বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (২০৫) নতুন বোতলে পুরানো মদ

-বিজন সাহা

ইরান ইসরাইল যুদ্ধ জমে উঠেছে। যুদ্ধ চলছে বেশ জাঁকিয়ে আর মানুষ সামাজিক মাধ্যমে সেই আগুনে ঘি ঢালছে। ঘি – কারণ যুদ্ধের কারণে তেলের দাম আকাশ ছোঁয়া। আজকাল মানুষ শুধু আনন্দ চায়, চায় আড্রনালিন। ইসরাইল আর ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রে জ্বলে যাওয়া শহর। ঐ আরেকটা দালান ধ্বসে পড়ল। ইস, কি শট! আসলে আমরা দিন দিন কেমন যেন রবোট হয়ে যাচ্ছি। আমাদের প্রতিটি লাইক, প্রতিটি কমেন্ট সামাজিক মাধ্যমগুলোর পুঁজি বাড়াচ্ছে আর সেই অর্থ যাচ্ছে যুদ্ধের রসদ কিনতে। নতুন বোতলের পুরানো মদ গিলে আমরা সবাই বুঁদ হয়ে এই যুদ্ধের সিনেমা দেখছি।

আচ্ছা আজ যেটা ঘটছে সেটা কি নতুন কিছু? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আজ পর্যন্ত একের পর এক এসব ঘটছে। অনেকেই বলছে যে এই যুদ্ধের ফলে ইরানে মোল্লাতন্ত্রের অবসান ঘটবে, সেখানে প্রতিষ্ঠিত হবে গণতন্ত্র। আচ্ছা এই গল্প আমরা আর কতদিন শুনব। আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া…। আমি যখনই গণতন্ত্রের কথা শুনি, নাগরিক অধিকারের কথা শুনি, দারিদ্র্য দমনের কথা শুনি, নারী অধিকারের কথা শুনি তখন একটা কথাই আমার মনে হয়। আর কত মানুষকে বোকা বানানো? কারণ যেসব সমস্যার কথা বলে কোন দেশ আক্রমণ করা হয়, কোন দেশের সরকার বদলানো হয় এসব সমস্যার মূল সেসব দেশের সরকার নয় – এর মূলে রয়েছে শোষণ। তাই যদি এসব সমস্যার সমাধান কেউ সত্যিকার অর্থেই চায় তাহলে লড়তে হবে শোষণের বিরুদ্ধে, সরকার নয় পরিবর্তন করতে হবে সামাজিক অবকাঠামো, বদলাতে হবে সম্পদের মালিকানা। কিন্তু আমেরিকা, ইসরাইল, পশ্চিমা বিশ্ব কখনও কি সম্পদের সুষম না হলেও ন্যায্য বন্টনের কথা বলে? তাই যদি না হয় তাহলে তারা কীভাবে এসব দেশে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করবে?

আচ্ছা, যদি ইতিহাসের দিকে তাকাই – তাহলে আমরা কি দেখব? তৃতীয় বিশ্বের কোন দেশে যখন গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় এসেছে তখনই এসব দেশ পশ্চিমাদের চক্ষুশূল হয়েছে। তা সে চিলির সাল্ভাদর আলিয়েন্দে হোক, মিশরের জামাল আব্দুল নাসের হোক, কঙ্গোর প্যাট্রিস লুমুম্বা হোক আর বাংলাদেশের শেখ মুজিবুর রহমান হোক। এরা কেউই ভুলের ঊর্ধ্বে ছিলেন না, কিন্তু যেটা সত্য তা হল এরা সবাই নিজ নিজ দেশ ভালবাসতেন, দেশের মানুষের অধিকারের জন্য লড়াই করেছেন, জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করেছেন দেশের সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে। এই যে আজ আমরা ইরানের মোল্লাতন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছি কিন্তু কেউ কি কখনও প্রশ্ন করি কেন এদেশে মোল্লাতন্ত্রের জয় হল? সেটা কি দেশের সাধারণ মানুষের হাত ধরেই আসেনি? গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত ইরানের প্রধানমন্ত্রীকে কারা ক্ষমতাচ্যুত করেছে? আমেরিকা আর ব্রিটেন। নিজদের স্বার্থে তারা সেখানে বসিয়েছে গণবিরোধী সরকার। গণতন্ত্র ভালো কিন্তু সবার চাইতে ভালো পাউরুটি আর ঝোলা গুঁড়। হ্যাঁ, তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ সেগুলোর মূল্য মানুষের জীবনের চেয়ে, গণতন্ত্রের চেয়ে অনেক অনেক বেশি। জীবন যখন পণ্য তখন সবকিছুর মূলে যে বাজার অর্থনীতি থাকবে তাতে অবাক হবার কী আছে? এখানে সুপ্রিম দেবতা একজন – মুনাফা, আর সেটা অর্জনের জন্য দরকার ক্ষমতা। বিশ্ব জুড়ে আজ ক্ষমতার যে লড়াই সেটা মুনাফার জন্য আর সেজন্য ধর্ম, গণতন্ত্র, মানবতা, স্বৈরাচার – সব দেবতাই উপাস্য। মানুষ এখানে অবহেলিত। তাই মানুষ বারবার রাস্তায় নামে, আনে নতুন কোন শক্তি। কিন্তু যে স্লোগান দিয়েই আসুক না কেন লঙ্কায় এসে সবাই রাবণ হয়।

 

পৃথিবীর ইতিহাসে সব যুদ্ধই ছিল সম্পদের জন্য। আগে সেটা ছিল মূলত ভূমি, এখন ভূমিতলে নিহিত সম্পদ। মানুষ? এরা সবসময়ই ছিল খরচের খাতায়। আগেও ছিল, এখনও আছে। দরকার শুধু কিছু সংখ্যক মানুষ যারা প্রভুদের হুকুম পালন করতে পারবে। আগে সুখের জন্য কায়িক শ্রমের দরকার ছিল, এখন এসব প্রযুক্তি দিয়ে করা হয়। তাই গণতন্ত্রের নামে গণহত্যা – এসব আসলে বিভিন্ন অজুহাতে পৃথিবীকে মানবমুক্ত করে অল্প কিছু মানুষের জন্য বেশি বেশি অক্সিজেনের ব্যবস্থা করা। আচ্ছা আমরা কি নিজদের কখনও প্রশ্ন করি যখন দেশের লাখ লাখ শ্রমিক রুটি রুজির দাবিতে রাস্তায় নামে, যখন গার্মেন্টস শ্রমিকরা ধর্মঘটে যায়, যখন ফসলের ন্যায্য মূল্য না পেয়ে কৃষক আত্মহত্যা করে তখন গণতন্ত্রের পুরোহিতরা তাদের পাশে দাঁড়ায় না কেন? যদি মানুষের জীবন তাদের কাছে অমূল্য মনে হয় তবে কেন তারা দারিদ্র্য দূর করার জন্য কোন কার্যকরী পদক্ষেপ নেয় না? উল্টো  বামদের চক্রান্ত বলে এসব আন্দোলন শক্তহাতে দমন করে? সমস্যা কোথায়? সমস্যা আমাদের মাথায়, সমস্যা আমাদের শিক্ষায়। ইংরেজ শাসন কালে তারা এদেশের মানুষকে বিলেতে শিক্ষা দিত আইসিএস অফিসার বানানোর জন্য, কারণ এদেশে তাদের নিজস্ব মানুষের দরকার ছিল। আমরা এখনও সেই শিক্ষায় শিক্ষিত। ফলে আমাদের ভালোমন্দের ধারণা তাদের ভালোমন্দ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এর বিপরীতে আছে মাদ্রাসা বা ধর্মীয় শিক্ষা। ফলে দেশে দেশে বিরাজ করছে দুই ভিন্ন জনগোষ্ঠী যাদের ভালোমন্দের সংজ্ঞা ভিন্ন আর এ কারণেই ইরান ইসরাইলের যুদ্ধে একদল ইরানে মোল্লাতন্ত্রের অবসান চাইছে, আরেকদল চাইছে ইসরাইলে জায়নবাদের পতন। ঠিক এমনটাই ঘটেছে গত বছর বাংলাদেশে। একদল স্বৈরতন্ত্রের পতন চেয়েছে, আরেক দল সেই শাসন ব্যবস্থাকে আঁকড়ে ধরে দিন কাটিয়েছে। এটা অনেকটা ছবি তোলার মত। ছবি তুলতে গিয়ে আমরা অধিকাংশ সময় মূল বস্তু নিয়ে এতটাই ব্যস্ত থাকি যে আশেপাশে বা ব্যাকগ্রাউন্ডে কি আছে সেটা নিয়ে ভাবি না। পরে দেখি এসব ছোটখাটো ভুলের জন্য ছবি মাটি। এখানেও তাই। আমরা ব্যস্ত রাজাদের নিয়ে। দুই দেশের এলিটদের নিয়ে। কিন্তু এর বাইরেও যে সমস্ত দেশে জুড়ে কোটি কোটি সাধারণ মানুষ বাস করছে তাদের নিয়ে আমরা মোটেই ভাবছি না। আসলে এরা কি চায় সেই কথা আমরা জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করিনি। তাদের হয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিচ্ছি, যুদ্ধ করছি, পৃথিবীকে একটু একটু করে অন্তিম যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছি। এবং এসব আমরা করছি দৃঢ় বিশ্বাসে যে সেটা পৃথিবীর জন্য মঙ্গলময়। আসলেই কি তাই? আমার দৃঢ় বিশ্বাস সবচেয়ে ন্যায্য দাবিও যখন পক্ষপাতদুষ্ট হয় তখন তা ন্যায্যতা হারায়। তাছাড়া আপাত দৃষ্টিতে এই যুদ্ধ ইরানের বিরুদ্ধে ইসরাইলের হলেও আমার মনে হয় এটা আসলে মধ্যপ্রাচ্যে নিজদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য আমেরিকার যুদ্ধ। ইউক্রেনে যেমন জেলেনস্কি পশ্চিমাদের পাপেট, মধ্যপ্রাচ্যে নিতানিয়াহু সেই একই ভূমিকায়। আর তাই জার্মানির চ্যান্সেলর বলতে পারে ইসরাইল তাদের হয়ে ডার্টি জব করছে। রিয়াল ইকোনমির জন্য দরকার রিয়াল রিসোর্চ। সেটা ইউরোপের নেই। আছে রাশিয়ায়, আছে আফ্রিকায়, আছে এশিয়ায়, আছে মধ্যপ্রাচ্যে। আর তাই তো এত সব যুদ্ধ বিগ্রহ। যুদ্ধ বিরতির বিরুদ্ধে এত যাগযজ্ঞ। আমরা যারা ইরান বা ইসরাইলের পক্ষে ওকালতি করছি তারা আসলে পুঁজিবাদের হাত শক্তিশালী করছি। মনে রাখা দরকার মোল্লাতন্ত্রের সাথে পুঁজিবাদের দ্বন্দ্ব নেই। তারা একই পথের পথিক। তাদের ঝগড়া শুধু মুনাফার ভাগ বাঁটোয়ারা নিয়ে। যদি সত্যিকার অর্থেই মানুষের মঙ্গল কামনা করেন, যদি সত্যি সত্যি মানবতাবাদী হন, তবে দুই দেশের সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ান, যুদ্ধের ধ্বংস থেকে তাদের রক্ষা করার জন্য সোচ্চার হন। আর দেশে দেশে যাতে সম্পদের ন্যায্য বণ্টন হয় সেই লক্ষ্যে কাজ করুন।

পড়ুন:  বিজ্ঞান ভাবনা (২০৪) শত বর্ষী আরতেক- বিজন সাহা

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো