বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (২২)

– বিজন সাহা

আমি রাশিয়ায় আসি ১৯৮৩ সালে আর ১৯৮৬ সালে থেওরেটিক্যাল ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে যোগ দেই। এর পর থেকে এখনও পর্যন্ত আমার মেলামেশা মূলত ফিজিসিস্ট আর ম্যাথেম্যাটেশিয়ানদের সাথে। এই লোকগুলো একেবারে ভিন গ্রহের বাসিন্দা, যারা টাকাপয়সা থেকে অঙ্কের সমীকরণ নিয়েই নিজেদের ব্যস্ত রাখতে ভালবাসে, আর এই ভার্চুয়াল রিয়্যালিটির মধ্যেই কাটিয়ে দেয় জীবন। আর্থিক মাপকাঠিতে এদের অধিকাংশই সর্বহারার খুব কাছাকাছি, কিন্তু তারা সর্বহারা নয়, হতে পারবেও না। এরা বেঁচেই থাকে সব ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করার জন্য। ধর্মের মূল কথা যেখানে অন্ধ বিশ্বাস, বিজ্ঞানের চালিকা শক্তি সেখানে অবিশ্বাস, সন্দেহ। এখনও পর্যন্ত যে সব দেশে সমাজতন্ত্র কায়েম হয়েছিলো বা হয়েছে – সেখানেই মার্ক্সবাদ লেনিনবাদকে প্রশ্নাতীত করার চেষ্টা চলেছে, এটাকে ধর্মের মতই ডগমায় পরিণত করা হয়েছে। যে বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণের উপর ভিত্তি করে মার্ক্সবাদ গড়ে উঠেছিল সেই মার্ক্সবাদকে প্রশ্নাতীত করে তার ভেতর থেকে বিজ্ঞানকেই বিতাড়িত করা হয়েছে। এটাও মনে হয় সোভিয়েত সিস্টেম পতনের অনেকগুলো কারণের একটা।

দু সপ্তাহ আগের লেখায় সোভিয়েত জনগণের সুপ্ত অসন্তোষের বিভিন্ন কারণ নিয়ে লিখেছি, গত সপ্তাহের লেখার শুরুতেও সেটা এসেছে। সুপ্ত এ জন্যেই যে অনেকে সেটা নিজেরাও বুঝত না। এটা অনেকটা সংসারের মত, ছোটোখাটো বিভিন্ন ব্যাপারে অসন্তোষ সৃষ্টি হলেও সেটাকে আমরা গুরুত্ব দেই না। কোন কিছু বদলানোর চেষ্টা না করেই আমরা দিনের পর দিন, বছরের পর বছর কাটিয়ে দিই। এভাবে যখন ক্ষোভ জমতে শুরু করে, একদিন সেটা বেরিয়ে আসে। তখন হয় আমরা নিজেরাই সব কিছু ভাঙ্গতে শুরু করি অথবা কেউ ভাঙ্গতে শুরু করলে দূরে দাঁড়িয়ে দেখি, রক্ষা করার কোন তাগিদ অনুভব করি না। পেছন দিকে ফিরে তাকালে এমনকি নিজেদের জীবনেও তার অনেক প্রমাণ পাই। আমার তো মনে হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন সারা পৃথিবীকে সমাজতন্ত্রের পজিটিভ দিকটা বিলিয়ে দিয়েছে আর নিজেরা সমুদ্র মন্থন থেকে উত্থিত বিষ পান করে হয়েছে নীলকণ্ঠ। আমারা যারা সোভিয়েত ইউনিয়নে পড়াশুনা করেছি তারা সব অর্থেই ছিলাম ভাগ্যবান। পড়াশুনা করার আদর্শ অবস্থা ছিল, ছিলেন শিক্ষকেরা যারা প্রাণ খুলে ছাত্রদের পড়াতেন। আমাদের স্টাইপেণ্ড ছিল কমবেশি সুন্দর ছাত্রজীবন যাপন করার মত। ছিলনা সেশনজট। এক কথায় সমাজতন্ত্রের ভাল জিনিসগুলো আমরা উপভোগ করেছি কোন রকম দায়িত্ব ছাড়াই। একই ভাবে দেশে দেশে প্রগতিশীল আন্দোলনকে সমর্থন করতে গিয়ে দিনের শেষে এদেশের জনগণই কষ্ট স্বীকার করেছে। একটু অপ্রাসঙ্গিক হল এখানে একটা ঘটনার উল্লেখ করছি তখন আমরা বিদেশীরা কি রকম সুবিধা ভোগ করতাম সেটা বুঝতে। অপেক্ষাকৃত বেশি স্টাইপেণ্ড ছাড়াও অনেক ক্ষেত্রেই আমরা সোভিয়েত ছেলেমেয়েদের চেয়ে বেশি সুবিধা পেতাম। সেটাই বলছি। ১৯৮৯ সাল। জুনে আমাদের মাস্টার্স থিসিস ডিফেণ্ড করতে হবে। এর আগে ছিল ফিলসফিতে স্টেট এক্সামিন। আমার অনার্স সহ মাস্টার্স শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু ফিলসফির সেই পরীক্ষায় আমি আর আমার সোভিয়েত রুমমেট ঝেনিয়া চার পেয়ে সেই সুযোগ হারালাম। পরের দিন আমাদের সিনিয়র টিচার কুজনেৎসভ এলেন আমার রুমে।
– ফ্যাকাল্টির ডীন আনিকিন তোমাকে দেখা করতে বলেছেন।
– কী ব্যাপার?
– সেটা জানি না। যত দ্রুত পার দেখা কর।

