মতামত

ভারতে বাংলা ভাষা আন্দোলন-১

-ইকবাল সরোয়ার সোহেল

ইকবাল সরোয়ার সোহেল (ফাইল ছবি)
ভারতের বিভিন্ন অংশে মাতৃভাষার অধিকার আদায়ে বাঙালি জনগোষ্ঠী বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন শুরু করে। অবিভক্ত ভারতে ১৯১২ সালে মানভূম জেলাকে ভারতের বিহার ও ওড়িশার সাথে যুক্ত করা হয়। সে সময় মানভূমবাসী তাদের জেলাকে বাংলার সাথে যুক্ত করার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। বাংলার সাথে যুক্ত হওয়ার এ আন্দোলন থেকেই মানভূমে ভাষা দাবিও যুক্ত হয়। সে সময় যে আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল তা ১৯৫৬ সালে সাময়িক ভাবে নতুন জেলা গঠনের মাধ্যমে সেই আন্দোলনের আন্দোলনকারীদের দাবি মিটে গেলেও ভারতের অন্যান্য প্রদেশে বাংলা ভাষা আন্দোলন আজও বিদ্যমান। ভারতের বাংলা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ঘেঁটে দেখলে মানভূম ও আসামের নাম প্রথম উঠে আসে। এছাড়াও ঝাড়খণ্ড, বিহার, ছত্তিশগড়, কর্ণাটক ও দিল্লিতে বাঙালি মাতৃভাষার দাবিতে লড়াই করছে।
বিভিন্ন রাজ্যে ভাষা আন্দোলনের পটভূমিঃ
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারত দ্বিখণ্ডিত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান তৈরি হয়। মুসলিম অধ্যুষিত পূর্ব বাংলা পাকিস্তানে এবং হিন্দু অধ্যুষিত পশ্চিম বাংলা ভারতে যোগ দেয়। পশ্চিম বাংলা থেকে বাঙালি মুসলমানেরা তদানীন্তন পাকিস্তান তথা অধুনা বাংলাদেশে এবং বাঙালি হিন্দু পূর্ব বাংলা থেকে ভারতে চলে আসে। পূর্ববঙ্গ থেকে আসা উদ্বাস্তু ও ছিন্নমূল এই সব হিন্দু বাঙালিরা ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে আশ্রয় নেন। ভারতের বাঙালি রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও অন্যান্য অবাঙালী জনজাতি অধ্যুষিত রাজ্যে তাদের পুনর্বাসন দেওয়া হয়। ছত্রিশগড় ,ওড়িশার দণ্ডকারণ্য, মহারাষ্ট্র কর্ণাটক এই রাজ্য গুলির মধ্যে অন্যতম। পুনর্বাসিত এই সকল হিন্দু বাঙালিরা অবাঙালী অধ্যুষিত এই সকল রাজ্যে বৈষম্যের স্বীকার হয় এবং মাতৃভাষা বাংলার পঠনপাঠন ও সরকারি মর্যাদার দাবিতে আন্দোলনে নামেন।
* আসাম – বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা আন্দোলনঃ
‘জান দেবো, তবু জবান দেব না। ’
অহমিয়ার পাশাপাশি বাংলাকে রাজ্যভাষা করার দাবিতে কাছাড়ের বাঙালিদের স্লোগান ছিল এটি।
প্রত্যয়ের ব্যত্যয় ঘটেনি। জীবন দিয়েছিল তারা, জবান দেয়নি। ১৯৬১ সালের ১৯ মে বাংলাকে রাজ্যভাষা করার দাবিতে কাছাড়ে ১১ বাঙালি প্রাণ বিসর্জন দেন।
সেই উৎসর্গের বদৌলতে বাংলা পেয়েছে রাজ্যের সরকারি ভাষার স্বীকৃতি।
আসাম মূলত দুই নদের অববাহিকা অঞ্চলে বিভক্ত। ব্রহ্মপুত্র ও বরাক। দুই নদের অববাহিকা অঞ্চলের ভাষা, সংস্কৃতি এমনকি ভৌগোলিক অবস্থানেও বিস্তর ফারাক। ভারতের মিজোরাম, ত্রিপুরা, মণিপুর, মেঘালয় ছাড়াও বাংলাদেশ দিয়ে ঘেরা বরাকে আসামের রাজধানী গুয়াহাটি থেকে সড়কপথে সরাসরি যাওয়ার রাস্তা নেই। অসমিয়া নয়, এখানে সবাই কথা বলেন বাংলায়। খাদ্যাভ্যাস ও সংস্কৃতিও বাঙালিদের মতোই। বরাকের বাঙালিরা প্রথম থেকেই সংখ্যালঘু অসমিয়াদের দাদাগিরির শিকার।
