চলমান সংবাদ

নতুন নানা নিয়মে বাধাগ্রস্ত ভূমধ্যসাগরে উদ্ধারকাজ

ভূমধ্যসাগরে নৌকা থেকে উদ্ধার করা অভিবাসীদের কম্বল, গরম কাপড় এবং খাবার দিয়েছেন উদ্ধারকারীরা| ছবি: ক্লেয়ার রথ/ডিডাব্লিউ

ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়া অভিবাসীদের জন্য ২০১৭ সালের পর ২০২৩ ছিল সবচেয়ে প্রাণঘাতি৷ একটি অভিবাসী উদ্ধারকারী জাহাজে ছিল ডিডাব্লিউ, খুঁজেছে এর কারণ৷

মার্চ মাসে এক রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে ভূমধ্যসাগরে অনুসন্ধান এবং উদ্ধারকারী জাহাজ লাইফ সাপোর্ট সিসিলির কাতানিয়া বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করে৷ ৩০ ঘণ্টার যাত্রা শেষে জাহাজ পৌঁছায় মাল্টার অনুসন্ধান ও উদ্ধার অঞ্চলে৷ নৌযানটি পরিচালনা করে মিলানভিত্তিক মানবিক সংস্থা ইমার্জেন্সি৷

জাহাজের যাত্রা শুরুর পর সদস্যরা নানা প্রশিক্ষণে অংশ নেন৷ তারা জেনে নিচ্ছিলেন, যদি কোনো অভিবাসী বহনকারী নৌকা ডুবে যায় তাহলে কী করতে হবে, কেউ নড়াচড়া করতে না পারলে কীভাবে তাদের বাঁচাতে হবে৷ একটু পরেই জাহাজের বৈঠক কক্ষে আলোচনা চলছিল, লিবিয়ার উপকূলরক্ষীরা উদ্ধারের আগে বা উদ্ধারের সময় নৌকার কাছাকাছি এলে কী আচরণ করা উচিত৷

লিবিয়ার উপকূলরক্ষীরা আগ্নেয়াস্ত্র দেখাচ্ছে, নাকি শুধুই আশেপাশে অবস্থান করে ভয় দেখাচ্ছে, তার উপর ভিত্তি করে আচরণের নির্দেশনাও ছিল ভিন্ন৷

এর মাত্র কয়েক ঘন্টা পরেই ভূমধ্যসাগরের আরেক জায়গায় এই পরিস্থিতি বাস্তবে রূপ নেয়৷ লিবিয়ান কোস্ট গার্ডের সদস্যরা ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস (এমএসএফ) পরিচালিত অনুসন্ধান ও উদ্ধারকারী জাহাজ জিও ব্যারেন্টে ‘জোরপূর্বক’ উঠে পড়ার চেষ্টা করেছিল৷ লাইফ সাপোর্টের কিছুক্ষণ আগেই ইটালি থেকে যাত্রা শুরু করে জিও ব্যারেন্ট৷ ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস জানিয়েছে, প্রায় দুই ঘন্টা ধরে লিবিয়ার উপকূলরক্ষীরা ‘‘অভিবাসীদের আক্রমণাত্মকভাবে হুমকি দিচ্ছিলো এবং এমএসএফ কর্মীদের গ্রেপ্তার এবং লিবিয়াতে জোরপূর্বক নিয়ে যাওয়ার হুমকি দিচ্ছিলো৷’’

লাইফ সাপোর্টের উদ্ধারকারী নিকোলা সেলভা বনিনো ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন, জাহাজটি ভূমধ্যসাগরে উদ্ধারকাজ শুরুর পর থেকে লিবিয়ার উপকূলরক্ষীরা অন্তত পাঁচবার তাদের সঙ্গে এমন ঘটনা ঘটিয়েছে৷

লিবিয়ার উপকূলরক্ষীদের আংশিকভাবে অর্থায়ন এবং সরঞ্জাম সরবরাহ করে আসছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন৷ ২০১৭ সাল থেকে এই জোট লিবিয়ার কর্তৃপক্ষকে তাদের সীমান্তে টহল দিতে সহায়তা করার জন্য প্রায় ছয় কোটি ইউরো বরাদ্দ করেছে৷

২০১৫ সালের তথাকথিত ‘‘অভিবাসী সংকট’’ এর পর থেকে আট বছরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের জাহাজগুলো ইউরোপের দক্ষিণ উপকূল এবং উত্তর আফ্রিকার উপকূলের মধ্যবর্তী অনুসন্ধান এবং উদ্ধার অঞ্চলে প্রায় সমস্ত কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে৷ সেই জায়গায় কাজ চালাচ্ছে লাইফ সাপোর্টের মতো এনজিও পরিচালিত জাহাজগুলো৷