পরের দিন ওনার রুমে ঢুকতেই বললেন
– তুমি এমন কাজ করবে সেটা আমি কোন দিনও কল্পনা করতে পারিনি।

আনিকিন আমাদের রেডিও ফিজিক্সের ক্লাস নিতেন। কতবার যে আমাকে বলেছেন থিওরেটিক্যাল ফিজিক্স থেকে ওনার ওখানে চলে যেতে! খুব আদর করতেন।
– আমি আপনাকে ঠিক বুঝতে পারছি না।
– বোঝার দরকার নেই। প্রস্তুতি নাও। দুদিন পরে তোমাকে ফিলসফি পরীক্ষায় আবার বসতে হবে।
– আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে।

আমি নিজেও নিজের কথা শুনে যেন কেঁপে উঠেছিলাম। নিজেই জানি না কেন বলেছিলাম। কিন্তু কেন যেন মনে হল কাজটা ঠিক হচ্ছে না। আমি অন্যায় ভাবে সুযোগটা পাচ্ছি। একজন ছাত্র এই অবস্থায় আবার শর্ত দিচ্ছে এটা ছিল এদের কাছে অকল্পনীয়। পাওয়ারফুল চশমার ভেতর দিয়ে যেন তাঁর চোখ নয় আগুনের গোলা আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। অনেকক্ষণ আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে উনি বললেন
– কী শর্ত?
– যদি ঝেনিয়া রাজভোদভকে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেন শুধু সেক্ষেত্রেই আমি পরীক্ষায় বসব।
– ঝেনিয়া সোভিয়েত নাগরিক। কমসোমলের সদস্য। তুমি বুঝতে পারছ এটা কি রকম অসম্ভব একটা দাবী?
– সেটা আমি জানি। কিন্তু ওকে সুযোগ না দিলে আমার অনার্সের কোন মূল্য থাকবে না, বন্ধুরা বলবে বিদেশী বলে আমি সুযোগ পেয়েছি। শুধু বন্ধুদের কাছে কেন, আমার কাছেও সেটার কোন মূল্য থাকবে না। জানি অনার্সের মূল্য অনেক, কিন্তু এভাবে সেটা আমার প্রয়োজন নেই। আপনি আমাদের দু’ জনকেই সুযোগ দিন, পরীক্ষা দিয়ে যে মার্ক পাব সেটাই মেনে নেব।
– ঠিক আছে। ওকেও প্রস্তুতি নিতে বল।

রাতে যখন ঝেনিয়াকে সেটা জানালাম, শুধু ও নয়, আমাদের ইয়ারের সব সোভিয়েত বন্ধুরা আমাকে ধন্যবাদ জানিয়েছিল। এটা ছোট্ট একটা উদাহরণ, যখন আমাদের চেয়ে খারাপ তো নয়ই ভাল ছাত্ররাও শুধু সোভিয়েত বলে এমন সুযোগ থেকে বঞ্চিত হত।

