মতামত

আধুনিক বিশ্ব ও যৌন দাসত্ব

-শুভ চন্দ্র শীল

শুভ চন্দ্র শীল (ফাইল ছবি)

দাসত্ব প্রথা দূর হলেও বিশ্বের অনেক পুঁজিবাদী রাষ্ট্র দেহব্যবসাকে বধৈ হসিবেইে স্বীকৃতি দিয়েছে। এর মাধ্যমে এসব রাষ্ট্রে নারীদের ভোগপণ্য হিসেবে হাজির করা হচ্ছে। নারীদের আর্কষণীয় অফারে অধিক মুনাফার লোভে বাধ্য করা হচ্ছে এই পেশায়। সম্বলিত পোস্টার সোস্যাল মিডিয়াসহ শহরের দেয়ালে দেয়ালে প্রচার ও উৎসাহ প্রদান করা হয় যৌনতায় আগ্রহী হতে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাকচিক্যময় বিনোদনের রাজধানী খ্যাত শহর লাস ভেগাস। ভোগের এহেন কোন বস্তু নেই, যা এই শহরে পাওয়া যায় না। নারী, মদ, জুয়াসহ নৈশ্যপ্রমোদের জন্যই ভোগের জায়গা হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছে লাস ভেগাসকে। মানবিকতা বলতে কোন শব্দ নেই এই শহরে, টাকার কাছে ওটা বিক্রি হয়ে গেছে বহু আগেই। বড় বড় ক্যাসিনো আর আবাসিক হোটেলগুলো প্রলয়ঙ্করী আকার ধারণ করেছে। যৌন চাহিদাসহ বিভিন্ন ধরনের অবৈধ প্রাপ্তির জন্য মানুষ আসে এখানে। শুধু সাধারণ যৌনবাসনা পূরণ নয়, রয়েছে বিকৃত যৌনবাসনা পূরণের আয়োজন।
শুধু লাস ভেগাস না সৌদির দাসী প্রথা, ব্রাজিলের ড্রাগস নেওয়ার সংস্কৃতি কিংবা পশ্চিমা বিশ্বের নারী শ্রমিকদের শ্রম বিক্রির নামে বাধ্য করা হয় যৌন ব্যবসায়। বাঙালি অনেক নারী বিশ্বের বহু দেশে প্রবাসী শ্রমিক হয়ে কাজের সন্ধানে পাড়ি জমালে তাদেরও বাধ্য করা হয় দেহ ব্যবসায়।
অথচ কী আশ্চর্য, কিছু লোক এটাকে নারীদের অধিকার বলছে! তারা কি দেখছে না, একজন নারী অর্থের কাছে, পুঁজিবাদের কাছে কতোটা জটিলভাবে জিম্মি হয়ে পড়েছে। যৌনাচার এবং পর্নোগ্রাফির চিত্রসমূহের সন্ধান প্রাচীনকালের প্যাপিরাস পাতায় অঙ্কিত চিত্রের মধ্যে পাওয়া গেলেও এর সবচেয়ে বড় নিদর্শন পম্পেই নগরীর আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে উন্মোচিত হয়। একসময় পর্নোগ্রাফি সমগ্র পৃথিবীব্যাপী নিষিদ্ধ ছিল। প্রথম পর্নোগ্রাফিক রচনা হচ্ছে ব্রিটিশ লেখকের ঋধহ ঐরষষ বইটি। এই বই লেখার জন্য অবশ্য কারাভোগ করতে হয়েছিল লেখককে। ঙনংপবহব চঁনষরপধঃরড়হং অপঃ ১৮৫৭ নামক আইন দ্বারা পর্নোগ্রাফিকে নিষিদ্ধ করা হয় যুক্তরাজ্যে এবং আয়ারল্যান্ডে। পুনরায় ঈড়সংঃড়পশ অপঃ আইন দ্বারা ১৮৭৩ সালে পর্নোগ্রাফিকে যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ করা হয়। প্রথম পর্নোগ্রাফিক শর্টফিল্ম ‘খব ঈড়ঁপযবৎ ফব ষধ গধৎরব’ ১৮৯৬ সালে নির্মিত হয়। আর প্রথম দেশ হিসেবে পর্নোগ্রাফিকে ১৯৬৯ সালে সেন্সরশিপ প্রদান করে ডেনমার্ক, যা আস্তে আস্তে সমগ্র পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। শর্টফিল্ম নির্মাণের কারণ যৌন নেশা কিংবা বিনোদন নয়। বরং মূল কারণ হচ্ছে অর্থ। পুঁজি যার হাতিয়ার। বৈধ অবৈধ পতিতাবৃত্তির পরিবেশ সৃষ্টি এবং লালন করছে বিশ্বের বহু আধুনিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্র। জুয়া কিংবা নেশাদ্রব্যের মতো যৌনতা তাদের কাছে তুচ্ছ মাত্র বিষয়।
আন্তর্জাতিক মিডিয়ার তথ্যসূত্রে যুক্তরাষ্ট্রে পর্ন ইন্ডাস্ট্রির পরিমাণ হল ১০-১২ বিলিয়ন ডলার। ২০০৬ সালে গোটা বিশ্বের পর্নো ইন্ডাস্ট্রির রেভিনিউ ছিল ৯৭ বিলিয়ন ডলার। অর্থের বিনিময়ে শুধু নারী নয়, পুরুষেরাও বিক্রি করছে দেহ। প্রতিটি ভিডিও/ছবির জন্য দেওয়া হচ্ছে বিপুল পরিমাণে অর্থ। ইন্টারনেট ব্রাউজ করলে দেখা যায় ‘কৃষিকাজ ছেড়ে নীল ছবির দুনিয়ার’, ‘গৃহশ্রমিক থেকে পর্নোগ্রাফির দুনিয়ার’ এরকম হাজারো সংবাদ। মানুষ পরিণত হচ্ছে আধুনিক দাসে। শ্রমপ্রথা বিক্রি থেকে যৌনদাসী বিক্রির খেলায় মেতেছে পুঁজিবাদী বিশ্ব। রয়েছে কয়েক হাজারের বেশি পর্নোগ্রাফির ওয়েব ডার্ক সাইট।
বাংলাদেশেও বিভিন্ন জায়গায় নামে-বেনামে পতিতাবৃত্তি চলছে, এদেশে ভাসমান পতিতার সংখ্যাও প্রচুর। বাংলাদেশে পতিতাদেও মধ্যে বিপুলসংখ্যক শিশুও আছে, যা আইনগতভাবে অবৈধ। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মতো জনপ্রিয় হয়ে উঠছে শরীরচর্চা কিংবা বিউটিস্যালুন পেশার নামে আধুনিক দেহব্যবসা। দেশীয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে আসছে– ট্রেড লাইন্সেস কিংবা ‘ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের অনুমতি নিয়ে পরিচালনা করা হচ্ছে ম্যাসেজ পার্লারের অন্তরালে দেহব্যবসা’। নারীপাচার কমে এলেও কমেনি দেহ ব্যবসায় যুক্ত নারীদের সংখ্যা, মুনাফালোভীরা বাধ্য করছে নারীদের পতিতাবৃত্তিতে। সামাজিক দায়বদ্ধতা, লোভ কিংবা আর্থিক অস্বচ্ছতায় এটাকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে বাধ্য হন অনেক নারী। যৌনদাসীর নামে চালানো হয় অমানবিক নির্যাতন। পণ্যের প্রচারণা কিংবা কমিউনিকেশন সেক্টরে মডেল হিসেবে তুলে ধরা হয় নারীদের। একজন মানুষকে আমরা আর মানুষ হিসেবে দেখতে পারছি না, বিকৃত মনোভাব ও লালসা ধ্বংস করছে মনুষ্যত্বকে। মুনাফালোভীরা দানব হয়ে উঠেছে। আমরা ঠিক করতে পারছি আমাদের ছেলেমেয়েদের স্বাভাবিক যৌন ভবিষ্যৎ। অথচ কারা এই অমানবিকতার পক্ষে সাফাই গায়? কারা একজন মানুষকে শুধুমাত্র একটি মাংসপিÐে পরিণত হবার কথা বলে? বলুন তো পর্ন ভিডিও দেখার পর একজন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির কেমন পরিবর্তন হয়? এই আধুনিক পুঁজিবাদ, মুনাফালোভী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী সকল মানবিকতার বালাইকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে অর্থকে ঈশ্বরে পরিণত করেছে। রাষ্ট্র একজন নারীকে দেখছে না, কখনও কখনও তাকে পতিতা হতে বাধ্য করছে। বাংলাদেশে যে কয়েক লাখ পতিতা আছে অথচ তাদের সরকারি-বেসরকারি কোনোভাবেই পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে না। চিকিৎসা, খাদ্য, শিক্ষা ও সামাজিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে হয় প্রতিনিয়ত। অথচ পতিতাদের অধিকার নিয়ে লেখালেখি, সেমিনার, আলোচনা হয়েছে বা হচ্ছে প্রচুর। পুজিবাদী সা¤্রজ্যবাদ গ্রাস করেছে সমগ্র বিশ্বকে। অর্থ, লোভ, লালসার সিগ্ধতায় মুগ্ধ করে রেখেছে মানুষকে। বিশ্বব্যাপী এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই জারি রেখেছে প্রগতিশীল ও বামপন্থিরা।
শুধু বাংলাদেশ না, সারাবিশ্বে এই যে পুঁজিবাদের অশ্লীল আয়োজন, এই আয়োজনকে রুখে দিয়েছিল সোভিয়েতের সমাজতন্ত্র। এই অমানবিক যৌন দাসত্ব থেকে নারীকে মুক্তি দিয়েছিল, নারীমুক্তির জয়গান গেয়েছিল কমিউনিস্ট বিশ্ব। সেদিন একজন মানুষ, মানুষ হিসেবে বাঁচবার অধিকার পেয়েছিল; অথচ আমরা আজও কতোটা দূরে!

# লেখক পরিচিতি : সাংবাদিক