সমালোচকদের অভিযোগ, এইসব বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে অনিয়মিত অভিবাসীদের জন্য ‘‘পুল ফ্যাক্টর’’ হিসাবে, অর্থাৎ সমুদ্র উদ্ধার অভিযানের মাধ্যমে অভিবাসনে আগ্রহী করে তোলে৷

এই দাবি অবশ্য কোনো পরিসংখ্যানেই প্রমাণিত হয়নি৷ কিন্তু তারপরও এই যুক্তিতেই ইউরোপের নানা দেশের সরকারি দপ্তরে এখনও বিতর্ক চলমান৷

ইটালির নতুন আইন ভূমধ্যসাগরকে ‘আরও বিপজ্জনক’ করে তুলেছে

পড়ুন:  পাঁচ বাংলাদেশিসহ রোমানিয়া থেকে ‘ডিপোর্ট’ ২০ অভিবাসী

ভূমধ্যসাগরে উদ্ধার অভিযানের চিত্র সবসময় এরকম ছিল না৷ একসময় সিসিলি থেকে অনুসন্ধান ও উদ্ধার অঞ্চলে যাত্রা করা জাহাজগুলো যত বেশি সম্ভব উদ্ধার কাজ করে কাছাকাছি বন্দরে ফিরে যেত৷

কিন্তু ২০২৩ সালের শুরুতে ইটালি এক নতুন আইন প্রণয়ন করে৷ এই আইনের ফলে জাহাজগুলোকে একটি উদ্ধার অভিযান চালিয়ে কর্তৃপক্ষের বরাদ্দ করা নির্দিষ্ট বন্দরে চলে যেতে হয়৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এমন বন্দর বরাদ্দ হয়, যা জাহাজের অবস্থান থেকে কয়েকদিনের যাত্রা৷

উদাহরণস্বরূপ, লাইফ সাপোর্টকে সিসিলির কোনো বন্দর বরাদ্দ দেয়া হলে উদ্ধার অভিযান শুক্রবার বিকেলে শুরু করে সোমবার সকালেই শেষ করা যেত৷ কিন্তু তার বদলে এই অভিযান স্থায়ী হয়েছিল প্রায় এক সপ্তাহ৷

ইটালির সরকার ২০২৩ সালে আইন প্রণয়নের তিন দিন পর ভূমধ্যসাগরে উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করা ১৮টি সংস্থা একটি বিবৃতি প্রকাশ করে৷ তারা সতর্ক করে দিয়েছিল যে, এই আইনের ফলে এই বিপজ্জনক অভিবাসন রুট আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠবে৷

বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, এই আইন ‘‘সমুদ্রে উদ্ধার সক্ষমতা কমিয়ে দেবে এবং এর ফলে বিশ্বের সবচেয়ে মারাত্মক অভিবাসন রুটগুলোর একটি মধ্য ভূমধ্যসাগরকে আরও বিপজ্জনক করে তুলবে৷’’

২০১৭ সালের পর ২০২৩ পরিণত হয়েছে সমুদ্রে আসা অভিবাসীদের জন্য সবচেয়ে মারাত্মক সময় হিসাবে৷

লাইফ সাপোর্টের মিশনের শেষ দিনে জাহাজের কন্ট্রোল রুমে কথা বলার সময় জাহাজের সার্চ অ্যান্ড রেসকিউ ব্যবস্থাপক আনাবেল মন্টেস মিয়ার ডিডাব্লিউকে বলেন, লাইফ সাপোর্ট ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ে ছয়টি দুর্দশাগ্রস্ত নৌকার তথ্য পেয়েছিল৷ কিন্তু নতুন আইনে আরোপিত সীমাবদ্ধতার কারণে জাহাজটি কেবল একটি নৌকায় উদ্ধারকাজ পরিচালনা করতে পেরেছিল৷

লাইফ সাপোর্ট উদ্ধার এলাকা ছেড়ে যাওয়ার পর অন্তত দুই দিন লিবিয়া এবং ইটালির মধ্যবর্তী অঞ্চলে টহলরত কোনো জাহাজ অবস্থান করছিল না৷

বরাদ্দ করা বন্দর ব়্যাভেনায় ফিরে যাওয়ার আগে লাইফ সাপোর্ট ৭১ জন অভিবাসীকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়৷ এই সংখ্যা জাহাজটির ধারণক্ষমতার অর্ধেকেরও কম৷

এই অভিবাসীরা নিরাপদে স্থলে পৌঁছোতে পেরেছেন৷ কিন্তু অন্য নৌকায় থাকা তাদের বন্ধুদের কী হয়েছে, তা তারা জানতে পারেননি৷

ক্লেয়ার রথ/এডিকে