আমার কেন যেন মনে হয় সাম্যবাদের ব্যাপারটা আমরা খুব আক্ষরিক অর্থে গ্রহন করেছি। এই ধরুন আমার গ্রাম। সেখানে শিক্ষক ছিল, উকিল ছিল, ব্যবসায়ী ছিল, বামুন, পুরুত, মোল্লা, নাপিত, ধোপা, তাঁতি, কৃষক সব ছিল। সব মিলিয়েই ছিল সুখী সমৃদ্ধ গ্রাম। যদি ওখানে শুধু শিক্ষক বা ব্যবসায়ী থাকত, অথবা নাপিত বা কৃষক – গ্রাম কী স্বয়ং সম্পূর্ণ হত? মোটেই না। জীবনের প্রয়োজনে হাজার হাজার বছরের অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করেই কাজের এই বিভাগ হয়েছে আর এই বিভাগই পরে শ্রেণির জন্ম দিয়েছে। কখনও বা কোন কোন উদ্দেশ্যে এই শ্রেণিগুলো একত্রিত হয়, আবার কখনও বা বিভাজিত হয়। বাইরের শত্রুর আক্রমণ থেকে বাঁচতে সবাই এককাট্টা হই, আবার সেটা কেটে গেলে নিজেদের স্বার্থে একে অন্যের সাথে প্রতিযোগিতায় নামি। আর এই প্রতিযোগিতাই আমাদের সামনের দিকে নিয়ে যায়। আচ্ছা ভাবুন, অলিম্পিকে শুধু ট্রায়াল হচ্ছে, যেখানে সবার উদ্দেশ্য থাকে প্রথম চারজনের মধ্যে থাকা যাতে পরবর্তী রাউন্ডে খেলা যায়। তখন কি সবাই সর্বশক্তি দিয়ে মাঠে নামে, বিশেষ করে যারা সত্যিকারের চ্যাম্পিয়ন? নামে না। কিন্তু যখন ফাইনাল হয় সেখানে সবাই আপ্রাণ চেষ্টা করে সোনা জিততে। এটা আমাদের মজ্জাগত। আর তাই যদি হয় তবে সবাইকে কি সমান করা যাবে? যেটা করা দরকার সেটা হল সবার জন্য সমান সুযোগের ব্যবস্থা করা। সোভিয়েত ইউনিয়ন সেটা করতে পেরেছিল। একই এলাকার প্রায় সমস্ত বাচ্চারাই (যদি জনগনের শত্রু বলে পরিচিত মানুষদের ছেলেমেয়েদের বাদ দেয়া যায়, যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঐ ছেলেমেয়েকে আলাদা করে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় তাদের লালনপালন করা হত বলে শুনেছি) একই ধরণের সুযোগ সুবিধা পেত। যার ফলে অতি অল্প সময়ে অনেক নামকরা বিজ্ঞানী, শিল্পী, সাহিত্যিক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বেরিয়ে আসে সাধারণ মানুষের মধ্য থেকে। আমার মনে হয় এখানেই সাম্যের একটা লাগাম টানার দরকার ছিল। কেন না পরবর্তীতে যখন একজন ডাক্তার আর একজন সাধারণ শ্রমিকের বেতন এক হয়ে গেল, তখনই দেখা গেল এক ধরণের অসন্তোষ। একজন শ্রমিক যেখানে ৯ টা ৫ টা কাজ করে বাকী সময় নিজেকে দিতে পারে, একজন শিক্ষক তখন বাড়িতে বসে ছাত্রদের খাতা দেখে, লেকচার রেডি করে। একজন বিজ্ঞানী যতক্ষণ জেগে থাকে ততক্ষণই সমস্যা নিয়ে ভাবে। তাই মেকানিক্যালি সবাইকে সমান করতে গেলে সেটা ন্যায্য হয় না, সেটা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। তাছাড়া সবাইকে চাকরি দিতেই হবে এই নীতিমালার ফলে অনেক অযোগ্য লোকও কাজ পেত। এরা যতটা না কাজ করত তার চেয়ে বেশি অন্যদের কাজে অনুৎসাহিত করত। এসব লোকেরা বলতে গেলে কিছু না করে বেতন পেত, যা অনেকের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করত। শুধু তাই নয়, এসব লোকের অনেকেই পরনিন্দা পরচর্চার মাধ্যমে কালেক্টিভের পরিবেশ দূষিত করত। তাই আমার মনে হয় শ্রেণিহীন সমাজের শ্লোগান একটা ইউটোপীয় ব্যাপার। কেননা সুস্থ সমাজে বিভিন্ন পেশা থাকবে, বিভিন্ন পেশার দ্বন্দ্ব থাকবে। এই বৈপরিত্বের ঐক্য আর সংগ্রামের মধ্য দিয়েই সমাজ এগুবে সামনের দিকে। শ্রেণিই যদি না থাকে, সমাজের বিভিন্ন মানুষের মধ্যে যদি স্বার্থের দ্বন্দ্ব না থাকে তবে সমাজ এগুবে কিসের ভিত্তিতে? তাই শ্রেণিহীন সমাজ নয়, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির দ্বন্দ্বগুলোকে কিভাবে ননঅ্যানটাগনিষ্টিক করা যায় সেই ফর্মুলাই খুঁজতে হবে। আর এজন্যে দরকার রাষ্ট্রীয় ভাবে সবাই যাতে সমান সুযোগ পায় সেটা প্রদান করা, বিভিন্ন পেশার মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য কমিয়ে আনা আর কোন অবস্থাতেই যেন কোন শ্রেণির সম্পদ বা ক্ষমতা একটা ক্রিটিক্যাল মাত্রা না পেরিয়ে যায় সেটা বজায় রাখা। কেননা এক বার ভারসম্য নষ্ট হলেই ক্ষমতাশীলরা চায় তাদের ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করতে, আর অস্তিত্ব রক্ষার জন্য দুর্বলরা শুরু করে প্রতিবিপ্লবী ষড়যন্ত্র। গরবাচেভের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি এক সময় খুব জনপ্রিয় ছিল। তবে শান্তির জন্যে শক্তি দরকার। দুর্বল শান্তিতে থাকতে পারে না, তাকে শান্তিতে থাকতে দেয়া হয় না। শান্তিও লড়াই করেই অর্জন করতে হয়, লড়াই করেই রক্ষা করতে হয়।

