বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা

– বিজন সাহা

(৯)

বিজন সাহা (ফাইল ছবি)

আজকাল কথায় কথায় মানুষ অতীতে চলে যেতে চায়। কেউ ফিরে যেতে চায় মদিনা সনদে, কেউ রাম রাজ্যে, কেউ বা লেনিনের কাছে। আবার কিছু কিছু মানুষ সেই সময়ে যখন কোন রাষ্ট্র ছিল না। যদিও পদার্থবিদ্যার অনেক সূত্রই সময়ের দিক পরিবর্তন, মানে সমীকরণে টাইম ভেরিয়াবলের সাইন প্লাসের পরিবর্তে মাইনাস করলে, টের পায় না, বাস্তবতাটা এই যে সময় একমুখী – সে অনবরত নিরলস ভাবে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলছে। তাই এমনকি থিওরেটিক্যালিও অতীতে ফিরে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। এক নদীতে যেমন দুই বার নামা যায় না, তেমনি কোন কিছুই একবারের বেশি করা যায় না। এমনকি প্রতি পয়লা বৈশাখ যখন নতুন বছর আসে সে আগের বছরের চেয়ে সব অর্থেই ভিন্ন হয়। আমরা কোন জিনিস রিপিট করতে পারি না, যদিও করি সেটা হয় ভিন্ন পরিবেশে, ভিন্ন সময়ে। যদিও গতকালের মতই আজকেও সূর্য ওঠে, তবে আজকের সূর্যোদয় গতকালের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন, যদিও আমাদের কাছে সেটা মনে হয় না। পরিবর্তনশীল এই বিশ্বে সব কিছুই অনবরত নতুন রূপ লাভ করছে, সময়ের সাথে বদলাচ্ছে তাদের অবস্থান। চলন্ত বাস বা ট্রেনের সাপেক্ষে না হলেও বাইরের সমস্ত গাছপালা, বাড়িঘরের সাপেক্ষে আমাদের অবস্থানের যেমন পরিবর্তন হয়, তেমনি পৃথিবীর সাপেক্ষে তেমনটা না হলেও মহাবিশ্বের সমস্ত গ্রহ, তারা, নীহারিকা, গ্যালাক্সি সব কিছুর সাপেক্ষে আমাদের অবস্থানের পরিবর্তন হয়। তাই লোকালি যেটা স্থির মনে হয় গ্লোবালি সেটা স্থির নয়। আর এ কারণেই আমরা কখনোই সার্বিক অর্থে আগের জায়গায় ফিরে যেতে পারি না। ঠিক এই কথাটাই সমাজের ক্ষেত্রেও খাটে। একবিংশ শতাব্দীর মানুষ কোন মতেই কয়েক হাজার বছর আগের সমাজ ব্যবস্থায় ফিরে যেতে পারবে না। আমাদের মনে রাখতে হবে সমাজ একটা জটিল প্রক্রিয়া, এখানে প্রতিটি মানুষ হাজারো রকমের সম্পর্ক দিয়ে একে অন্যের সাথে জড়িত। ওই যে দোকনদার, ওই যে শিক্ষক, ওই যে পাশের বাড়ির লোক, সবাই কোন না কোন ভাবে একে অন্যের সাথে জড়িত। এটা ফেসবুকে চাইলেই কাউকে ব্লক করা যায়, আনফ্রেণ্ড করা যায়, কোন রকম সম্পর্ক না রাখা যায়। বাস্তব জীবনে কি তা যায়? চাইলেই তো আমি আমার প্রতিবেশীকে অপ্রতিবেশী বানিয়ে দিতে পারি না। এটা ঠিক চাইলে আমি অন্য কোথাও চলে যেতে পারি, প্রতিবেশীকে অন্য কোথাও চলে যেতে বাধ্য করতে পারি। কিন্তু সেটা আর যাই হোক ফেসবুকের মত একটা বাটনের চাপে ঘটে না। বাস্তব জীবন অনেক জটিল। তবে ওই যে বললাম মহাবিশ্বে সব কিছুই অনবরত পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। একই ভাবে সময়ের সাথে বদলাচ্ছে মানুষ, বদলাচ্ছে মানুষে মানুষে পারস্পরিক সম্পর্ক। এমনকি গণিতেও এক সিস্টেম থেকে অন্য সিস্টেমে যেতে হলে বিভিন্ন শর্ত আরোপ করতে হয়, সেক্ষেত্রে সমাজ আরও জটিল সিস্টেম বিধায় এক সমাজের রীতিনীতি অন্য সমাজে কোন রকম পরিবর্তন না করে আরোপ করা বলতে গেলে অসম্ভব। আর সে কারণেই দেশে দেশে আঞ্চলিক বিশেষত্ব গ্রাহ্য না করে সমাজতন্ত্র বা গণতন্ত্র বা অন্য কোন তন্ত্র চাপিয়ে দেওয়া পরিণামে হিতে বিপরীত হয়েছে। এমনকি ধর্মের ক্ষেত্রেও আমরা সেটাই দেখব। বাহ্যিক ভাবে একই রীতিনীতি অনুসরণ করলেও দেখা যাবে একই ধর্মের লোকেরা বিভিন্ন দেশে তাদের ধর্ম বিশ্বাস, ধর্মের রীতিনীতি বিভিন্ন ভাবে ইন্টারপ্রেট করে, যার ফলে একই ধর্ম বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয় বৈশিষ্ট্য অর্জন করে। যখনই এক জায়গার রীতিনীতি অন্য জায়গায় সেই অঞ্চলের বিশেষত্ব বিবেচনায় না নিয়ে আরোপ করার চেষ্টা করা হয় শুরু হয় সামাজিক বিপর্যয়। কেননা এতে করে হাজার বছর ধরে যে সব মানবিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, যেসব অভ্যাস রক্তে মিশে গিয়েছিল সেটা ভাঙ্গতে শুরু করে। এক্ষেত্রে একটা ছোট্ট উদাহরণ দেওয়া যায়। যদিও সেটাকে অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে, তবে একটু গভীর ভাবে চিন্তা করলে যোগসূত্র ঠিকই খুঁজে পাওয়া যাবে। কয়েক বছর আগে দেশে ফেরার পথে শারজাহ এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করছিলাম। ওখানে অনেক বাংলাদেশি ছেলে ছিল। ওরা কাতারে কাজ করত, বিভিন্ন কারণে দেশে ফিরছে। গল্পে গল্পে ওরা বলল ওদের বিভিন্ন সমস্যার কথা। স্থানীয় মালিকরা ওদের রুটি খেতে দিত। ওদের সাথে থাকা ভারতীয় ও পাকিস্তানিরা সেসব খুশি মনে খেত কিন্তু ভাত না পেয়ে ওদের কষ্টের সীমা ছিল না। এই ভাতের অভাব পৃথিবীর দেশে দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সব বাঙালিই কমবেশি অনুভব করে। ভাতের ক্ষুধার মতই আমরা এরকম অনেক ছোটোখাটো অভ্যেস আজীবন বয়ে নিয়ে চলি। সেটা সব দেশের, সব জাতির জন্যই সত্য। তাই ভিন দেশি কোন কিছু, তা সে গণতন্ত্র বা সমাজতন্ত্র হোক অথবা সৌদি আরব বা ইরানের ইসলাম অথবা উত্তর ভারতের হিন্দু ধর্মই হোক, বাংলার ইতিহাস, বৈশিষ্ট্য, মানুষে মানুষে পারস্পরিক সম্পর্ক, স্থানীয় প্রাকৃতিক পরিবেশ ইত্যাদি বিবেচনায় না নিয়ে চাপিয়ে দিতে গেলে বিপর্যয় দেখা দেবেই। বাংলায় যে এসব ধর্ম নিজস্ব রূপ পেয়েছে সেটা হয়েছে স্থানীয় রীতিনীতির সাথে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে গিয়েই। আর এই সামঞ্জস্য বজায় রেখেই গড়ে উঠেছে সমাজ ব্যবস্থা, সামাজিক রীতিনীতি, বিভিন্ন ধর্ম ও মতের পারস্পরিক সহাবস্থানের ভিত্তি। এটাকে ধ্বংস করা মানেই হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা সমাজ ব্যবস্থা ধ্বংস করা। আর তাতে ক্ষতিগ্রস্থ হবে ছোট বড় সবাই – তা সে সংখ্যালঘুই হোক আর সংখ্যাগুরুই হোক।

পড়ুনঃ বিজ্ঞান ভাবনা ৮

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা
শিক্ষক, পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো, রাশিয়া