মতামত

কেন মার্কস পড়বো ? (১ম পর্ব)

এম . এম . আকাশ

মার্কসের জবাব

“কেন মার্কস পড়বো”- এই প্রশ্নের উত্তর আত্নবিশ্বাসী মার্কবাদীদের জন্য খুবই সোজা সাপটা সরল (Simple)। তারা অনায়াসে বলবেন “আমি যেহেতু কমিউনিস্ট তাই মার্কসবাদী মতাদর্শে বিশ্বাসী এবং সে জন্য মার্কসবাদ অধ্যয়ন করা আমার জন্য কর্তব্য।”

কিন্তু আমরা যদি কোনভাবে আজ মার্কসকে কবর থেকে উঠিয়ে জিজ্ঞাসা করতে পারতাম, “কেন তোমার বই আমরা দেড়শত বছর পরেও পড়বো তা বলবে কি?” তাহলে তিনি কি এত সহজে এই ধরণের একটি সরল উত্তর দিতে পারতেন না। যেমন ধরুন-: মার্কস কি নিজেও একজন ”মার্কসবাদী” ছিলেন? এই লেখায় বহু আগে মার্কস যখন জীবিত ছিলেন তখনকার একটা সত্য ঘটনা উল্লেখ করে এই কাল্পনিক প্রশ্নের এবং প্রাসংগিক অন্যান্য কয়েকটি বিষয়ের একটি যুক্তি গ্রাহ্য উত্তর দিতে চেষ্টা করবো।

মার্কসের ঝঞ্ঝাবিক্ষুদ্ধ জীবন

তার আগে মার্কসের অভিনব জীবন সম্পর্কে একটু আলোকপাত করা যাক। মার্কসের জন্ম ৫ই মে ১৮১৮ সালে। বাতাসে তখনো ফরাসী বিপ্লবের গন্ধ শুকায় নি! আর মৃত্যু ১৪ই মার্চ ১৮৮৩ সালে, যখন শিল্প বিপ্লব পুরোদমে চলছে। তিনি সাকুল্যে বেঁচেছিলেন মাত্র ৬৫ বছর। যখন তাঁর বয়স মাত্র ৫১ বছর তখন ১৮৬৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর মহা-গ্রন্থ “পুঁজি”-র ১ম খন্ড (জার্মান সংস্করন)। এই গ্রন্থের পুর্ণ শিরোনামটি হচ্ছে- “Capital: A critical Analysis of Capitalist Production.” পুঁজি গ্রন্থের ১ম খন্ড প্রকাশিত হয়েছিল মার্কস জীবিত থাকা অবস্থায়। তার পরবর্তী খন্ডগুলি (২ ও ৩)  প্রকাশিত হয় মার্কসের মৃত্যুর পর। সেগুলি সযত্নে সম্পাদনা করে প্রকাশ করেছিলেন মার্কসের অকৃত্রিম বন্ধু এঙ্গেলস। নানাধরণের গ্রন্থ ও বিপ্লবী কাজের ফাঁকে ফাঁকে মার্কস এর জীবনের অনেকটা সময় কেটেছিল দেশ -দেশান্তরী হয়ে, পুলিশের তাড়া খেতে খেতে এবং ছুটতে ছুটতে। তবে পুঁজি গ্রন্থ লেখার আগে স্থীর হয়ে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে বসে মার্কসকে অনেক অনেক পড়াশুনা করতে হয়েছে। ১৮৪১ সালে মাত্র ২৩ বছর বয়সে মার্কস বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করে তার আনুষ্ঠানিক ছাত্রত্ব শেষ করেন। বিশ্ববিদ্যালয় পড়া শেষ করে তিনি জার্মানীর বন শহরে এসেছিলেন অধ্যাপক হওয়ার আশায়। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তখন মার্কসকে তরুণদের মাথা খাওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক পদে গ্রহণ করতে রাজী হন নি। তখন আরো যেসব র‌্যাডিকেল হেগেলবাদী অধ্যাপক বন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কৃত হন তাদের সংগে জোট বেঁধে মার্কস একটি সরকার বিরোধী পত্রিকা প্রকাশ করতে শুরু করেন। মার্কস তখন ধীরে ধীরে গুরু হেগেলের ভাববাদকে ত্যাগ করে ফয়েরবাখের বস্তুবাদকে গ্রহণ করতে শুরু করেন । ফরাসী সমাজতান্ত্রিক সাহিত্য ও চিরায়াত ব্রিটিশ অর্থশাস্ত্রও তাঁকে আকৃষ্ট করে।

তখন মার্কস ও তাঁর তরুন বন্ধুদের ”রেডিকেল হেগেলিয়ান” হিসাবে চিহিৃত করা হোত। হেগেলের ভাববাদ ত্যাগ করলেও তার দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিকে তিনি উচ্চ প্রশংসাসহ গ্রহণ করেন। অন্যদিকে ফয়েরবাখের বস্তুবাদকে প্রথমে উৎসাহের সংগে গ্রহণ করলেও পরে এর যান্ত্রিক অধিবিদ্যক (Metaphysical) বৈশিষ্ট্যকে তিনি প্রত্যাখান করেন। কেউ যদি মার্কসের এই দ্বান্দিক ভাববাদ থেকে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদে রূপান্তরের বৈশিষ্ট্যটি  ঠিক মত বুঝতে চান তাহলে তাকে পড়তে হবে ১৮৪৫ সালে মার্কসের খুবই সংক্ষিপ্ত কিন্তু সুবিখ্যাত একটি খসড়া-নোট যেটি তিনি নিজে প্রকাশও করেন নি এবং ভেবেছিলেন পরে কোন সময় বিস্তৃত ও স্পষ্ট করে এর ব্যাখ্যা করবেন। কিন্তু ১৮৪৫ সালে লেখা মার্কসের একটি নোট বইয়ে সেটা পেয়ে তার বন্ধু এঙ্গেলস মার্কসের মৃত্যুর পর তা  প্রকাশ করে গেছেন। এর যুগান্তবারী গুরুত্ব উপলব্ধি করে এঙ্গেলস পুস্তিকাটির প্রারম্ভিক টীকায় লিখেছিলেন,