বিভিন্ন দেশে ক্ষমতায় আসার পর কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর বিভিন্ন রকম অধঃপতন দেখা গেলেও যে কোন দেশের জন্যই এসব দলের গুরুত্ব অপরিসীম। এই অধঃপতন যতটা না আদর্শের কারণে তার চেয়ে বেশী ক্ষমতার নিজস্ব চরিত্রের কারণে। ক্ষমতা, বিশেষ করে অসীম ক্ষমতা মানুষের র‍্যাশনাল চিন্তাভাবনার পথে বাঁধা সৃষ্টি করে। তবে বিরোধী দল হিসেবে কমিউনিস্ট পার্টির জুড়ি নেই। বাংলাদেশ এখন সমাজিক অস্থিতিশীলতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দিন দিন আমরা আক্ষরিক অর্থেই দূরে সরে যাচ্ছি একাত্তর থেকে। ছাত্র ইউনিয়ন, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে সাপোর্টিভ ফোর্স হয়ে যে ভুমিকা পালন করতে পেরেছিল, স্বাধীন বাংলাদেশে আজ সেটা পারছে না। আর বাম দলগুলোর এই দুর্বলতাকে পুঁজি করে সাম্প্রদায়িক শক্তি রক্ত দিয়ে ছিনিয়ে আনা ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, সার্বভৌমত্ব – সব একটু একটু করে গ্রাস করে ফেলছে। অক্টোবর বিপ্লব থেকে শিক্ষা নিয়ে তাই নতুন করে শপথ নিতে হবে। ডগমা নয়, নতুন বাস্তবতায় নতুন করে দলের রণনীতি, রণকৌশল ঠিক করতে হবে। লড়াইটা আদর্শের জন্য হলেও বেলা শেষে লড়াইটা যেন মানুষের জন্য হয়, মানবতার জন্য হয়, দূষণমুক্ত পরিবেশের জন্য হয়।

লেনিন বলেছিলেন – কমিউনিজম – এটা সোভিয়েত ব্যবস্থা প্লাস বিদ্যুতায়ণ। আমার মনে হয় এর সাথে গণতন্ত্র, বাজার অর্থনীতি, মানবিকতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি যোগ করা একান্ত ভাবেই প্রয়োজন।

এবারের সংগ্রাম হোক শান্তির জন্য, মানবতার জন্য, প্রকৃতি ও মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য।

বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক, পরিবর্তনই হোক সমাজ পরিবর্তনের মহামন্ত্র।

 

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা
শিক্ষক, পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো