মতামত

গ্রীন শিপ ইয়ার্ডে শ্রমিক অধিকার উপেক্ষিত!

-ফজলুল কবির মিন্টু

ফজলুল কবির মিন্টু
সংগঠক, টিইউসি, কেন্দ্রীয় কমিটি

চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড উপজেলায় ফৌজদার হাট থেকে কুমিরা অঞ্চলের বঙ্গোপসাগরের উপকূলে বাংলাদেশের একমাত্র জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প অবস্থিত। বিশ্বের বেশীরভাগ বড় বড় জাহাজ বাংলাদেশেই ভাঙ্গা হয়। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং উন্নয়নে এ শিল্পের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। পরিবেশ বিপর্যয় এবং ইয়ার্ডে বিভিন্ন সময় দুর্ঘটনার কারনে শ্রমিকের নিহত-আহতের হার বেশি হওয়ায় জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পের একটি নেতিবাচক পরিচিতি থাকলেও এ সেক্টরে সক্রিয় বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন ও বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থার নানামুখী লবি-এডভোকেসি, ক্যাম্পেইন ও সংলাপের ফলশ্রুতিতে বর্তমানে বেশ কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। ইতিমধ্যে তিনটা ইয়ার্ড গ্রীন শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আমাদের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী সাধারণ শিপ ইয়ার্ডগুলোর তুলনায় গ্রীন শিপ ইয়ার্ড সমূহে দুর্ঘটনার হার অনেক কমেছে। আরো বেশ কিছু ইয়ার্ড গ্রীন শিপ ইয়ার্ডের সনদ পাওয়ার ব্যাপারে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। নিঃসন্দেহে এটা জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পে এক নতুন দিগন্তের সূচনা।

বর্তমানে প্রায় দেড় শতাধিক ইয়ার্ডের রেজিস্ট্রেশন রয়েছে। বিশেষ কোন কারন না থাকলে প্রায় ৫৫ থেকে ৬০টি ইয়ার্ডে নিয়মিতভাবে জাহাজ ভাঙ্গার কার্যক্রম পরিচালিত হয়। আমাদের প্রত্যাশা বাকী ইয়ার্ডগুলোও দ্রুত সময়ের মধ্যে গ্রীন শিপ ইয়ার্ডে রূপান্তরিত হবে। তবে একইসাথে বলতে চাই -শুধুমাত্র গ্রীন শিপ ইয়ার্ড একমাত্র বিবেচ্য বিষয় হতে পারেনা।

আমরা গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ করছি, জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প খাতে শ্রমিকদের জীবনমান, আন্তর্জাতিক শ্রমমান এবং ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার ইত্যাদি বিষয়ে গ্রীন শিপ ইয়ার্ড গুলোতেও খুব বেশি ইতিবাচক পরিবর্তন হয়নি। অর্থাৎ ইয়ার্ডের অবকাঠামো উন্নয়ন এবং জাহাজ ভাঙ্গার জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার বাদ দিলে শ্রমিক অধিকারের প্রশ্নে গ্রীন শিপ ইয়ার্ড এবং অন্য সাধারণ শিপ ইয়ার্ডের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই।

একটি গ্রীন শিপ ইয়ার্ডের মালিক বিভিন্ন গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের কারনে তদের ইয়ার্ডে পূর্বের তুলনায় শ্রমিকের ব্যবহার প্রায় ৯/১০ গুন কমে গেছে। এর অর্থ হচ্ছে গ্রীন শিপ ইয়ার্ড সমূহে শ্রমিকের মজুরি বাবদ ব্যয়ও প্রায় ৯/১০ গুন কমে গেছে কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, ২০১৮ সালে ঘোষিত নিম্নতম মজুরি কাঠামো আজও গ্রীন শিপ ইয়ার্ড সমূহে বাস্তবায়ন হয়নি। আবার ৯/১০ গুন শ্রমিকের ব্যবহার কমে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে, ঐ ৯/১০ গুন শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন এবং চাকরি হারানো শ্রমিকেরা এখন কেমন জীবন যাপন করছেন কিংবা চাকরি হারানোর পর শ্রম আইন অনুসারে তারা ক্ষতিপূরণ পেয়েছে কিনা তার কোন তথ্য সংশ্লিষ্ট মালিক, সরকারী দপ্তর কিংবা ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন কারো কাছে নেই। একটি সুস্থ্য ধারার শিল্প সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এটা খুব ভাল উদাহরণ নয়।

