বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (৩১)

– বিজন সাহা

গণিতে একটা কথা আছে, কোন প্রলেমের সঠিক স্টেটমেন্ট সমস্যার অর্ধেক সমাধান। সঠিক স্টেটমেন্ট কি? এর অর্থ যখন আমরা সমস্যা কি সেটা ঠিক বুঝতে পারি। যেকোনো সমস্যা ঠিকমত প্রকাশ করার জন্য সেটা সঠিক ভাবে বুঝতে হয়। আর শুধু মাত্র সঠিক ভাবে বুঝলেই কোন সমস্যা সমাধানের কথা ভাবা যায়।     চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বললে সঠিক স্টেটমেন্ট মানে রোগের সঠিক ডায়াগনোসিস করা, কারণ এর উপরেই নির্ভর করে রোগের চিকিৎসা কোন দিকে যাবে।

একই কথা বলা যায় জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে। জ্ঞান হল জানা। কীভাবে আমরা কোন কিছু জানতে পারি? শিক্ষার মাধ্যমে, অর্থাৎ জানার জন্য দরকার শিক্ষা। কি শিক্ষা? এই শিক্ষার উপরই নির্ভর করে আমরা কি জ্ঞান লাভ করব। শিক্ষা বলতে কেউ ভাবতে পারে ইতিমধ্যে জানা জিনিস মুখস্ত করা যা আমাদের স্কুলে শেখানো হয়। আবার কারও জন্য শিক্ষা মানে পূর্বের জ্ঞান শুধু মুখস্ত করাই নয় সেটা বোঝা। আবার শিক্ষা বলতে কেউ বোঝে লব্ধ জ্ঞানের ভিত্তিতে নতুন নতুন প্রশ্ন করে নতুন জ্ঞান আহরণ করা। তার মানে দাঁড়াচ্ছে শিক্ষা বিভিন্ন রকম হতে পারে আর সেটা নির্ভর করে যে শেখে তার আর যে শেখায় তার মোটিভেশনের উপর। আর এর উপর নির্ভর করে শিক্ষা শেষে কে কেমন বিশেষজ্ঞ হয়ে বেরুবে।

জ্ঞানকে আমরা প্রায়ই আলোর সাথে তুলনা করি। আলো কি? এটা একদিকে কণা, অন্য দিকে তরঙ্গ। আলো তরঙ্গের আঁকারে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সেই ঢেউ একটু একটু করে সামনের দিকে এগিয়ে যায় আর সেই সাথে অন্ধকার দূর করে নতুন নতুন জায়গা আলোকিত করে। জ্ঞানও তাই। জ্ঞান আমাদের মনকে আলোকিত করে। আলোক তরঙ্গ যেমন অন্ধকার দূর করে আরও আরও জায়গা আলোকিত করে   জ্ঞানের ফলে মনে যে প্রশ্নের উদ্রেক হয় তার উত্তর সেভাবেই আমাদের অজ্ঞতা দূর করে আমাদের জানার পরিধি বাড়ায়, আমাদের মনকে আরও আরও আলোকিত করে। কিন্তু বাতি নিবিয়ে দিলে যেমন একদা আলোকিত স্থান অন্ধকারে ঢেকে যায়, প্রশ্ন করা বাদ দিলে আমাদের মন তেমনি অজ্ঞানতার/ অজ্ঞতার অন্ধকারে ডুবে যায়। তাই বাতি যেমন আলোর উৎস, প্রশ্নও তেমনি জ্ঞানের উৎস।

মানুষ যখন কোন গ্রন্থের কথাই শেষ কথা বলে মনে করে আর শিক্ষা বলতে সেখানে যা লেখা আছে সেটা আয়ত্ব করার কথা বলে, জীবনে সেই শিক্ষাকে প্রয়োগের কথা বলে – তখন বুঝতে হবে সেই মানুষ নিজেকে একটা ছোট বলয়ে  আবদ্ধ করে রাখতে চায়। কিন্তু এই পরিবর্তনশীল মহাবিশ্বে অনবরত সব কিছু বদলাচ্ছে। যদি আমরা এই পরিবর্তনের সাথে তাল  মিলিয়ে চলতে না পারি তাহলে পিছিয়ে যেতে বাধ্য। আর এ জন্যেই বিজ্ঞান বলে লব্ধ জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে তাকে প্রশ্ন করার কথা, নতুন নতুন প্রশ্ন করে নতুন নতুন জ্ঞান অর্জন করার কথা, জ্ঞানের পরিধি বাড়ানোর কথা। কারণ একমাত্র তখনই আমরা সময়ের সাথে পা মিলিয়ে চলতে পারব, আমরা নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করতে পারব। “মহাবিশ্বে সব কিছু পরিবর্তনশীল” এটা যেন আমাদের জন্য কোন ডগমায় পরিণত না হয়, সেটা যেন হয় আমাদের কর্মের নির্দেশিকা।

কিন্তু আমরা কতটুকু প্রস্তুত সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে? ধর্মের কথা না হয় বাদই দিলাম, সেখানে ডগমার একচ্ছত্র আধিপত্য। সেখানে প্রশ্ন করার সুযোগ নেই। সেখানে শুধুই প্রশ্নাতীত আনুগত্য। কিন্তু সে সমস্ত মতবাদ যেখানে ঈশ্বর নয় মানুষই প্রধান – গনতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, পুঁজিবাদ, সাম্যবাদ – এসবও কি আজ ডগমায় পরিণত হচ্ছে না? এখানেও কি আমরা আদর্শের কাছে মানবতাকে বলি দিচ্ছি না? সাম্যবাদে আমরা সবার সমান অধিকারের কথা বলি, কিন্তু সেটা আমরা করতে চাই যান্ত্রিক ভাবে সবাইকে সমান করে। কিন্তু দুজন মানুষ যারা প্রাকৃতিক কারণেই একে অন্যের চেয়ে ভিন্ন তাদের কি কখনও সমান করা যায়? গণিতে লিমিট বলে একটা কথা আছে। সেখানে পৌঁছানোর চেষ্টা করা যায়, অনন্ত কাল ধরে অবিরাম সেই প্রচেষ্টা চালিয়ে গেলে তার কাছাকাছি পৌঁছানো যায়, কিন্তু আমাদের জীবদ্দশায় সেটা অসম্ভব। অবশ্যই আমাদের আইডিয়াল হবে শ্রেণিহীন সমাজ, যেখানে সবাই তার মেধা অনুযায়ী কাজ করবে আর পাবে তার প্রয়োজন অনুযায়ী। কিন্তু মনে রাখতে হবে সেজন্যে শুধু বিপ্লবই যথেষ্ট নয়, তৈরি করা দরকার সেই মানুষ যে সব লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে উঠতে পারবে। কিন্তু সেটা করতে হলে আমাদের প্রথমত মানবিক হতে হবে।

গণতন্ত্রের মুল লক্ষ্য যেমন সবার নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করা, সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য সম্পদের সুষম বন্টন। কিন্তু সুষম বলতে আমরা কী বুঝি? শুধুমাত্র দেশের নাগরিক বলেই সম্পদে সমান অধিকার নাকি কে কতটুকু পাবে সেটা হবে মানুষের শ্রমের ভিত্তিতে? যদি মানুষ তার শ্রমের সঠিক মুল্য না পায় সেটা হবে শ্রমের, শ্রমিকের অবমাননা। আর সমাজতন্ত্রের মূল কথাই তো হল শ্রমিক তথা শ্রমের সঠিক মূল্যায়ন। একজন শ্রমিক যে উৎপাদন খাতে জড়িত, একজন শিক্ষক যে ভবিষ্যৎ নাগরিক গড়ে আবার একজন সৈনিক যে শত্রুর হাত থেকে দেশ রক্ষা করে তাদের শ্রম তো বিভিন্ন ধরণের যদিও কোনটার গুরুত্বই কম নয়। আবার তাদের জীবনধারণের পরিবেশ ভিন্ন, চাহিদা ভিন্ন। তাই যতই শ্রেণিহীন সমাজের কথা বলি না কেন শ্রমের ভিন্নতায় মানুষ চরিত্রগত ভাবে ভিন্ন হবে সেটাই স্বাভাবিক। আর এই স্বাভাবিকতা মাথায় রেখেই সম্পদের বন্টনের বা বেতনের কথা ভাবতে হবে। আরও একটা কথা মনে রাখতে হবে জীবনে যারা সফল তারা সবাই অসৎ নয়, তাদের অধিকাংশই প্রচণ্ড কর্মঠ, ভীষণ রকম উদ্যোগী। বাইরের দুর্গন্ধ থেকে  রক্ষা পেতে জানালা বন্ধ করলে শুধু দুর্গন্ধই নয় ঘরে অক্সিজেন পরিমাণও কমে যায়। তাই বাছ বিচার না করে সব ধনীদের শত্রু বলে ঘোষণা করলে অনেক উদ্যোগী, কর্মঠ, সমাজের উন্নতির জন্য অপরিহার্য অনেক মানুষও সেই দলে পড়ে যায়। এ সব সরলীকরণ সোভিয়েত সমাজে অনেক নেতিবাচক ঘটনাবলীর জন্ম দিয়েছিল। আর সে জন্যেই পার্টির অনেক নীতিমালা নতুন করে বিবেচনা করতে হবে।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা
শিক্ষক, পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো