চলমান সংবাদ

বিলস এর সভায় জাহাজ ভাঙা শিল্পে ২০২৩ সালে মোট দুর্ঘটনার প্রতিবেদন উপস্থাপন

 

আজ মঙ্গলবার (১৯ ডিসেম্বর) চট্টগ্রাম নগরীর আগ্রাবাদস্থ একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত স্থানীয় অংশিজনদের সাথে জাহাজ ভাঙা শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য নিরাপত্তা বিষয়ক প্রতিবেদনে  জাহাজ ভাঙা শিল্পে দুর্ঘটনার তথ্য তুলে ধরেন বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব লেবার স্টাডিজ -বিলস। পেশাগত স্বাস্থ্য নিরাপত্তা বিষয়ক তথ্য কেন্দ্রের সমন্বয়ক ফজলুল কবির মিন্টু প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন।

এছাড়াও, চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা: রজত শংকর রয় বিশ্বাস জাহাজ ভাঙা শ্রমিকদের দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন।

সেমিনারে জাহাজ ভাঙা শিল্প শ্রমিক, বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়নের নেতা, সমাজ সেবা অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর, শ্রম অধিদপ্তর, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরসহ নানা শ্রেণির স্টেকহোল্ডাররা অংশ নিয়েছেন।

জাহাজভাঙ্গা শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন ফোরামের আহবায়ক তপন দত্তের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন ফোরামের যুগ্ন আহবায়ক এ এম নাজিম উদ্দিন, চট্টগ্রাম বিভাগীয় শ্রম দপ্তরের পরিচালক অফিফা বেগম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শাহিন চৌধুরী, পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম জেলার উপপরিচালক ফেরদৌস আনোয়ার, চট্টগ্রাম বিভাগীয় শ্রম দপ্তরের সহকারী পরিচালক শফিকুর রহমান প্রমুখ।

জাহাজ ভাঙা শিল্প শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য নিরাপত্তা বিষয়ক এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ২০১৫ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এই ৯ বছরে ১২২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৫ সালে ১৬ জন, ২০১৬ সালে ১৮ জন, ২০১৭ সালে ১৯ জন, ২০১৮ সালে ১৩ জন ও ২০১৯ সালে ২৩ জন। তার মানে ২০১৫ সাল থেকে ক্রমান্বয়ে শ্রমিকের মৃত্যু বেড়েছে জাহাজ ভাঙা শিল্পে। তবে এরপর থেকে কমেছে। ২০২০ সালে ১০ জন, ২০২১ সালে ৯ জন, ২০২২ সালে ৭ জন, ২০২৩ সালেও ৭ জন। এই ৯ বছর গড়ে ১৩.৫৫ জনের মৃত্যু হয়।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে নিহত শ্রমিকদের গড় বয়স ৩৭.৭৭ বছর। নিহতদের মধ্যে ৩ জন কাটারম্যান, ২ জন ফিটারম্যান, ১ জন ওয়্যার গ্রুপ শ্রমিক এবং ১ জন ইলেক্ট্রিশিয়ান। নিহতদের মধ্যে ৩ জনের পরিবার ৭ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন। ১ জনের পরিবার ৬ লক্ষ টাকা পেয়েছেন। বাকি ৩ জনের পরিবার ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন বলে জানা গেছে তবে টাকার পরিমাণ জানা যায়নি।

ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত ট্রেড ইউনিয়ন সুপারিশ হিসেবে আইএলও কনভেনশন ১২১, মারাত্মক দূর্ঘটনা আইন ১৮৫৫ এবং উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ক্ষতিপূরণের ন্যূনতম মানদণ্ড নির্ধারণ জরুরী।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে আহত শ্রমিকেরা আহত হওয়ার পর প্রথমবার মালিক কর্তৃক চিকিৎসা পেলেও পরবর্তীতে চিকিৎসার জন্য মালিকের নাগাল পান না। অনেক ক্ষেত্রে যোগাযোগ করাও দুস্কর হয়ে পড়ে। ফলে অধিকাংশ আহত শ্রমিক ফলোআপ চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকেন বলে অভিযোগ আছে। অথচ শ্রম আইন অনুযায়ী আহত হয়ে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় সর্ব্বোচ্চ ১ বছর পর্যন্ত মজুরিসহ ছুটি পাওয়া মালিকের খরচে চিকিৎসা পাওয়া প্রত্যেক আহত শ্রমিকের অধিকার রয়েছে। আহত শ্রমিকেরা স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে গেলে ২.৫ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ পাওয়া আইনের বিধান রয়েছে।

এতে ২০২৩ সালে আহত শ্রমিকদের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে জাহাজ ভাঙা শিল্পে ২০২৩ সালে মোট ৩৫ টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। তন্মেধ্যে ৭টি দুর্ঘটনায় ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর ২৮টি দুর্ঘটনায় ২৯ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে ৭ জনের পা ভেঙে গেছে, ২ জন মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন, ২ জনের হাত ভেঙে গেছে, আগুনে পুড়ে আহত হয়েছেন ৩ জন, মালামাল আনলোডিং করার সময় আহত ২ জন ও মাইনরড ইনজুরড হয়েছেন ১৩ জন।

প্রতিবেদনে বলা হয় জাহাজ ভাঙা শ্রমিকদের নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র না দিয়ে এবং লাইসেন্স বিহীন অদক্ষ ঠিকাদারদের অধীনে শ্রমিক নিয়োগ দেয়া হয় বিধায় শ্রমিকেরা প্রতিনিয়ত বঞ্চনার শিকার হয়। ঠিকাদারদের দায় মালিক পক্ষ প্রায়শ: অস্বীকার করে। শ্রমিকদের সবেতনে ছুটি দেওয়া হয় না৷ ২০১৮ সালে ঘোষিত নিন্মতম মজুরি আজও বাস্তবায়ন হয়নি৷ অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার নাই। ঠিকাদারদের অধীনের নিয়োজিত শ্রমিকেরা অনেক সময় কাজের মজুরিও পায় না। প্রায়শ: শ্রমিকদেরকে মৌখিক নির্দেশে চাকরিচ্যুত করা হয়।

তবে ২০২৩ সালের জুন মাসে বাংলাদেশের হংকং কনভেনশন অনুস্বাক্ষর এবং পিএইচপি শিপ রিসাইক্লিংসহ আরও ৩ টি শিপ ইয়ার্ড গ্রীন ইয়ার্ডে রুপান্তর হওয়ায় জাহাজ ভাঙা শিল্পে নতুন প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

পাশাপাশি বলা হয় এসব গ্রীণ শিপ ইয়ার্ডে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে বড় সংখ্যক শ্রমিক চাকুরীচ্যুত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।  এসব চাকুরীচ্যুত শ্রমিকদের বিকল্প কর্মসংস্থান না হলে আবার নতুন করে সামাজিক সংকট তৈরি করবে।

প্রতিবেদনে শিল্পের সামগ্রিক উন্নয়নে শ্রমিকদের জন্য বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণ, কোন দুর্ঘটনা ঘটলে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার মত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত টীম তৈরি করা, শ্রমিকদেরকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে পর্যাপ্ত এ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করা, শ্রমিকদের জন্য যুগোপযোগী মজুরি নিশ্চিত করা, শ্রমিকদের নিয়োগপত্র-পরিচয়পত্র প্রদান নিশ্চিত করা, শ্রমিকদের চাকরী স্থায়ী করা, দৈনিক ৮ ঘন্টার অতিরিক্ত কাজ না করানো এবং শ্রম বিধিমালা অনুসরণ করে প্রতি ঘন্টা অন্তর ১৫ মিনিট বিশ্রাম নিশ্চিত করাসহ সাতটি সুপারিশ করা হয়।