আমরা মনে করি, শ্রমিকের জীবনমান ও অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন  না হলে এবং শ্রমিকের আইনগত অধিকার সুরক্ষা না পেলে শুধুমাত্র অবকাঠামো পরিবর্তন করে হয়তো শিল্পের চাকচিক্য বৃদ্ধি পায় কিন্তু শিল্প টেকসই হয় না।

জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প খাত বললে আমাদের মানস পটে ভেসে উঠে অজস্র দুর্ঘটনার চিত্র। যে দুর্ঘটনায় অকালে প্রাণ হারিয়েছে কিংবা মারাত্মক আহত হয়ে চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছে অনেক শ্রমিক। আর উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে কত পরিবার যে পথে বসেছে তার কোন হিসাব নেই। তাই বাংলাদেশে গ্রীন শিপ ইয়ার্ডের স্বপ্ন যাত্রা শুরু হয়েছে তার সুফল পেতে হলে সেক্টরের শ্রমিকদের দিকেও নজর দিতে হবে।  সবার আগে শিল্পের অন্যতম স্টেকহোল্ডার হিসাবে শ্রমিকদের স্বীকৃতি দিতে হবে। সেই লক্ষে বাংলাদেশ শ্রম আইন, আইএলও কনভেনশন ৮৭ ও ৯৮ অনুসরণ করে অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন ও দর কষাকষির অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। সেই সাথে শ্রমিকদের নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র, সার্ভিস বুক, নিম্নতম মজুরি বাস্তবায়ন, সকল ধরণের সবেতন ছুটি প্রদান, শ্রমিকদের চাকরি স্থায়ীকরন, চাকুরী শেষে শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিকদের গ্র্যাচুইটি বা ক্ষতিপূরণ, নিহতের পরিবারকে আইএলও কনভেনশন ১২১ অনুসরণ করে আজীবন আয়ের সমপরিমাণ ক্ষতিপূরণ প্রদান, আহত শ্রমিকদের সুস্থ্য না হওয়া পর্যন্ত সবেতন ছুটিসহ সুচিকিৎসা প্রদান, আহত পঙ্গু শ্রমিকদের আজীবন আয় এবং ভোগান্তি হিসাব করে ক্ষতিপুরণ প্রদান, জীবন বীমা প্রথা চালু, ইয়ার্ডের অভ্যন্তরে ক্যান্টিন ও খাওয়ার জন্য ডাইনিং ব্যবস্থা, বছর শেষে কোম্পানীর নীট মুনাফার ৫% শ্রমিকদের  মধ্যে বন্টন ইত্যাদি নিশ্চিত করতে হবে। একটি গ্রীন ইয়ার্ড প্রতিষ্ঠা করতে যে খরচ হয় সে তুলনায় শ্রমিকদের উপরোক্ত অধিকার সমূহ বাস্তবায়নে যে খরচ হবে তা খুবই নগণ্য। তাই শ্রমিকদের অধিকার সমূহ বাস্তবায়নে খুব বেশি চ্যলেঞ্জ হবে বলে মনে করি না। শুধু প্রয়োজন শ্রম অধিকারের প্রতি মালিক পক্ষের ইতিবাচক মানসিকতা। আমাদের মনে রাখতে হবে শ্রমিকের আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠা হলে মানুষ হিসাবে সে সম্মানিত বোধ করে। এতে তার মানসিক দৃঢ়তা তৈরি হয় ফলশ্রুতিতে তার কর্মদক্ষতা ও উৎপাদন দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, মালিক-শ্রমিক পারস্পরিক সম্পর্ক  বিশ্বস্ত হয়। মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক বিশ্বস্ত হলে উন্নত, মানবিক ও স্বাস্থ্যকর শিল্প সম্পর্ক তৈরি হয় –যার মাধ্যমে শিল্প স্থায়ী ও টেকসই হয়।

(লেখকঃ কো-অডিনেটর, বিলস-ডিটিডিএ ওশ সেন্টার, কদম রসুল, সীতাকুন্ড, চট্টগ্রাম)