মতামত

তাজরীন ফ্যাশন ট্র্যাজেডি এবং বাংলাদেশের শ্রম খাত

-ফজলুল কবির মিন্টু

ফজলুল কবির মিন্টু (ফাইল ছবি)

২৪ নভেম্বর, ২০১২ তারিখে, বাংলাদেশের ঢাকায় তাজরিন ফ্যাশন নামে একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে একটি বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ড ঘটে, যার ফলে শত শত শ্রমিক মারা যায় এবং দেশের ক্রমবর্ধমান পোশাক শিল্পের মধ্যে উদ্বেগজনক নিরাপত্তা সমস্যাগুলিকে তুলে ধরে।  তাজরীন ফ্যাশন দুর্ঘটনার পূর্বেও বাংলাদেশের পোশাক খাতে আরো বেশ কিছু দুর্ঘটনা ঘটেছিল কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ঐসকল দুর্ঘটনাকে রাষ্ট্র বা মালিকপক্ষ খুব বেশি গুরুত্ব সহকারে আমলে নেয়নি বরং লক্ষ করা গেছে, এইরকম একটি মারাত্মক ও মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পরেও এরজন্য দায়ি মালিক পক্ষ বা সংশ্লিষ্ট সরকারী দপ্তরের কর্মকর্তা কাউকেই জবাবদিহিতার আওতায় আনা যায়নি। যার ফলশ্রুতিতে এমন ভয়াবহতম দুর্ঘটনার মাত্র পাঁচ মাস পরে বাংলাদেশ এবং বিশ্ব প্রত্যক্ষ করলো বিশ্বের আরো ভয়াবহতম দুর্ঘটনা তথা রানা প্লাজা ধ্বস। যেখানে এগার শতাধিক শ্রমিক নিহত হয়। রানা প্লাজা ধ্বসের পর কার্যত বাংলাদেশে কোন ন্যায় বিচার আদৌ আছে কিনা তা নিয়ে ব্যাপকভাবে প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল।

তাজরীন ফ্যাশন ছিল একটি বহুতল বিশিষ্ট পোশাক কারখানা -যেখানে কয়েক হাজার শ্রমিক কাজ করতো। যারা মূলত ইউরোপ আমেরিকাসহ উন্নত বিশ্বের মানুষের পোশাকের  চাহিদা মিটানোর কাজে নিজেদের নিয়োজিত রেখেছিল। ঘটনার বিবরনে জানা যায়, তাজরীন ফ্যাশনে আগুন প্রথমে নীচ তলায় লেগেছিল পরবর্তীতে তা সমগ্র কারখানা ভবনে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং উপরের তলায় অবস্থানকারী শ্রমিকেরা ভবনে আটকা পড়েছিল। অপর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা, বাহির হওয়ার পথে তালা লাগিয়ে বন্ধ করে রাখা এবং নিয়মিত ফায়ার ড্রিল না করা ইত্যাদি কারনে কারখানাটি কার্যত মৃত্যুফাঁদে পরিনত হয়েছিল। পরের ঘটনাটি ছিল তাই ভয়ংকর এক বাস্তবতা। আগুনে পুড়ে যাওয়া অনেকের লাশ পর্যন্ত সনাক্ত করা যায় নি। পরবর্তীতে ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে লাশের পরিচয় মিলাতে হয়েছে। এরচেয়ে চরম দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে?

মালিকের লাভ এবং লোভের কাছে শ্রমিকের জীবনের নিরাপত্তা গ্রাস হয়ে গেল। এমনকি নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে মালিক এবং সংশ্লিষ্ট সরকারী দপ্তরের কর্মকর্তাদের সুস্পষ্ট অবহেলা প্রমানিত হওয়া সত্ত্বেও কাউকে জবাবদিহির আওতায় আনতে না পারা ছিল যেন তারচেয়েও মর্মান্তিক ও হতাশাজনক। জবাবদিহিতার অভাবের এই সংস্কৃতি কেবল ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিক এবং শ্রমিক পরিবারের ক্ষতই গভীর করেনি বরং সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি বিপজ্জনক বার্তাও পৌছে গিয়েছিল -তা হচ্ছে, এদেশের মালিক পক্ষ এবং দুর্নীতিবাজ সরকারী কর্মকর্তারা সকল প্রকার জবাবদিহিতার উর্ধে এবং তারা ধরাছোঁয়ার সম্পূর্ণ বাইরে থাকে।

একথা সত্য যে, তাজরীন ফ্যাশন দুর্ঘটনায় সমগ্র বিশ্ব যখন শোকে আচ্ছন্ন তখনো কিন্তু পোশাক শিল্পে ইতিবাচক পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ক্রমবর্ধমান আলোচনা ছিল। শ্রম অধিকার কর্মী, এনজিও এবং সচেতন নাগরিক সমাজ উন্নত কর্ম পরিবেশ, কর্মক্ষেত্রের কঠোর নিরাপত্তার প্রবিধান এবং নৈতিক অনুশীলনের ব্যাপারে আহ্বান জানিয়ে আসছিলেন। কিন্তু এ আহ্বাণ কেউ আমলে নেয়নি বরং ঘটনা উল্টো ঘটেছিল অর্থাৎ শ্রম শোষণ চর্চা অব্যাহত ছিল এবং তা এখনো বিদ্যমান। তাজরীন ফ্যাশন দুর্ঘটনার মাত্র পাঁচ মাসের মধ্যে রানা প্লাজা ধ্বস, নারায়নগঞ্জের সেজান জুস কারখানায় আগুন, চট্টগ্রামের বাঁশখালির গন্ডামারায় এস আলম গ্রুপের কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে পুলিশের গুলিতে শ্রমিকের মৃত্যু, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে বি এম কন্টেইনারে দুর্ঘটনায় শ্রমিকের মৃত্যু এবং সীমা অক্সিজেন প্লান্টে দুর্ঘটনায় শ্রমিকের মৃত্যু যেন আমাদেরকে সে বিষয়টিকেই মনে করিয়ে দেয়।

আমাদের দেশের শ্রমিক শোষণ নানা মাত্রিক উপায়ে হয়ে থাকে। কর্মক্ষেত্রে পেশাগত স্বাস্থ্য নিরাপত্তার ঘাটতি,  আইএলও’র প্রথম কনভেনশন অমান্য করে আট ঘন্টার অতিরিক্ত কাজ করতে বাধ্য করা, আইএলও কনভেনশন ৮৭ ও ৯৮ অমান্য করে নানা আইনী প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার অধিকার ও ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা এবং শ্রমিকদের জীবনধারন উপযোগী যৌক্তিক মজুরি প্রদান না করা ইত্যাদি তারমধ্যে অন্যতম। সর্বশেষ পোশাক শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনে চারজন অসহায় শ্রমিক নিহত হওয়ায় এর সত্যতা পাওয়া যায়।

পরিশেষে বলতে চাই, শিল্প হচ্ছে একটি দেশের অর্থনৈতিক মূল চালিকা শক্তি আর শিল্পের শক্তি শ্রমিক। সুতরাং শ্রমিক শোষণ করে কিংবা শ্রমিকের অধিকার সমূহকে অবজ্ঞা করে সাময়িক লাভবান হওয়া হওয়া গেলেও চূড়ান্ত বিচারে শিল্পের ভবিষ্যতকে ঝুঁকিতে ফেলে দেয়। আমাদের আরো মনে রাখতে হবে এদশের প্রধান রপ্তানী খাত পোশাক শিল্প। আবার পোশাক শিল্পের প্রধান বাজার ইউরোপ এবং আমেরিকা। সুতরাং বাংলাদেশের শ্রম খাত সম্পর্কে যে কোন ধরনের নেতিবাচক ইস্যু এদেশের পোশাক খাততে সংকটে ফেলতে পারে -বিষয়টি আমরা যত দ্রুত বুঝবো ততই আমাদের মঙ্গল। তাই ভবিষতের বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি শ্রমিকের সকলে অধিকার বাস্তবায়নে রাষ্ট্র আন্তরিক হবে এমনটি কাম্য।

লেখকঃ কো-অর্ডিনেটর, ওশ সেন্টার, বিলস-ডিটিডিএ প্রকল্প এবং সংগঠক, কেন্দ্রীয় কমিটি, টিইউসি