ইরান-ইসরায়েল সংঘাত ঘনীভূত: ইরানে হামলায় যুক্তরাষ্ট্রকে জড়াতে চায় ইসরায়েল, হুঁশিয়ারি তেহরানের
# ওয়াশিংটন
মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ও ইসরায়েলের পাল্টাপাল্টি হামলায় যুদ্ধের বিভীষিকা আশঙ্কাজনকভাবে ঘনীভূত হয়েছে। ইতোমধ্যে ইসরায়েল হামলা চালিয়েছে ইরানের পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনায়। পাল্টা জবাবে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে তেল আবিবসহ বিভিন্ন ইসরায়েলি শহরে আঘাত হেনেছে ইরান। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, যুক্তরাষ্ট্র এই সংঘাতে সরাসরি জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, ইসরায়েলের লক্ষ্য এখন স্পষ্ট—যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি যুদ্ধে জড়ানো। এদিকে, ইরান হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, তেহরানে হামলা চালালে যুক্তরাষ্ট্রকে ‘অপূরণীয় ক্ষতির’ মুখে পড়তে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ প্রস্তুতি ও অভ্যন্তরীণ আলোচনা
কানাডায় অনুষ্ঠিত জি-৭ সম্মেলন অসমাপ্ত রেখে ওয়াশিংটনে ফিরে এসেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের এক জরুরি বৈঠক ডাকেন। ৮০ মিনিটব্যাপী বৈঠকে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলা নিয়ে উচ্চপর্যায়ের আলোচনা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো বিবৃতি দেওয়া হয়নি।
বিশ্ব গণমাধ্যম এবং বিশ্লেষকদের মতে, ইসরায়েলের অনুরোধে যুক্তরাষ্ট্রের জড়িত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল হয়ে উঠছে। সাবেক ব্রিটিশ গোয়েন্দাপ্রধান জন সাওয়ার্স বলেন, “ইরানের পারমাণবিক অবকাঠামো ধ্বংসের সক্ষমতা একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রেরই রয়েছে।” অন্যদিকে, মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ এই বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।
ইরান-ইসরায়েলের পাল্টাপাল্টি হামলা
ইসরায়েল গতকাল বুধবার ইরানের তেহরান, কারাজ, খোজির ও ইমাম হোসাইন বিশ্ববিদ্যালয়সহ ৪০টি স্থাপনায় বিমান ও ড্রোন হামলা চালায়। এসব হামলায় ইরানের অন্তত দুটি পারমাণবিক স্থাপনার অবকাঠামো ধসে পড়ে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (IAEA)।
ইরানও জবাব দিয়েছে শক্ত হাতে। দেশটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, তারা হাইপারসনিক ‘ফাত্তাহ’ ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলীয় মেরন বিমানঘাঁটিসহ বিভিন্ন সামরিক স্থাপনায় আঘাত হেনেছে। একইসঙ্গে ৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে ইসরায়েলে হামলা চালানো হয়। ইসরায়েলের মতে, এসব হামলায় ১৬ হাজার অবকাঠামো ও এক হাজারের বেশি যানবাহন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
মানবিক বিপর্যয় ও হতাহতের সংখ্যা
ওয়াশিংটনভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস অ্যাকটিভিস্টস জানায়, ইসরায়েলের হামলায় এখন পর্যন্ত ইরানে ৫৮৫ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ২৩৯ জন বেসামরিক ও ১২৬ জন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য, এমনকি দুই ডজন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা রয়েছেন।
ইসরায়েলও জানায়, ইরানের হামলায় তাদের ২৪ জন নাগরিক নিহত হয়েছেন, তবে এরপর থেকে আর কোনো হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করা হয়নি।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও উদ্বেগ
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এ সংঘাত নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, “এই সংঘাত যেন আন্তর্জাতিক পরিসরে না ছড়িয়ে পড়ে, সেই আহ্বান জানাই।” রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছেন।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ সতর্ক করে বলেছেন, “ইরানে সরকার পরিবর্তনের পরিকল্পনা একটি ভয়াবহ ভুল হতে পারে। শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে আলোচনায় ফিরিয়ে আনতেই হবে।”
যুক্তরাষ্ট্রকে জড়ানোর কৌশল ও রাজনৈতিক ইঙ্গিত
ট্রাম্প প্রশাসনের বক্তব্য ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পোস্টে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য সামরিক জড়িত থাকার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। “আমাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে” বা “আমরা ইরানের আকাশ নিয়ন্ত্রণে নিয়েছি”—এমন মন্তব্যে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে।
বিশ্লেষক বারবারা স্লাভিন বলেন, “ট্রাম্প সবসময় বিজয়ী হতে চান। ইসরায়েলকে জয়ী হিসেবে তুলে ধরতে গিয়ে তিনি ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানকে একটি রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে ব্যবহার করছেন।”
মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সামরিক প্রস্তুতি
ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহী রণতরি ইউএসএস কার্ল ভিনসন মধ্যপ্রাচ্যে মোতায়েন রয়েছে, আরও একটি রণতরি ইউএসএস নিমিৎজ অঞ্চলমুখী। বাহরাইন, সাইপ্রাস ও আরব সাগরজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা ঘাঁটিগুলোতে বাড়ানো হয়েছে প্রস্তুতি। যুক্তরাজ্যের লেকেনহিথ ঘাঁটি থেকেও একাধিক এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান মধ্যপ্রাচ্যের উদ্দেশে রওনা হয়েছে।
এই সংঘাত কতটা বিস্তৃত হবে এবং কোন দিকে গড়াবে, তা এখন পুরোপুরি নির্ভর করছে যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের ওপর। তবে পরিস্থিতির সামান্য উত্তেজনাও যদি ভুল পথে মোড় নেয়, তাহলে তা শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, গোটা বিশ্বকেই অস্থির করে তুলতে পারে—এমন হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকেরা।
প্রকাশিত: ১৯ জুন ২০২৫ | সূত্র: এএফপি, আল–জাজিরা, বিবিসি ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম