বিজ্ঞান প্রযুক্তি

পদার্থবিদ্যার জগৎ সংসার : মহাজাগতিক বিশ্বের আঁতুড়ঘর!

– শাহীন আকতার হামিদ

শাহীন আকতার হামিদ (ফাইল ফটো)

পাঁচ বছরের টুক্টুক, তার গোসল করার গামলাটিতে বসে চিৎকার করছে ইউরেকা ইউরেকা। আমি তার মাকে জিজ্ঞেস করলাম ঘটনা কি? মা বলল আমি টুকটুকের সাথে খেলছিলাম। খেলার ছলে তাকে আমি গল্প বলছিলাম। কানায় কানায় পূর্ণ একটি বাটিতে পানি নিয়ে তার প্লাস্টিকের হাঁসটি ছেড়ে আমরা ইউরেকা ইউরেকা খেলছিলাম।এখন দেখি সে তার গোসলের গামলাটিতে বসেই বলছে ‘ইউরেকা।’

ক্রীস্টাব্দের পূর্বের একজন বিজ্ঞানিকে স্মরণ করলাম। আর্কিমিডিস, যিনি দেখিয়েছিলেন বিজ্ঞানের বাস্তব খেলা। অংক, পদার্থবিদ্যা, কারিগরিবিদ্যা সব জায়গাতেই ছিল তার অবাধ বিচরণ। আর্কিমিডিসকে ছাড়া চিন্তা করা যায়না জ্যামিতির আঁকজোক।

রাজার সোনার মুকুটে রুপা দেয়া হয়েছে কিনা তাই নিয়ে কাজ আর্কিমিডিসের, বেড়িয়ে আসল আয়তন সম্পর্কে ধারণা। তিনিও টুকটুকের মত বাথটাবে বসে জন্ম দিয়েছিলেন একটি শব্দ ‘ইউরেকা।‘

আয়তন হল তিন মাত্রার জায়গা। আমরা এক হাজার লিটারকে বুঝাতে এক মিটারের তিন গুন মাত্রা বুঝি। আমরা মাত্রাগুলোকে সমন্বয় করে পেয়ে যাই বিভিন্ন আকৃতির, যেমন কোনটা গোল কোনটা চ্যাপ্টা, আবার কোনটার আকৃতি আঁকাবাকা। ছোট ছোট বিন্ধুগুলোকে সংহত করলেই বেরিয়ে আসে জায়গাটির

আকৃতি। একটি জায়গার বিন্ধুগুলোকে সংহত করতে আমরা ধরে নেই তিনটি দিক কে আর একটি চোংগের আকৃতিকে সংহত করতে আমরা সমন্বয় করি কোন ও দিকের। আর যদি আমরা এগিয়ে যাই গোলক কে মাপতে আমাদের দরকার বিভিন্ন কোনের মাপ। আমরা মানুষেরা হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগুচ্ছি তারকা খচিত মহা বিশ্বের দিকে।

আসুন আমরা আবার ফিরে যাই আয়তনে। আর্কিমিডিস আমাদের দিয়েছেন ‘পাই’ এর সংগা। এই পাই’ দিয়েই আমরা পেলাম দক্ষিণ গোলার্ধ উত্তর গোলার্ধ, পেয়ে গেলাম উপবৃত্তাকারের ভালবাসা। মহাকাশের ধারণা, তত্ত্ব, আবিস্কার সব আবর্তিত হতে থাকল ওই সেই তিন মত্রার বিশ্বকে ঘিরে। এরপর আমরা আরো যোগ করে চার মাত্রায় উন্নিত হয়েছি। আমরা এখন দলিয় তত্ত্ব(Group Theory-SU(10)) দিয়ে বের করে ফেলছি দশ মাত্রার জায়গা। মহাকাশ আমাদের হাতের মুঠোয়। আবার ফিরে যাই আর্কিমিডিসে, আমরা জানতে পারি ওজন ও ঘনত্ব সম্পর্কে।

ওজন আমাদের দিল মাধ্যাকর্ষণের ধারনা।নিউটনের আগে হয়ত অনেকেই ভেবেছিলেন মাধ্যাকর্ষণ শক্তি নিয়ে, কিন্ত আপেল পড়তে দেখেছিলেন কি, হয়ত দেখেছিলেন! পদার্থের উপর প্রকৃতির যে টান তা সহজ নয়। এই টানই আমাদের মহাকাশ ঘুরিয়ে আনছে। আর ঘনত্ব মাপতে না পারলে আমরা এগিয়ে যেতে পারতাম না বিজ্ঞানের নানা শাখায়। প্রতি একক আয়তনে কতটুকুন ভর আছে, এর চেয়ে মহান আবিষ্কার আর কি হতে পারে!

 

এরপর আমরা আলোকিত হয়েছি তরলে ভাসমান বস্তু নিয়ে। তরল দ্বারা শরীরের উপর সে প্রফুল্ল বল (buoyant force) দেয়া হয় তা আমাদের নিয়ে গেছে তরল গতিবিদ্যার কাছে। এই বিষয়টি দিয়ে আমদের কাছে দরজা খুলে গেছে কারিগরি বিদ্যার। কোন ভরের কত ঘনত্বের জিনিস পানিতে বাতাসে বা গ্যাসে ভাসবে তার বিদ্যা আমরা এখান থেকেই আহরণ করেছি।

সমতুল্যের সমতলের (On the Equilibrium of Planes) ধারনা আমরা পেয়েছি সূর্য্যের আলোর বিন্যাস মাপতে গিয়ে। ভর ঘনত্ব ও প্রফুল্ল বলের উপর নির্ভর করে আমরা যখন তর তর করে এগিয়ে যাচ্ছি জাহাজে করে পৃথিবী জয়ের পথে তখনি আমাদের তৈরি হয়ে গেল মানব জাতির সংঘাত এর ক্ষেত্র। এই যুদ্ধে জেতার জন্য আমাদের দরকার হল সূর্যের আলো। আমরা পেয়ে গেলাম আলোক বিদ্যার ধারণা। সমতুল্যের সমতলে আয়না বসিয়ে আমরা তৈরি করলাম অস্র, যা দিয়ে অতি সহজে আমরা ধ্বংস করে দিতে শিখলাম প্রতিপক্ষের জাহাজ। তাপ শক্তি আমাদের এগিয়ে নিয়ে আসল প্রতিদিনের জীবন যাপনে, আমরা সৌরশক্তিকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করছি বিদ্যুৎ।

আমরা আলোকবিদ্যার পরে এগিয়ে গেলাম তাপ বিদ্যার দিকে। এভাবে বলা যায় আলোক বিদ্যা ও তাপ বিদ্যা পরস্পরকে আঁকড়ে ধরে থাকল। সমতুল্যের সমতল নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আর্কিমিডিস বলেছিলেন ‘ আমাকে একটি জায়গা দাও যেখানে আমি শক্তভাবে দাঁড়াতে পারি দেখ আমি স্থির হয়ে থাকা পৃথিবীকে নাড়িয়ে দিব।‘ আমরা এসে দাড়ালাম শাস্ত্রীয় যান্ত্রীকতা (Classical Mechanics) যূগে। একি সাথে মহাকাশ বিদ্যা নিয়েও বসে নেই। শুরু হয়ে গেল পৃথিবী, সুর্য, ও আরো পাঁচটি গ্রহ নিয়ে চিন্তা ও তত্ত্ব দেয়া। মানুষ এগিয়ে গেল প্রকৃত বস্তুর গতি, যন্ত্রাংশ ও মহাকাশ নিয়ে গবেষণায়।

আমরা ফিরে আসছি কাঠামোগত বৈশিষ্টের কাছে। রেফারেন্স ফ্রেম দিয়েই আমরা এগিয়ে গেলাম গ্যালিলিও ও আইস্টাইনের কাছে। একটি কাঠামোর সমন্বয়কারী কারী মাত্রা ও তলের মধ্যে থেকেই পদার্থগুলো অবস্থান ও গতি নির্ণয় করতে সক্ষম হল পদার্থবিদগণ। স্থির কাঠাম, গতিশীল কাঠাম, গ্যালেলিও কাঠাম সব চিন্তা করেই পদার্থবিদগণন এগিতে চললেন। তারা এগিয়ে গেলেন প্রাথমিক ও অপ্রাথমিক পর্যবেক্ষণমূলক কাঠামোর সাথে। কাঠামর যে গতি তা কিভাবে কোনদিকে যাচ্ছে, তা স্থির থাকছে নাকি সারাক্ষণ ই ঘুরছে এ জাতীয় ধারণা থেকেই ও গ্যালিলিও পর্যবেক্ষন করে বলেছিলেন পৃথিবী ও সুর্য সম্পর্কে যে উপাখ্যান আছে তা সম্পুর্ন ঠিক নয়। পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে, সূর্য পৃথিবীর চারিদিকে ঘুরছে না।

সময় ক্ষেপনের সাথে সাথে কাঠামোর মধ্যে অবস্থানগত জিনিষগুলোর যেভাবে পরিবর্তন হয় তা নিয়ে যখন বিভিন্ন বৈজ্ঞানিকগণ বিভিন্ন তত্ত্ব উপাত্ত্ব উপাস্থাপন করেন সেখান থেকেই বেড়িয়ে আসে জোতির্বিজ্ঞান। আমরা শাস্ত্রীয় যান্ত্রিকতার সাথে অংকের নানাবিধ সমন্বয় করে পেয়ে গেলাম জোতির্বিজ্ঞান ও মহাজাগতিক বিজ্ঞানের সমন্বয়।

মর্ত্য ও স্বর্গ নিয়ে চিন্তা ভাবনা চলে আসছিল এরিস্টোটলের সময় থেকে। তিনি জাগতিক ভাবনার সাথে তাল মিলিয়ে কাজ করছিলেন আকাশ, বাতাস, পানি ও আগুন নিয়ে। তিনি জানতেন পৃথিবী বৃত্তাকারে ঘুরে, এবং যেহেতু পৃথিবী তারা গ্রহরাজি গণবৃত্তাকারে ঘুরে তাদের কোন বিনাস নেই। বর্তমান গবেষনার সাথে এ ধারণা একেবারেই যায়না। এ বর্তুলাকার ঘুর্ণন থেকে বেরিয়ে আসতে পৃথিবীর মানুষকে অপেক্ষা করতে হয়েছে বহু বছর। এ্রক হাজার বছর পরে কপার্নিকাস বেড়িয়ে আসলেন বিদ্রোহী ধারনা নিয়ে। তিনি বললেন পৃথিবী তার নিজের চারিদিকে ঘুরে ও সুর্য হল কেন্দ্রবিন্দু।

 

গোপনে কাজ করছিলেন কপার্নিকাস তার অনুসারিদের নিয়ে । কিন্তু আকাশ বাতাসের চিন্তা নিয়ে যিনি পৃথিবী কে নাড়া দিয়েছিলেন তিনি হলেন গ্যালিলিও গ্যালিলি। তার তৈরি করা টেলিস্কোপ দিয়ে ধর্মীয় চিন্তাবিদদের ঘুম কেড়ে নিলেন। নিজের চিন্তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে থেকে গেলেন গৃহ বন্দি হয়ে। কেপলার এগিয়ে আসলেন তার গ্রহ উপগ্রহ বিন্যাসে উপবৃত্তাকার তত্ত্ব নিয়ে। জ্যামিতির বহুভুজ বিন্যাসের মাধ্যমে মানুষ জানল জোতির্বিজ্ঞান ও মহাজাগতিক বিশ্বে গ্রহ উপগ্রহের অবস্থান ও ঘুর্ণন।

আর্কিমিডিসের মাত্রাজ্ঞান, সমতুল্যের সমতল, কাঠামোগত ধারণা নিয়ে এরিস্টোটল, টলেমি, কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও কে সাথে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি মহা জাগতিক জগতের দিকে। মধ্য পথে এসে যুক্ত হলে স্যার আইজাক নিউটন তার গতি প্রকৃতির সূত্র নিয়ে।

নিউটন তার গতির সূত্র দিয়ে আমাদের নিয়ে গেলেন গ্রহ উপগ্রহের চলাচলের পথের সন্ধান দিতে। এখানে মানুষ খুঁজে পেল নুতন পথের ঠিকানা। মাধ্যাকর্ষণ সুত্রের ফলে ক্যাপলারের গতিপথের বেশ কিছুটা পরিবর্তন দেখা গেল। ম্যাক্সয়েল এগিয়ে আসলেন তার শাস্ত্রীয় বৈদ্যুতিক চুম্বকীয় ক্ষেত্র তত্ত্ব নিয়ে। মহাজাগতিক সুত্রগুলো আমাদের এগিয়ে নিয়ে আসল অংকের জগতে। আমরা এরিস্টোটল থেকে ম্যাক্সয়েল পর্যন্ত সবাইকে নিয়ে এসে দাঁড়ালাম আইনস্টাইনের পতাকাতলে। আমরা জানতে পারলাম সাধারণ আপেক্ষিকতা। জোতির্বিজ্ঞান ও মহাজাগতিক বিশ্ব পেল নুতন জীবন।