মতামত

ভারতে বাংলা ভাষা আন্দোলন-২

-ইকবাল সরোয়ার সোহেল

১৯৬০ সালের ৩ মার্চ আসাম রাজ্যসভায় তৎকালীন কংগ্রেস দলীয় মুখ্যমন্ত্রী স্যার বিমলা প্রসাদ চালিয়া বিতর্কিত `অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যাক্ট ১৯৬০` উত্থাপন করেন, যেখানে অহমিয়াকে আসাম রাজ্যের একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণার প্রস্তাব করা হয়। ১৯৬০ সালের ২১ এবং ২২ এপ্রিল আসাম প্রদেশ কংগ্রেস প্রস্তাব গ্রহণ করে ‘অহমিয়াকে রাজ্য ভাষা করতেই হবে। ’ আসামের মুখ্যমন্ত্রী বিমলাপ্রসাদ চালিহা এই প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে বলেন, ‘দাবিটা রাজ্যের অ-অসমীয়দের কাছ থেকে আসুক। কিন্তু মাস দু’য়েক যেতে না যেতেই বিধানসভায় তিনি ঘোষণা করেন, ‘অহমিয়াকে রাজ্যভাষা করার জন্য সরকার শিগগিরই একটি বিল আনছে। ’

উগ্র জাতীয়তাবাদীদের তাণ্ডব তখন গৌহাটী গোরেশ্বরে ছড়িয়ে পড়েছে। রাজ্যভাষা করার নামে সাম্প্রদায়িক আন্দোলন গড়ায় ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায়। ১৯৬০ সালের ২ জুলাই, আসাম রাজ্যের কাছাড় জেলার শিলচরে ডাকা হয় ‘নিখিল আসাম বাঙলা ও অন্যান্য অ-অসমীয় ভাষা সম্মেলন’। প্রতিনিধিদের মধ্যে ছিলেন লুসাই – খাসিয়া – গারো – মণিপুরী, বাঙালি সবাই। সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাব গৃহীত হয়, ‘ভাষা প্রশ্নে স্থিতাবস্থা বজায় থাকবে। ’ কেন্দ্রের কাছে প্রার্থনা জানানো হলো, ‘ভাষার প্রশ্নে হস্তক্ষেপ করুন। ’

ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় নরমেধযজ্ঞ শুরু হলো। দাঙ্গা-বিধ্বস্ত এলাকা ছেড়ে সংখ্যালঘুরা পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরবঙ্গ ও কাছাড়ে পালাল। চালিহার বিশেষ একটা দিক ছিল বিশেষ কোনো সঙ্কট মুহূর্ত এলে হঠাৎ তিনি অসুস্থ হয়ে পড়তেন। সে সময়ও তাই হলো। পুলিশ পক্ষপাতমূলক আচরণ করলো। স্থানে স্থানে দাঙ্গাকারী আর পুলিশ এক হয়ে আক্রমণ চালালো। তাদের বর্বরতা পশুর হিংস্রতাকে ছাড়িয়ে গেল।

১৯৬০ সালের ১৫ আগস্ট। কলকাতা শোক দিবস পালন করলো। উগ্রজাতীয়তাবাদী বর্বরতার প্রতিবাদে সরকারি-বেসরকারি সমস্ত অনুষ্ঠান বর্জন করা হলো। পরবর্তী লোকসভা অধিবেশনে আলোড়ন উঠলে, পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা উত্তেজনায় ফেটে পড়লো। প্রধানমন্ত্রী নেহেরু শান্তি দূত পাঠালেন গোবিন্দবল্লভ পন্থকে। পন্থজী ফরমূলা দিলেন। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা নির্দ্বিধায় তা নাকচ করে দিলো।

কাছাড়বাসীর প্রতিনিধিরা ছুটলেন দিল্লি। দিল্লি নির্বিকার। ১৯৬০ সালের ১০ অক্টোবর রাজ্যভাষা বিল পাস হয়ে গেল আসাম বিধানসভায়। ২৪ অক্টোবর আসাম সরকারের মন্ত্রিসভা সিদ্ধান্ত নিল রাজ্যের প্রশাসনিক ভাষা হবে অসমীয়া ভাষা। নতুন আইনে সমগ্র আসামে সরকারি ভাষা হলো অহমিয়া। শুধু কাছাড়ের জন্য জেলান্তরে রইলো বাংলা ভাষা।

সমগ্র কাছাড় থেকে প্রতিবাদ সোচ্চার হয়ে উঠলো, ‘এ রাজ্য ভাষা বিল আমরা মানি না, মানবো না। বাংলাকে অন্যতম সরকারি ভাষা করতে হবে। ’ অসমিয়াদের তীব্র বাঙালিবিদ্বেষের প্রতিবাদে ঝড় ওঠে বরাক উপত্যকায়। শুরু হয় গণ-আন্দোলন।’

১৯৬১ সালের ১৫ জানুয়ারি – শিলচর সম্মেলনের প্রস্তাব নতুন করে ঘোষণা করা হলো। সমগ্র কাছাড় জেলায় বিক্ষোভ দানা বেঁধে উঠলো। ভাষার প্রশ্নে সমগ্র কাছাড় এক মন এক প্রাণ হয়ে শপথ নিলো- ‘জান দেবো তবু জবান দেবো না। মাতৃভাষার মর্যাদা যে কোনো মূল্যের বিনিময়ে রক্ষা করবোই। ’কাছাড়ের যৌবন তরঙ্গ টগবগ করে উঠলো। তবু আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে শেষ চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কি! আবার ডাকা হলো সম্মেলন।

১৯৬১-র ৫ ফেব্রুয়ারি করিমগঞ্জ রমণীমোহন ইনস্টিটিউটে শীলভদ্র যাজীকে সভাপতি করে কাছাড় জেলা জনসম্মেলন আহ্বান করা হলো। গঠিত হলো কাছাড় গণসংগ্রাম কমিটি। বাংলা ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে আন্দোলন পায় নতুন গতি।

সম্মেলনের একমাত্র দাবী ‘বাংলাকে আসামের অন্যতম রাজ্য ভাষা রূপে মানতে হবে। ’ আসাম সরকারের কাছে চিঠি পাঠিয়ে ১৩ এপ্রিলের ভেতর শেষ জবাব চাওয়া হলো। ১৩ এপ্রিলের মেয়াদ শেষ হলেও আসাম কংগ্রেস সরকার রইল নিরুত্তর। অতএব সমরে ঝাঁপিয়ে পড়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। ঘরে ঘরে সংগ্রাম পরিষদের স্বেচ্ছাসেবকবাহিনী তৈরি হতে লাগলো। এক নতুন মন্ত্রে দীক্ষিত হতে লাগলো গোটা কাছাড়। গণসংগ্রাম কমিটির নেতা রবীন্দ্রনাথ সেন ১৯ মে ১২ ঘণ্টার হরতালের ডাক দেন। ১৪ এপ্রিল বরাকের কাছাড়, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দিতে পালিত হয় সংকল্প দিবস।

বাঙালির আন্দোলনের তীব্রতার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে আসাম সরকারের দমন-পীড়নও। পুলিশ, আধা-সেনা নামিয়ে আন্দোলন দমানোর সব রকম চেষ্টা শুরু হয়। আইনশৃঙ্খলা রাজ্যের বিষয়-এই অজুহাতে জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারও নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। ১৯ মের আগে থেকেই নিরাপত্তা বাহিনীতে ছেয়ে যায় বরাক উপত্যকা। ১২ মে থেকেই সেনা কমান্ডে পরিচালিত আসাম রাইফেলস জওয়ানেরা শুরু করেন ফ্ল্যাগ মার্চ।

১৮ মে, নিঃসন্দেহে ছাত্র প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে স্মরণীয়। ছাত্র সমাজের ডাকে করিমগঞ্জ শহরে যে শোভাযাত্রা বের হয় তা নিঃসন্দেহে গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। সর্বস্তরের মানুষ সেদিন ভুলে গিয়েছিল এ যে শুধু ছাত্র সমাজের শোভযাত্রা। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা যোগ দিয়েছিল মাতৃভাষার ডাকে সেই শোভাযাত্রায়।শাসকগোষ্ঠীও শক্তির পরিচয় দেখাতে পিছ পা হয়নি। সমগ্র জেলার ব্যাটালিয়ানের পর ব্যাটালিয়ান সৈন্য দিয়ে ছেয়ে ফেলা হলো। জারি করা হলো সমগ্র জেলায় ১৪৪ ধারা। রাস্তায় রাস্তায় নামানো হলো মিলিটারি আর টহলদার বাহিনী। সন্ত্রাস জাগিয়ে তোলার অপচেষ্টা শুরু হলো। করিমগঞ্জের সংগ্রাম পরিষদের দুই নেতা রথীন্দ্রনাথ সেন, নলিনীকান্ত দাশ, বিধুভূষণ চৌধুরী ও ভাষা আন্দোলনের প্রথম সারির নেতারাসহ ছাত্রনেতা নিশীথরঞ্জন দাসকে ১৮ মে গ্রেফতার করে শিলচর নিয়ে যাওয়া হলো। প্রত্যেকটি জনপদ যেন বিক্ষোভে আরও ফোঁসে উঠলো। সহস্র বলিষ্ঠ কণ্ঠে আওয়াজ উঠলো- “মাতৃভাষা-জিন্দাবাদ। “ মৃত্যুর সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য গোটা কাছাড় প্রস্তুত হয়ে রইলো।

পড়ুন:  ভারতে বাংলা ভাষা আন্দোলন-৩ -ইকবাল সরোয়ার সোহেল

সকাল থেকেই সত্যাগ্রহীরা অহিংসভাবে হরতাল পালন করছিলেন। তিন জেলাতেই পিকেটারদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ। শিলচরের তারাপুর রেলস্টেশনেও শান্তিপূর্ণভাবেই চলছিল অবরোধ।

১৯ মে ভোর চারটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত হরতালের ডাক দেয় কাছাড় জেলা সংগ্রাম পরিষদ। যেভাবে হোক ট্রেনের চাকা চলতে দেওয়া যাবে না। বিমানঘাঁটিতে বিমানের পাখা ঘুরবে না। অফিসের তালা খুলবে না।ভোর হতেই শত শত সত্যাগ্রহী বসে পড়লো রেল লাইনের উপর। বিমানঘাঁটিতে রানওয়ের উপর শুয়ে পড়লো সত্যাগ্রহীরা। সারি সারি দাঁড়াল অফিসের গেটের সামনে। শিলচর, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি, পাথারকান্দি, বদরপুর সব ক’টি জায়গায় সত্যাগ্রহীরা শান্তিপূর্ণ উপায়ে কর্তব্য পালনে প্রস্তুত।কতটা স্বতঃস্ফুর্ত ছিল সেদিনের ধর্মঘট তা শোনা যাক লেখক অলক রায়ের জবানীতে। তিনি ‘ভাষা আন্দোলনে কাছাড়’ বইয়ে লিখেছেন- ‘করিমগঞ্জ রেল-স্টেশন। ভোরের ট্রেন আটকাতেই হয়। সত্যাগ্রহীরা রেল-লাইন আগলে বসলো। কয়েকজন আবার রেল-লাইনের উপর উপুড় হয়ে শুয়েও পড়লো। রেলের চাকা যদি চলে ওদের উপর দিয়ে পিষে বেরিয়ে যায় যাক ক্ষতি নেই। আচমকা পুলিশ ওদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো উদ্যত লাঠি হাতে। পেটাতে লাগলো। কিন্তু সত্যাগ্রহীদের রেল লাইন থেকে সরাতে পারলো না। সত্যাগ্রহীদের স্লোগানে চারদিক মুখর হয়ে উঠলো- মাতৃভাষা-জিন্দাবাদ। ‘জান দেবো, তবু জবান দেবো না। ’এবারে আরো নৃশংস হয়ে উঠলো কংগ্রেস সরকারের পুলিশ বাহিনী। সঙ্গীন উঁচু করে ধেয়ে এলো সত্যাগ্রহীদের দিকে। কিন্তু না, সত্যাগ্রহীরা লাইন আকড়ে ধরে পড়ে আছে। সঙ্গীন খোঁচায় সত্যাগ্রহীদের শরীর রক্তাক্ত হয়ে উঠলো। মুখে তাদের মাতৃভাষা-জিন্দাবাদ। ট্রেন আটকাতে অসংখ্য মেয়েরা এসেছে। সত্যাগ্রহী ভাইদের সঙ্গে ওরাও মাতৃভাষার যুদ্ধে সামিল। আর একটি পুলিশ বাহিনী এসে এবার মেয়েদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। মাথায় তাদের রাইফেলের আঘাত পড়তে লাগলো। জ্ঞান হারিয়ে দু’একজন লুটিয়ে পড়লো সেখানে বাকীদের রেললাইন থেকে যে কিছুতেই নড়ানো যাচ্ছে না। আঘাতে শরীর জর্জরিত তবু সরতে চায় না। কি ভয়ানক মনোবল ওদের। কংগ্রেস সরকারের পুলিশ এবার দুঃশাসনের ভূমিকায় নামলো। মেয়েদের সম্ভ্রম হরণের জন্য তাণ্ডব শুরু করলো। শাড়ি টেনে টেনে খুললো- তারপর বুটের আঘাত, রাইফেলের বাটের ঘা, টেনেহিঁচড়ে ফেলে দিলো রেললাইন থেকে দূরে। জ্ঞান হারিয়ে ওরা তখন বিবস্ত্রা। সঙ্গে সঙ্গে আর একদল সত্যাগ্রহী সে স্থান দখল করলো।সমস্ত দিন ওরা চেষ্টা করলো ট্রেনের চাকা চালাতে। কিন্তু প্রতিবারই সত্যাগ্রহীদের অটুট মনোবলের কাছে হেরে গিয়ে বর্বরোচিত অত্যাচার চালিয়েছে। আহত হয়েছে অসংখ্য সত্যাগ্রহী আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা নির্বিশেষে। হাসপাতালের সিট ভর্তি হয়ে গেছে। আহতদের শেষ পর্যন্ত হাসপাতাল করিডোরে রাখার ব্যবস্থা করা হলো। কত শত সত্যাগ্রহীকে বন্দী করার পর জেলে গাদাগাদি করে রাখা হয়েছে। জেলেও জায়গার অভাব। অনেক সত্যাগ্রহীকে বন্দী করে কয়েক মাইল দূরে পুলিশ ছেড়ে দিয়ে আসে। সংগ্রাম পরিষদের গাড়িও প্রস্তুত- তৎক্ষণাৎ পেছন ছুটে সত্যাগ্রীদের নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হয়। সে এক অভূতপূর্ব গণ-সত্যাগ্রহ- গণআন্দোলন। এর ইতিহাস বিরল।শিলচর-হাইলাকান্দি-পাথারকান্দি-বদরপুরে একই পাশবিক অত্যাচার, একই পদ্ধতির উৎপীড়ন। শাসক কংগ্রেস সরকারের পুলিশবাহিনীর একই তাণ্ডবলীলা।বেলা দু’টা বেজে দুপুর গড়িয়ে গেছে। নেতারা কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন। মারাত্মক অঘটন বুঝি আর ঘটবে না। কংগ্রেস সরকারের সমস্ত বলপ্রয়োগ বিফলে গেছে। হরতাল সফল হতে চলেছে। পুলিশ মিলিটারি অত্যাচারের মাত্রা একটুখানি কমিয়ে দম নিচ্ছে। মাতৃভাষা- জিন্দাবাদ ধ্বনিতে রেল স্টেশন মুখর। হঠাৎ রাইফেলের আওয়াজে শিলচর রেল স্টেশন সচকিত হয়ে উঠলো। ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুটে এলো নরপিশাচদের রাইফেল থেকে। রক্তস্নাত হলো শিলচর। ভারতীয় সময় বেলা ২টা ৩৫ মিনিট নাগাদ বিনা প্ররোচনায় নিরাপত্তারক্ষীরা ১৭ রাউন্ড গুলি চালায়। রক্তের ফোয়ারায় শিলচর প্ল্যাটফর্ম লাল হয়ে উঠলো। লাল হয়ে গেল কঠিন পাষাণ রেললাইন। রক্তের আর্তনাদ থেকে সত্যাগ্রহীদের মুখ দিয়ে বেরুল ‘মাতৃভাষা-জিন্দাবাদ’। মাতৃভাষার ইজ্জত বাঁচাতে অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত শত শত সত্যাগ্রহীরা আহত হলেন।

লেখকঃ বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক