মতামত

জাস্ট ট্রানজিশন এবং বাংলাদেশের জাহাজভাঙা শিল্প

-ফজলুল কবির মিন্টু

ফজলুল কবির মিন্টু (ফাইল ছবি)

বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী চট্টগ্রাম যেন সৃষ্টিকর্তার এক অপার দান। অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্বীকৃতি স্বরূপ চট্টগ্রামকে প্রাচ্যের রাণীও বলা হয়। চট্টগ্রামেরই একটি উপজেলা সীতাকুন্ড। এ উপজেলার পূর্ব দিকে পাহাড় আর পশ্চিমে সাগর যেন সৌন্দর্যের অনন্য মাত্রা যোগ করেছে। এই রকম এক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত ও নয়ানাভিরাম অঞ্চলে ফৌজদারহাট  থেকে কুমিরা পর্যন্ত গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের একমাত্র এবং বিশ্বের অন্যতম প্রধান শিপ ব্রেকিং শিল্প।

দেশের অর্থনীতি উন্নয়নের ভিত রচনায় এই শিল্প দীর্ঘদিন যাবত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। তবে পরিবেশ রক্ষা এবং শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান, নিরাপদে ও স্বাস্থ্য সম্মতভাবে জাহাজভাঙা ইত্যাদি নানাবিধ বিষয়ে সচেতন নাগরিক সমাজ এবং শিল্প সংশ্লিষ্ট বিভিন্নপক্ষ থেকে শিল্পের মালিকদের উপর ব্যাপক চাপও রয়েছে। এই নিবন্ধে আমরা বাংলাদেশের শিপ ব্রেকিং শিল্পের প্রেক্ষাপটে ‘জাস্ট ট্রানজিশন’ ধারণা অন্বেষণ করবো এবং কীভাবে এ শিল্পকে আরো টেকসই ও ন্যায়সংগত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নেয়া যায় তা আলোচনা করার চেষ্টা করবো।

অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং পরিবেশগত চ্যালেঞ্জঃ বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত রচনায় যে কয়েকটি খাতের ভূমকা আছে তন্মধ্যে শিপ ব্রেকিং খাতও অন্যতম। এই শিল্প প্রত্যক্ষভাবে প্রায় বিশ হাজার এবং পরোক্ষভাবে লক্ষাধিক শ্রমিকের জীবিকা প্রদান করে দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। এখানে পুরাতন ও অচল হয়ে যাওয়া জাহাজগুলো ভেঙে ফেলে এর মূল্যবান ধাতু সমূহ পুণঃব্যবহারযোগ্য করে গড়ে তোলা হয়। ফলে জাহাজভাঙা শিল্প দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভালভাবেই ভূমিকা রেখে চলেছে।

এত কিছুর পরেও দিনশেষে জাহাজভাঙা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ, অপর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং মারাত্মক পরিবেশগত অবনতিসহ বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত একটি শিল্প। জাহাজভাঙার সাথে যুক্ত সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, জাহাজভাঙার সময় উৎপন্ন বর্জ্যসমূহের নিরাপদ , পরিবেশসম্মত ও স্বাস্থ্যসম্মতভাবে ব্যবস্থাপনা এবং জাহাজভাঙা কার্যক্রমে যুক্ত শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এসবেস্টস, পিসিবি এবং ভারী ধাতুর মত বিপজ্জনক পদার্থ শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের জন্য এবং আশেপাশের পরিবেশের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করে। এই শিল্পের কর্মকান্ডের কারনে উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্রের ব্যাপক দূষণও ঘটছে –যা স্থানীয় সম্প্রদায়ের জীবিকা নির্বাহের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

জাস্ট ট্রানজিশন ধারনাঃ জাস্ট ট্রানজিশন হল পরিবেশগত, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ইস্যু সমূহের অস্থিতিশীল ও অন্যায্য অবস্থা থেকে টেকসই, স্থায়ী এবং ন্যায়সংগতভাবে রূপান্তর ঘটানোর প্রক্রিয়া। বাংলাদেশে জাহাজভাঙার প্রেক্ষাপটে, একটি ন্যায্য রূপান্তর মানে আরও পরিবেশগতভাবে দায়িত্বশীল এবং সামাজিকভাবে ন্যায়সঙ্গত শিল্পের দিকে যাত্রা। জাহাজভাঙা শিল্পে জাস্ট ট্রানজিশন বাস্তবায়নে নিম্নের চারটি বিষয়ের উপর বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে হবেঃ

১) পরিবেশগত সুরক্ষা: বাস্তুতন্ত্রের দীর্ঘমেয়াদ ও স্থায়িত্ব নিশ্চিত করার জন্য, একটি ন্যায্য পরিবর্তনের লক্ষ্যে পরিবেশ বান্ধব কার্যক্রম অনুশীলনের মাধ্যমে বিপজ্জনক বর্জ্য নিষ্পত্তি, পরিচ্ছন্ন প্রযুক্তির বাস্তবায়ন এবং পরিবেশগত প্রভাব ও ফলাফলের বিষয়ে কঠোর প্রবিধান মেনে চলতে হবে।

২) শ্রমিক অধিকার এবং নিরাপত্তা: শ্রমিকদের কল্যাণের উপর জোর দিতে হবে। এখানে শ্রমিক কল্যাণ বলতে শ্রম অধিকার, কর্মক্ষেত্র ও কাজের অবস্থার উন্নতি, সঠিক প্রশিক্ষণ এবং স্বাস্থ্যসেবার কথা বুঝানো হয়েছে। শিপব্রেকিং শিল্পের শ্রমিকরা প্রায়ই বিপজ্জনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। তাদের অধিকার এবং নিরাপত্তা রক্ষা করার মাধ্যমেই একটি ন্যায্য পরিবর্তন নিশ্চিত করা সম্ভব