Hurriedly scribbled down for later elaboration, absolutely not intended for publication, but they are invaluable as the first document in which is deposited the brilliant germ of the new world outlook.” ( দ্রুত হিজিবিজি করে লেখা একটি রচনা, যা অবশ্যই কোনক্রমেই প্রকাশের উদ্দেশ্যে লিখিত হয় নি, কিন্তু যা হচ্ছে অমুল্য এবং যেখানে সঞ্চিত আছে নতুন বিশ্বদৃষ্টিভংগীর প্রতিভাদীপ্ত এক অংকুর।”

(এফ. এঙ্গেলস (১৮৮৮),লুদভিগ ফয়েরবাখ ও চিরায়াত জার্মান দর্শনের সমাপ্তি (১ম জার্মান সংস্করন) গ্রন্থের ভুমিকা দ্রঃ)

মার্কসের ঝঞ্ঝাবিক্ষুদ্ধ প্রবাসী শরনার্থী বিপ্লবী জীবন নিয়ে অনেকগুলি বই আছে। তার মধ্যে আমার পড়া অন্যতম শ্রেষ্ঠ বই মনে হয়েছে দুটিকে। একটি ব্রিটিশ সাংবাদিক ফ্রান্সিস হুইন (Framcis Wheen) লিখিত একাধিক পুরস্কার প্রাপ্ত গ্রন্থ ”কার্ল মার্কস: এ লাইফ”, নর্টন এন্ড কোঃ, ইংল্যান্ড, জুলাই , ২০০১। আরেকটি  প্রগতি প্রকাশন থেকে প্রকাশিত “মার্কস-এঙ্গেলস স্মৃতি”। মার্কস-এঙ্গেলসের সমসাময়িক ১৩ জন লেখক এবং মার্কসের তত্ত্বের অন্যতম সফল রূপকার রুশ বলশেভিক নেতা লেনিন এই চমৎকার বইটিতে মার্কস-এংগেলস এই দুই হরিহর আত্না বন্ধুর জীবন নিয়ে অনেক গুরুত্ত্বপুর্ন ও মজার মজার স্মৃতিচারন করেছেন। এ বইটি থেকে আমরা বুঝতে পারবো যে মার্কস একজন নিরামিষ তাত্ত্বিক ছিলেন না, ছিলেন বিপ্লবী রক্তমাংসের মানুষ এবং আরো জানতে পারবো কি বিপুল পড়াশুনা ও স্বার্থত্যাগ করতে হয়েছিল তাঁকে। এমনকি কখনো কখনো একদিকে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে পুঁজি গ্রন্থ লেখার জন্য মার্কস দিনের পর দিন পড়াশুনা করছেন অন্যদিকে খাদ্যাভাবে বা চিকিৎসার অভাবে তার পুত্র-কন্যারা মৃত্যুও বরন করেছেন। তাঁকে বিদেশী সম্পাদকের তাগাদায় মূল কাজ বাদ দিয়ে খুচরা লেখাও লিখতে হয়েছে অনেক। নিউয়র্ক  ট্রীবিউন পত্রিকায় প্রকাশিত এই লেখাগুলিকে মার্কস বলেছিলেন “হাতের ময়লা” (“Muck”)- কিন্তু বিশ্ব সাহিত্যে “ভারতের” উপর তার এ ধরণের দুটি লেখা আজো সর্বত্র Indologist-রা অত্যন্ত যত্ন সহকারে পাঠ করেন। “এশিয়াটিক সমাজ” সংক্রান্ত মার্কসের এই অভিনব ধারণার বিবর্তন নিয়ে ডঃ আবুল বারাকাত ও আমার একটি প্রবন্ধও আছে। আগ্রহী পাঠকেরা তার হদিস পাবেন প্যাপিরাস থেকে প্রকাশিত এম.এম. আকাশ, “বাংলাদেশের অর্থনীতি–অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত” গ্রন্থে।

 

যেই পুঁজি গ্রন্থটি মার্কসের “ম্যাগনাম ওপাস” হিসাবে পরিচিত সেই গ্রন্থটি সম্পর্কে স্মৃতিচরন করতে গিয়ে জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্যাটিক পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ভিল হেলম্ লিবক্লেখট (১৮২৬-১৯০০), লিখেছেন,

“পুঁজি বইটি লিখতে গিয়ে মার্কসকে চল্লিশ বছর পরিশ্রম করতে হয়েছিল, আর সে এমনই পরিশ্রম যা ছিল একমাত্র মার্কসেরই সাধ্য। আমি যদি একথা বলি তাহলে বোধ হয় বাড়িয়ে বলা হবে না যে, জার্মানীতে সবচেয়ে কম মজুরির দিন মজুর ঐ চল্লিশ বছরে মোট যে-পরিমাণ মাইনে পেয়েছিলেন, তা লেখার পারিশ্রমিক বা শতাব্দীর এই সর্বশ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক সৃষ্টির জন্য সমাজের কাছ থেকে ঋণ পরিশোধ বাবদ মার্কস যা পেয়েছিলেন তার চেয়ে বেশী ছিল।”  (দেখুন প্রগতি প্রকাশিত “মার্কস-এংগেলস স্মৃতি, পৃ: ৮৮)

(লেখকঃ রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, শিক্ষক ও গবেষক)

চলবে–