নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার দিন বিএনপি কার্যালয়ের সামনে নিরাপত্তা বাহিনী
নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার দিন বিএনপি কার্যালয়ের সামনে নিরাপত্তা বাহিনী

বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আগামী আঠারই ডিসেম্বর থেকে ‘নির্বাচনী কাজে বাধা হতে পারে’ এমন সভা সমাবেশ বা অন্য যে কোনও প্রকার রাজনৈতিক কর্মসূচি থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দিয়েছে।

নির্বাচন কমিশনের এক চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ বৃহস্পতিবার এক বিজ্ঞপ্তিতে এই নির্দেশনার কথা জানিয়েছে। ১৮ই ডিসেম্বর থেকে এবারের সংসদ নির্বাচনের প্রার্থীদের প্রচারণা শুরুর কথা।

বিরোধী দল বিএনপি এ সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করে অবিলম্বে এটি প্রত্যাহার করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে তাদের চলমান আন্দোলন আরও বেগবান করার ঘোষণা দিয়েছে।

দলটির একজন নেতা বিবিসিকে বলেছেন, “দেশে কি জরুরি অবস্থা জারি হচ্ছে? কারণ কেবলমাত্র মার্শাল ল বা জরুরি অবস্থার সময়েই সভা সমাবেশের সাংবিধানিক অধিকার এভাবে স্থগিত করা হয়।”

একজন নির্বাচন বিশ্লেষক বলছেন নির্বাচনকে সামনে রেখে সভা সমাবেশের অধিকার খর্ব করতে “এমন ভাষায় বিজ্ঞপ্তি দেয়া নজিরবিহীন”।

প্রসঙ্গত, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এমন সময় এই বিজ্ঞপ্তি জারি করলো যখন বিএনপি ও সমমনা দলগুলো নির্বাচন বর্জন করে আঠারই ডিসেম্বর থেকে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আরও রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণার কথা বলে আসছে।

গত আটাশে ডিসেম্বর ঢাকায় দলীয় মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর থেকেই বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো তাদের ভাষায় ‘একতরফা নির্বাচনের’ প্রতিবাদে এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ধারাবাহিকভাবে হরতাল অবরোধ পালন করে আসছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তি
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তি

কী আছে বিজ্ঞপ্তিতে, ইসি কী চেয়েছিলো

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী ১৮ই ডিসেম্বর থেকে আগামী সাতই জানুয়ারি ভোটগ্রহণ সমাপ্ত হওয়ার পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত সভা সমাবেশের ওপর বিধি নিষেধ কার্যকর হবে।

অর্থাৎ এ সময়কালে কোন ধরণের সভা সমাবেশের অনুমতি কেউ আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে পাবে না।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে , “১৮ই ডিসেম্বর ২০২৩ তারিখ হতে ভোটগ্রহণ সমাপ্ত হওয়ার পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত নির্বাচনী প্রচার প্রচারণা ব্যতীত নির্বাচনী কাজে বাধা হতে পারে বা ভোটারগণ ভোটপ্রদাণে নিরুৎসাহিত হতে পারে এরূপ কোন প্রকার সভা সমাবেশ বা অন্য কোন ধরণের রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা থেকে সকলকে বিরত রাখার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো”।

এর আগে গত ১২ই ডিসেম্বর এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছিলো নির্বাচন কমিশন।

এতে বলা হয়েছিলো “দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণের দিন ০৭ই জানুয়ারি ২০২৪ তারিখে ধার্য্য করা হয়েছে। ১৮ই ডিসেম্বর থেকে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের প্রচারণা শুরু হবে। ১৮ই ডিসেম্বর তারিখ হতে ভোটগ্রহণ সমাপ্ত হওয়ার পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত নির্বাচনী প্রচার প্রচারণা ব্যতীত নির্বাচনী কাজে বাধা হতে পারে বা ভোটারগণ নিরুৎসাহিত হতে পারে এরূপ কোন প্রকার সভা সমাবেশ বা অন্য কোন প্রকার রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা থেকে সকলকে বিরত রাখা বাঞ্ছনীয়।”

কমিশনের এই চিঠি পাওয়ার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সাংবাদিকদের বলেছিলেন তারা কমিশনের নির্দেশ অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

নির্বাচন কমিশন যা বলেছিলো
নির্বাচন কমিশন যা বলেছিলো
নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে সরকার পতনের এক দফা কর্মসূচিতে আছে বিএনপি।
নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে সরকার পতনের এক দফা কর্মসূচিতে আছে বিএনপি।

নিষেধাজ্ঞার তাৎপর্য কী

নির্বাচন বিশ্লেষক ও বেসরকারি সংস্থা জানিপপের চেয়ারম্যান প্রফেসর নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বিবিসি বাংলাকে বলছেন দেশের চারটি প্রধান রাজনৈতিক দলের দুটিই নির্বাচন বর্জন করছে এবং তারা ইতোমধ্যেই আঠার ডিসেম্বর থেকে তাদের পরবর্তী ধাপের আন্দোলনের কর্মসূচির কথা জানিয়েছে।

“নির্বাচনে অংশ নেয়া বা না নেয়া দলগুলোর অধিকার। কেউ যেমন অংশগ্রহণের পক্ষে থাকতে পারে আবার কেউ বিপক্ষেও থাকতে পারে। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের অধিকার সবার আছে। কেউ আইন নিজের হাতে না নিলে তাকে বাধা দেয়ার সুযোগ আইনত নেই। এ কারণেই নির্বাচন কমিশন ও সরকারের এ পদক্ষেপকে আমি নজিরবিহীন বলছি,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

প্রসঙ্গত, বিএনপি ও জামায়াত ইতোমধ্যেই সাতই জানুয়ারির নির্বাচনকে প্রত্যাখ্যান করে এর বিরুদ্ধে ধারাবাহিক হরতাল অবরোধের কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে।

বিএনপি নির্বাচন কমিশনের এ উদ্যোগের তীব্র সমালোচনা করে অবিলম্বে এ ধরণের নির্দেশনা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে।

দলের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “সভা-সমাবেশ ব্যাহত করে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ও দাবি আদায়ের সংগ্রামের বিরুদ্ধে যে অবস্থান নিয়েছে নির্বাচন কমিশন, আমরা আশা করছি, দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে তাঁরা এটি প্রত্যাহার করবেন”।

“নির্বাচনকে বর্জন করেছে বিএনপি’সহ ৬৩টি রাজনৈতিক দল। ১২ কোটি ভোটারের ভোটের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে, নির্বাচন কালীন নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে, আমাদের এই শান্তিপূর্ণ ও ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন অব্যাহত থাকবে, আরও বেগবান হবে,” ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছে।

নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে হরতাল অবরোধের কর্মসূচি পালন করছে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো
নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে হরতাল অবরোধের কর্মসূচি পালন করছে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো

জরুরি অবস্থা জারি হচ্ছে কি না, বিএনপি নেতার প্রশ্ন

দলটির আইন বিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামাল বিবিসি বাংলাকে বলছেন সাধারণত মার্শাল ল কিংবা জরুরি অবস্থার সময় সভা সমাবেশের সাংবিধানিক ও মৌলিক অধিকার স্থগিত করার ঘটনা আগে ঘটেছে।

“সংবিধান প্রতিটি নাগরিকদের সভা সমাবেশসহ রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করেছে। সরকারের এ পরিপত্র সম্পূর্ণ বেআইনি ও অসাংবিধানিক। আমার প্রশ্ন দেশে কি জরুরি অবস্থা জারি হতে চলেছে, কারণ সাংবিধানিক অধিকার স্থগিত করার ঘটনা সাধারণত মার্শাল ল বা জরুরি অবস্থা ঘোষণার সময় দেখা যায়!”, বলছিলেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার বলছেন সরকারের বিজ্ঞপ্তিতে অনেক অস্পষ্টতা আছে কারণ নির্বাচনের পক্ষে বা বিপক্ষে মতামত প্রকাশ করা যাবে না কেন?

তাঁর কথায়, “নির্বাচনের ট্রেন চলতে শুরু করেছে। এটা এখন গন্তব্যমুখী। যাদের ভালো লেগেছে তারা ট্রেনে চড়েছেন। যাদের পছন্দ হয়নি, তারা বিরত থেকেছেন। কেন পছন্দ হয়নি তা তারা বলতে থাকলে আমি কোনও অসুবিধা দেখি না। সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও উৎসবমুখর নির্বাচন হওয়াটাই এখন বড় কথা। যারা নির্বাচন পছন্দ করছেন না, তাদের মুখ বন্ধ করাটা আদৌ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়!”

তবে সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ বলছেন নির্বাচন কমিশন নির্বাচনকালীণ সময়ে নির্বাচনকে ব্যাহত করতে পারে এমন কর্মসূচির অনুমতি না দিতে বলেছে ।

“আমার মনে হয় এটুকু পর্যন্ত ঠিক আছে। কারণ এমনিতেই হরতাল অবরোধসহ নানা কারণে কিছু সমস্যা তৈরি হয়েছে। অনেকে নির্বাচন ব্যাহত করার কথা বলেছেন। সেজন্য মানুষ যাতে নির্বিঘ্নে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে সেজন্য হয়তো তারা এই চিন্তা করেছে।”

যদিও বিএনপি নেতা কায়সার কামাল বলছেন সংবিধান ও আইনকে অমান্য করে এমন বিধিনিষেধ জনগণের ভোটাধিকারকে হরণ করার জন্যই করা হচ্ছে বলে তিনি মনে করেন।

বিএনপির দলীয় বিবৃতিতেও বলা হয়েছে, “নির্বাচন বর্জনকারী প্রতিটি দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলের একটিই লক্ষ্য, সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে হলেও, জনগণকে সাথে নিয়ে, আমরা শীঘ্রই জনগণের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করবো।”