেশে বিপ্লব না হয়ে বিপ্লব শুরু হোল রাশিয়ার মত একটি মাঝারি ও অনুন্নত পুঁজিবাদী দেশে তখন তিনি লিখলেন পুঁজি গ্রন্থে পুঁজিবাদের উত্থান-বিকাশ-পতনের যে “স্বাভাবিক ঐতিহাসিক”  (Natural-Historical) নিয়মের বিবরণ আছে তাকে লংঘন করেই রাশিয়াতে বিপ্লব হয়েছে। সুতরাং অক্টোবর বিপ্লবকে “Anti Capital” বিপ্লব বলে আখ্যায়িত করে তিনি মার্কসবাদের সারমর্মকে অক্ষুন্ন রেখে নতুন ঘটনার নতুন ব্যাখ্যা করলেন। দাবী করলেন লেনিনের নতুন রনকৌশলই নতুন পরিস্থিতিতে মার্কসের বক্তব্যের ভিন্ন কিন্তু সারমর্মের দিক থেকে সঠিক প্রয়োগ।

–পরবর্তী পর্ব ছাপানো হবে ১০ জুন ২০২১, বৃহস্পতিবার

(লেখকঃ রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, শিক্ষক ও গবেষক)