বরাক নদীর উৎস ভারতে, সেই বরাক নদীই আমাদের দেশে প্রবেশ করেছে সুরমা আর কুশিয়ারা নামে। বরাকের জলধারাই প্রবাহমান এই দুই নদী দিয়ে। তার গতি স্বাভাবিক নিয়মেই ভাটির দিকে। নদীর স্রোতধারাতো উজানে বয় না। কিন্তু আন্দোলনের ঢেউ যদি উজানে প্রবাহিত হয়? তাহলে কি এর তীব্রতা হবে কয়েকগুণ বেশি! সুরমার তীরসহ বাংলার ভাষা আন্দোলনের তীব্রতা কি প্রবাহমান জলধারাই নিয়ে গেল উজানে, বরাক উপত্যকায়; তাও আবার ৯ বছর পর! সেই তরঙ্গই কি রূপ দিলো আরেকটি ভাষা আন্দোলনের? তার ফলশ্রুতিতেই কি বরাকবাসীর স্বীকৃতি পেলো বাঙলার? হয়ত! তবে এই স্বীকৃতি অর্জনের পথে মহান একুশে ফেব্রুয়ারির মতো আরেকটি ভাষা আন্দোলনে বাংলা মায়ের বীর সন্তানদের রক্তে রঞ্জিত হলো শিলচর। ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় আসাম রাজ্যের অন্তর্গত বাংলাভাষী ভূ-খণ্ড বরাক উপত্যকার মধ্যে রয়েছে করিমগঞ্জ হইলাকান্দি, বদরপুর, শিলচর প্রভৃতি বাঙালি অধ্যুষিত শহর।
দেশ বিভাগের আগে অবিভক্ত সিলেট জেলাসহ এই বরাকের অধিবাসী বাঙালিরাই পুরো আসাম প্রদেশের নেতৃত্ব দিয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় অবশেষে তাদের পরিচয় হয় ভাষিক সংখ্যালঘু হিসেবে। তবে এরও আগে লাইন প্রথার মতো বিভেদকামী ব্যবস্থা ছিল আসামে। এর বিরুদ্ধে বাঙালি মুসলমানরাই অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে আন্দোলন করেছেন। শুধু তাই নয় ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় বঙালিরা বার বার উচ্ছেদ আন্দোলনের শিকার হয়েছে। অসমীয়দের অত্যাচারে কোনো জাতিই স্বস্তিতে ছিল না।
প্রাচীন ভারতের এ রাজ্যটি আগে থেকেই নানা জনজাতি উপজাতি বহুভাষা ও ধর্মের সমন্বয়ে গঠিত ছিল। একসময় সেটা উগ্র অসমীয় জাতীয়তাবাদে রূপ নেয়। তাদের আগ্রাসী মনোভাবে অন্যান্য জাতি সত্তার অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ে। ফলে অন্যান্য সম্প্রদায়কে অনেকটা বাধ্য হয়েই নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য রাজপথে নামতে হয়–বেছে নিতে হয় সংগ্রামের পথ। যার ফলে অবিভক্ত আসাম রাজ্য ভেঙে একে একে তৈরি হয় মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মেঘালয় ও অরুণাচল।
সংখ্যায় বাঙালিরা আসামের এক বিশাল জনগোষ্ঠী। নিজেদের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার তাগিদেই তারা অহমিয়াকে সরকারি ভাষা হিসেবে মেনে নিয়ে বাংলা ভাষাকেও অন্যতম রাজ্যভাষা করার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা আন্দোলনের মতোই তাদের আন্দোলনও দানা বাঁধতে থাকে। অন্য ভাষাভাষী গোষ্ঠীও বাঙালিদের এ আন্দোলনকে সমর্থন করে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি এ আন্দোলনকে গণতান্ত্রিক আন্দোলন রূপে সংগঠিত করতে সহযোগিতা করে।
তবে সব কিছুই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় যখন কংগ্রেস প্রদেশ সরকার ওই সর্বনাশা ভাষা বিলে সম্মতি প্রদান করে। এতে করে আন্দোলনকে চূড়ান্ত রূপ দেওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না বাঙালিদের। বাধ্য হয়েই বাঙালিরা প্রতিরোধের ডাক দেয়। বরাক তীরের বাঙালিরা দৃপ্ত শপথ গ্রহণ করে যে কোনো মূল্যে মায়ের ভাষাকে সমুন্নত রাখার। আন্দোলনের দাবানল ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। অসমের খাসিয়া, গারো, বোরো, মিশামী, ডিমসা, মণিপুরী, বিষ্ণুপ্রিয়াসহ সংখ্যালঘু প্রায় জনগোষ্ঠীই এতে স্বতঃস্ফুর্ত সমর্থন দেয়। আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে। প্রতিবাদ, ধর্মঘট, সভা সমিতির মাধ্যমে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলনের দাবানল।
লেখকঃ বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক