চলমান সংবাদ

চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি ইজারা: জাতীয় স্বার্থ ও নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ

# নিজস্ব প্রতিবেদক #
চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) দুবাইভিত্তিক কোম্পানি ডিপি ওয়ার্ল্ডকে ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে জাতীয় স্বার্থ, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও কৌশলগত নিয়ন্ত্রণ নিয়ে জোরালো উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন পর্যায়ের নাগরিক সমাজ, অর্থনীতিবিদ ও সংশ্লিষ্ট মহলের প্রশ্ন—সরকার কি একটি লাভজনক ও কৌশলগত অবকাঠামো বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দিচ্ছে?

গত বছরের ৫ আগস্ট গণআন্দোলনের মুখে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল—গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে জনমত ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে। কিন্তু এনসিটি ইজারার সিদ্ধান্ত সেই প্রত্যাশার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

এই পরিস্থিতিতে আরও উদ্বেগ তৈরি করেছে ৬ জুন জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য। ভাষণে তিনি এনসিটি ইজারার বিরোধিতাকারীদের “প্রতিহত” করার কথা বলেন। বিশ্লেষকদের মতে, এমন বক্তব্য গণতান্ত্রিক পরিবেশে উদ্বেগজনক এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী।

কৌশলগত গুরুত্বের স্থাপনাকে ইজারা কেন?
চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর। স্বাধীনতার পর এই বন্দর সচল করতে সবচেয়ে বড় সহায়তা এসেছিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে। বর্তমানে দেশের ৯০ শতাংশ বৈদেশিক বাণিজ্য সম্পন্ন হয় এই বন্দর দিয়ে।

নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) বন্দরের সবচেয়ে আধুনিক অংশ, যা বন্দরের নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত এবং শতভাগ সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত। অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি, দক্ষ জনবল এবং স্থায়ী অবকাঠামো নিয়ে এনসিটি বর্তমানে বন্দরের প্রায় ৪৫ শতাংশ কনটেইনার হ্যান্ডলিং করে।

বিশ্লেষকদের মতে, এমন একটি কৌশলগত ও লাভজনক অবকাঠামো বিদেশি অপারেটরের হাতে তুলে দিলে এর সম্ভাব্য ঝুঁকি হতে পারে:

  • জাতীয় বন্দর নিয়ন্ত্রণে বিদেশি হস্তক্ষেপ;

  • কৌশলগত বাণিজ্যিক তথ্য ও ডেটার বিদেশে প্রবাহ;

  • নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের ওপর চাপ;

  • দেশীয় শ্রমিক ও কর্মসংস্থানে অনিশ্চয়তা;

  • রাজস্ব ক্ষতি।

নিরাপত্তা ও ভূরাজনীতির শঙ্কা
এনসিটির অবস্থানও কৌশলগতভাবে অত্যন্ত সংবেদনশীল। এর আশেপাশেই রয়েছে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সদর দপ্তর, দেশের একমাত্র তেল শোধনাগার ইস্টার্ণ রিফাইনারী এবং গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় স্থাপনা। এই পরিস্থিতিতে একটি বিদেশি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের দীর্ঘমেয়াদি অপারেশনাল নিয়ন্ত্রণ অনেকের কাছেই প্রশ্নবিদ্ধ।

এছাড়া অতীতে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল সৌদি আরবের রেড সী গেটওয়ে টার্মিনালের কাছে ইজারা দেওয়ার অভিজ্ঞতাও খুব ইতিবাচক নয়। প্রতিশ্রুত বিনিয়োগ এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি এবং টার্মিনালের সক্ষমতার ১০–১২ শতাংশের বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে না বলেই জানা গেছে।

এদিকে, ‘রাখাইনে মানবিক সাহায্যের করিডোর’ নিয়ে চলমান গুঞ্জন ঘিরে নতুন করে ভূরাজনৈতিক শঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, এর বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশ একটি জটিল আঞ্চলিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে পারে। এতে দেশের নিরপেক্ষতা, কূটনৈতিক ভারসাম্য এবং নিরাপত্তা নীতির ওপর বড় ধরনের চাপ তৈরি হবে।

প্রশ্নের মুখে স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা
বিষয়টি নিয়ে এখনও সরকারিভাবে বিস্তারিত ব্যাখ্যা না আসায় সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ও উদ্বেগ বাড়ছে। বিশ্লেষকদের মতে, একটি লাভজনক, দক্ষ ও কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ টার্মিনাল কেন এবং কী শর্তে ইজারা দেওয়া হচ্ছে—তা জনসমক্ষে প্রকাশ করা জরুরি।

সরকার যদি সত্যিই জনগণের সরকার হতে চায়, তাহলে এই ইজারার বিষয়টি নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা হওয়া উচিত এবং সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা দরকার—এমন অভিমত দিন দিন জোরালো হচ্ছে।