৩) স্থানীয় সম্প্রদায়ের উন্নয়ন: শিপব্রেকিং শিল্প এলাকায় বসবাসরত স্থানীয় সম্প্রদায়ের শিল্পের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে উপকৃত হওয়া উচিত। একটি ন্যায্য পরিবর্তনের মধ্যে এমন উদ্যোগ জড়িত যা সম্প্রদায়ের উন্নয়নে অবদান রাখে, যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং অবকাঠামোগত উন্নতি।

৪) অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য: শিপব্রেকিং থেকে অন্যান্য টেকসই শিল্পে রূপান্তর একটি ন্যায্য পরিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক -এর মধ্যে নবায়নযোগ্য শক্তি, পর্যটন বা জলজ চাষে বিনিয়োগ অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে, যা শিল্পের রূপান্তর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে।

চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগঃ  জাস্ট ট্রানজিশন ধারণাটি জাহাজ ভাঙা শিল্পের ন্যায় সঙ্গত পরিবর্তনের জন্য একটি রোডম্যাপ। তবে এই রোডম্যাপ বাস্তবায়নে কিছু উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জও রয়েছে, সেগুলি অতিক্রম করা খুবই জরুরী। উল্লেখ্য যে, জাস্ট ট্রানজিশন বাস্তবায়নে রাজনৈতিক স্বদিচ্ছা, সংশ্লিষ্ট সরকারী নিয়ন্ত্রক সংস্থা সমূহ কর্তৃক নির্মোহ এবং নিরপেক্ষভাবে আইন প্রয়োগ এবং সুস্থ্য ধারার ও সহযোগিতামূলক শিল্প সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ । উপরন্তু, নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ এবং বিকল্প শিল্পের বিকাশের সুবিধার্থে আর্থিক সংস্থানেরও প্রয়োজন রয়েছে।

বাংলাদেশে বর্তমানে ৪টি শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড গ্রীন শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। আরও বেশ কিছু শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড গ্রীন শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড হিসাবে স্বীকৃতি লাভের অপেক্ষায় রয়েছে। দেশে বর্তমানে গ্রীন শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড গড়ে তোলার যে প্রবনতা লক্ষ করা যাচ্ছে তাতে জাহাজভাঙা শিল্পের ন্যায় ভিত্তিক উত্তরণ তথা জাস্ট ট্রানজিশন বাস্তবায়নে ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। গ্রীন শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে পরিবেশগতভাবে বর্জ্য এবং দূষন হ্রাসের মাধ্যমে শিপ ব্রেকিং কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ফলে দেশে যদি ব্যাপকহারে গ্রিন শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড বৃদ্ধি পায় তাহলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিবেশগত ও স্বাস্থ্যসম্মতভাবে এবং নিরাপদ-টেকসই জাহাজভাঙা কার্যক্রমে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে-যার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের জাহাজভাঙা শিল্পের একটি ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হবে। এতে আন্তর্জাতিক সমর্থন ও সহযোগিতা বৃদ্ধি পাবে। ফলশ্রুতিতে জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও), ইন্টারন্যশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশন (আইএমও) এর মতো সংস্থাগুলির এবং পুরাতন জাহাজভাঙার সংশ্লিষ্ট দেশ সমুহের দায়বদ্ধ অনুশীলনের মাধ্যমে শ্রমিকদের কল্যাণে প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধিসহ শিল্পের সার্বিক উন্নয়নে আর্থিক সহায়তা পাওয়ার সুযোগ সৃষ্ট হতে পারে –যা জাহাজভাঙা শিল্পকে টেকসই করতে ভূমিকা রাখবে।

উপসংহারে বলা যায়, বাংলাদেশের জাহাজভাঙা শিল্প এখনো একটি উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে। জাহাজভাঙা শিল্প মালিকদের সামনে দুটি পথ এখন উম্মুক্ত -এটি হয় পরিবেশগত অবক্ষয় এবং কর্মীদের শোষণের পক্রিয়া চালিয়ে যেতে পারে, অথবা এটি আরও টেকসই এবং ন্যায়সঙ্গত ভবিষ্যতের দিকে একটি ন্যায় ভিত্তিক উত্তরনকে গ্রহণ করতে পারে –যা হবে একদিকে পরিবেশগতভাবে দায়িত্বশীল অনুশীলন এবং অন্যদিকে শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতি, এলাকার উন্নয়নে বিনিয়োগ ও অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য আনয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ জাহাজ ভাঙা শিল্পের ন্যায় ভিত্তিক রূপান্তরের পথে নেতৃত্ব দেয়া।

আমাদের মনে রাখতে হবে, জাস্ট ট্রানজিশন ধারণা শুধুমাত্র পরিবেশের উন্নয়নের কথা বলে না বরং শিল্পের শ্রমিকদের মঙ্গল এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের সমৃদ্ধির মাধ্যমে সামাজিক ন্যায় বিচার নিশ্চিত করার কথাও বলে। সুতরাং জাস্ট ট্রানজিশন বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের শিপব্রেকিং শিল্পের জন্য একটি উজ্জ্বল এবং আরও মানবিক, উন্নত ও টেকসই ভবিষ্যতের দিকে যাত্রা করার এখনই উপযুক্ত সময়।

লেখকঃ কো-অর্ডিনেটর, ওশ সেন্টার, বিলস-ডিটিডিএ প্রকল্প এবং সংগঠক, টিইউসি, কেন্দ্রীয় কমিটি