চলমান সংবাদ

পিপিপিতে বড় প্রকল্প কতটা যৌক্তিক বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে

 

ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের একাংশ উদ্বোধন করলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

বাংলাদেশে চার বছরের মধ্যে কাজ শেষ করা হবে – এমন পরিকল্পনা নিয়ে ২০০৯ সালে পিপিপি’র অধীনে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ শুরু হলেও এক যুগেরও বেশি সময় পর তার একাংশ উদ্বোধনের পর একটি বড় প্রশ্ন উঠছে যে – পিপিপি’র প্রকল্প বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কতটা যৌক্তিক।

বিশ্লেষকরা বলছেন পিপিপি বা ‘পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ’ আইডিয়া হিসেবে ভালো – কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতা বা প্রেক্ষাপটে এটিকে সফল করে তোলা কঠিন।

কারণ এখানে চুক্তি করার অনেক সময় খুঁটিনাটি এমন অনেক শর্ত রাখা হয় যা পরবর্তীতে দেশের জন্য ক্ষতিকর হয়ে ওঠে।

আবার সঠিক প্রজেক্ট ও বিনিয়োগকারী বাছাই করা এবং তাদের সাথে যথাযথ দরকষাকষি করে দেশের স্বার্থ সংরক্ষিত রেখে চুক্তি করে প্রকল্পটি নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখার জন্য দক্ষ ব্যবস্থাপনা কিংবা ব্যবস্থাপনার দক্ষতার সংকট তীব্র হওয়ায় অনেক পিপিপি’র অধীনে নেয়া অনেক প্রকল্প নিয়েই বড় প্রশ্ন আছে।

পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলছেন, ২০১১/১২ সালের দিকে পিপিপি নিয়ে আশার সঞ্চার হয়েছিলো – কিন্তু পরবর্তীতে এ নিয়ে হতাশ হতে হয়েছে।

“আমরা চাইলে সব চাই। আবার দিলেও সব দিয়ে দেই। এর ফলে দেশের স্বার্থ বিঘ্নিত হয়। মোট কথা বিনিয়োগকারী কোম্পানিগুলোকে ডিল করার মতো দক্ষতা এখনো আসেনি। এ কারণেই ২০১২ সালের প্রকল্প ২০২৩ সালে এসে আংশিক উদ্বোধন করতে হয়। অথচ পুরো প্রজেক্টই শেষ হওয়ার কথা ছিলো ২০১৪ সালে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

প্রসঙ্গত, শনিবারই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের একাংশ উদ্বোধন করেছেন। অথচ শুরুর দিকের পরিকল্পনা অনুযায়ী কুতুবখালী পর্যন্ত পুরো প্রকল্পই শেষ হওয়ার কথা ছিলো আরও আট বছর আগে।

যদিও গত বছরের শেষ দিকে ঢাকায় ‘২০৪১ সালের লক্ষ্য অর্জনে পিপিপির ভূমিকা’ শীর্ষক এক আলোচনায় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেছিলেন যে বাংলাদেশে পিপিপি মডেল সফল হয়েছে।

তিনি বিদ্যুৎ খাতকে এর বড় উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করে বলেছিলেন এখন মোট বিদ্যুতের ৫৪ শতাংশই বেসরকারিখাতে উৎপাদন হচ্ছে।

যদিও বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে বেসরকারি কোম্পানিগুলোর সাথে করা চুক্তির কিছু শর্ত নিয়ে সবসময়ই তীব্র সমালোচনা হয়েছে। কিছু শর্ত শুধুই কোম্পানিগুলোকে অর্থ আয়ের সুযোগ করে দিয়েছে- এমন অভিযোগও আছে।

অবশ্য বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ বা সরকার সবসময়ই এ ধরণের অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে
চার বছরের জন্য নেয়া প্রকল্পটি এক যুগ পরে এসে আংশিক শেষ হলো।

পিপিপি ধারণা কীভাবে এলো

দেশে প্রথমবারের মতো ২০০৯ সালে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি বা পিপিপি মডেল চালু করা হয়েছিলো। মূলত বেসরকারি খাত থেকেই এ আইডিয়াটি নিয়েছিলেন প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত।

সে সময় পিপিপি’র ধারণা নিয়ে যারা এগিয়ে এসেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তখনকার ঢাকা চেম্বারের সভাপতি আবুল কাশেম খান।

তিনি বিবিসি বাংলাকে বলছেন যে তারা যে লক্ষ্য নিয়ে এ আইডিয়াটি সামনে এনেছিলেন তা হলো- দেশী বিদেশী বিনিয়োগকারীদের নিয়ে এসে বড় বড় অবকাঠামোর কাজ হবে যাতে করে দেশের অর্থনীতির জন্য দরকারি বড় প্রকল্পগুলোতে সরকারকে বেশি অর্থ বিনিয়োগ না করতে হয়।

পিপিপিতে বড় বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করতে কর অবকাশ সুবিধাসহ আরও কিছু সুবিধা দিয়ে যাচ্ছিলো সরকার। কিন্তু প্রত্যাশিত সাড়া না পেয়ে ২০২১ সালে ঢালাও সুবিধা দেয়ার এ চিন্তা থেকে কিছুটা সরে আসে সরকার।

ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ছাড়াও পিপিপি’র অধীনে চলমান প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে রামপুরা-আমুলিয়া-ডেমরা এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প, ঢাকা বাইপাস প্রকল্প, গাবতলী-সাভার-নবীনগর এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প, বিমানবন্দর তৃতীয় টার্মিনালের অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স, ইস্ট-ওয়েস্ট এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প।

চলতি বছরের জুন পর্যন্ত মোট প্রায় ৭৮টি প্রকল্প পিপিপির আওতায় চলমান থাকার কথা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এর পরে আর কোনো নতুন প্রকল্প এসেছে কি-না সেটি তারা জানাতে পারেনি।

পিপিপিতে বেশ কিছু উন্নয়নমূলক প্রকল্প আছে।
পিপিপিতে বেশ কিছু উন্নয়নমূলক প্রকল্প আছে।

বাংলাদেশের জন্য কতটা যৌক্তিক

বাংলাদেশে বিদেশী কোম্পানিগুলো সাথে চুক্তি করার সময় বরাবরই দেশের স্বার্থ ছাড় দেয়ার অভিযোগ ওঠে। আবার অনেক সময় এমনভাবে চুক্তির শর্ত ঠিক করা হয় যা দীর্ঘমেয়াদে দেশের জন্য ক্ষতিকর হয়ে ওঠে এমন উদাহরণও কম নয়।

নগর পরিকল্পনাবিদ ডঃ আদিল মুহাম্মদ খান বলছেন, পিপিপি চিন্তা হিসেবে ভালো কিন্তু দেখতে হবে কোথায় কোন পরিবেশে এটি হচ্ছে।

“যেমন ধরুন এই যে এক্সপ্রেসওয়ে হলো এটা কেন এতো ব্যয়বহুল হলো ? এখানে তো সরকারকে জমি অধিগ্রহণ করতে হয়নি। ব্যয়বহুল হয়েছে কারণ শুরুতেই যাদের কাজ দেয়া হলো তাদের যোগ্যতা ছিলোনা বলে তারা কাজই শুরু করতে পারেনি,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন। তিনি।

অর্থাৎ পিপিপিতে পার্টনার প্রতিষ্ঠান কারা হবে – এটা বাছাই করে নির্ধারণ করে তাদের কাজ দেয়াটা হলো গুরুত্বপূর্ণ।

তার মতে জনস্বার্থ বিবেচনা করে দুর্নীতিমুক্ত থেকে সঠিক পরিকল্পনা করা হয়নি বলেই পিপিপির অন্যতম প্রকল্প হানিফ ফ্লাইওভারেই এখন বিরাট যানজট দেখা যায়।

“অথচ এটি করা হয়েছিলো ওই এলাকার যানজট কমানোর জন্য। কিন্তু এখন ফ্লাইওভারেই যানজট লেগে থাকে। আবার সেখানে বিনিয়োগকারী কোম্পানিকে লাভবান করানোর জন্য ফ্লাইওভার দিয়ে বেশি যানবাহন যেতে বাধ্য করতে এর নীচের সড়ক অনেক জায়গাতে রীতিমত বন্ধ করে রাখা হয়েছে,” বলছিলেন মি. খান।

তার মতে যেখানে রাজনীতি ও পরিকল্পনা থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই দুর্নীতির একটা চক্র থাকে সেখানে পিপিপির প্রকল্প থেকে থেকে জনগণের জন্য বেনিফিট নিয়ে আসা কঠিন।

“গভর্ন্যান্স ঠিক না থাকলে যে কোনো মডেলই কাজ করে না বাংলাদেশের পিপিপি তারই একটা উদাহরণ। এখানে চুক্তিতেই কোম্পানি বা বিদেশী স্বার্থ রক্ষার কিছু প্রবণতা থাকে অনেকের মধ্যে। মোট কথা, দেশের জন্য খুব প্রয়োজনীয় না হলে এবং মানুষের জন্য ব্যবহার সহজ না হলে শুধু বিদেশীদের জন্য নেয়া হলে এ ধরণের প্রকল্প কাজে আসবে না,” বলছিলেন তিনি।

অথচ বেসরকারি খাত বারবার থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার উদাহরণ দিয়ে বলছে, পিপিপির মতো কার্যক্রমের আওতাতেই সেসব দেশে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো হয়েছে।

এমনকি পাশের দেশ ভারত সরকারি বেসরকারি অংশীদারিত্বে বন্দর পর্যন্ত নির্মাণ করেছে।

আবার ভুল পরিকল্পনার জন্য পিপিপির মতো মডেলে কাজ করে ক্ষতির শিকার হয়েছে আফ্রিকার অনেক দেশ।

বাংলাদেশের উন্নয়নখাতের কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প পিপিপিতে নেয়া হচ্ছে
বাংলাদেশের উন্নয়নখাতের কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প পিপিপিতে নেয়া হচ্ছে

বাংলাদেশের পিপিপি’র সংকট কোথায়

বেসরকারি খাতের নেতারা বলছেন এখন পিপিপি যাদের তত্ত্বাবধানে আছে তাদের যেমন সক্ষমতা নেই তেমনি ব্যবস্থাপনার নেই বিশেষজ্ঞ বা কারিগরি লোকবলও।

অথচ ব্যবসায়ীরা নেতারা সরকারকে বারবারই অনুরোধ করে আসছিলো যে যেসব দেশ পিপিপির মতো মডেলে সাফল্য পেয়েছে সেখান থেকে প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ নেয়ার জন্য।

“সক্ষমতা একেবারেই গড়ে উঠেনি। আবার এর গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো বেসরকারি খাত কিন্তু এ খাতকে পিপিপি ব্যবস্থাপনায় সম্পৃক্তই করা হয়নি,” বলছিলেন আবুল কাশেম খান।

“এখানে ভালো প্রজেক্ট অর্থাৎ যেখানে বিনিয়োগ করলে রিটার্ন আসবে তেমন প্রকল্প সরকারি খাত নিয়ে নেয় আর বাজে প্রকল্পগুলো পিপিপিতে দেয়া হয়। আকর্ষণীয় প্রকল্প না পেলে বিনিয়োগ আসবে কেন?”

আবার অনেক সময় সরকারি পরিকল্পনাও দুর্বল প্রকল্পকে লাভজনক করে তুলতে পারে- যার উদাহরণ চীন।

সেখানে কিছু ইকোনমিক জোন প্রকল্প লোকসান দিচ্ছিলো। কিন্তু এসব জোনকে ঘিরে চাঙ্গা হয়ে উঠেছিলো অন্য ব্যবসা।

এক পর্যায়ে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ওই ব্যবসার কর থেকে ইকোনমিক জোন প্রকল্পকে সহায়তা দিলো কারণ ওই জোনের কারণেই লাভজনক ব্যবসার পরিবেশ তৈরি হয়েছিলো।

আবুল কাশেম খান বলেন, এভাবেই সৃজনশীল আইডিয়া বের করে পিপিপির প্রকল্পগুলোকে সফল করতে হবে।

“সেজন্য একদিকে প্রকল্প হতে হবে বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করার মতো হতে হবে…আবার দেখতে হবে সেটা কতটা যৌক্তিক। দেশের জন্য কস্ট বেনিফিট হবে কি-না”।

আহসান এইচ মনসুর বলছেন পিপিপি থাকা উচিত কিন্তু এর নির্মোহ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে।

“এখানে দুর্নীতির কোনো সুযোগ রাখা যাবে না। মার্কেট রিয়েলিটি বুঝতে হবে। আবার জনস্বার্থ দেখতে হবে,” বলছিলেন তিনি।

#সূত্রঃ  বিবিসি বাংলা নিউজ