চলমান সংবাদ

নিয়মিত পথে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি চায় ইটালি

বাংলাদেশ থেকে আরো জনশক্তি আমদানিতে আগ্রহ দেখিয়েছে ইউরোপের দেশ ইটালি৷ বিশেষ করে দেশটির কৃষি ও সেবাখাতে বাংলাদেশিদের অন্তর্ভুক্ত করতে আগ্রহী তারা৷ তবে অনিয়মিত অভিবাসনের বিপক্ষে ইটালির দৃঢ় অবস্থানের কথা আবারও পুনর্ব্যক্ত করেছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী জর্জা মেলোনি৷

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) আয়োজিত ‘ইউএন ফুড সিস্টেমস সামিট প্লাস টু স্টকটেকিং মোমেন্ট’ সম্মেলনে অংশ নিতে গত ২৩ জুলাই ইটালি সফরে আসেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷

সফরকালে মঙ্গলবার বিকেলে (২৫ জুলাই) দেশটির রাজধানী রোমে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পালাৎসো কিজিতে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে অংশ নেন শেখ হাসিনা ও ইটালির প্রধানমন্ত্রী জর্জা মেলোনি৷

ইটালির প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে দেয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদারে জোর দেয়া হয়েছে৷ বিশেষ করে অভিবাসন ব্যবস্থাপনা, নিয়মিত প্রবাহ সহজতর করা এবং পাচারকারীদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড প্রতিরোধের বিষয়ে কথা বলেছেন দুই প্রধানমন্ত্রী৷

দুই সরকারপ্রধানের বৈঠকের পর সাংবাদিকদের বৈঠক সম্পর্কে জানান বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনও৷ তিনি জানান যে, দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে জর্জা মেলোনি অনিয়মিত শ্রমিক নয়, বরং বাংলাদেশ থেকে নিয়মিত শ্রমিক আনার দিকে জোর দিয়েছেন৷

বিপরীতে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও অনিয়মিত অভিবাসনের বিপক্ষে তার অবস্থানের কথা তুলে ধরেন ইটালির সরকারপ্রধানের কাছে৷ বাংলাদেশ অনিয়মিত অভিবাসন নিরুৎসাহিত করে বলেও মেলোনিকে অবহিত করেন হাসিনা৷

অনিয়মিত অভিবাসনকে নিরুৎসাহিত করা এবং নিয়মিত পথে জনশক্তি রপ্তানির সহজীকরণ নিয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ইটালির প্রধানমন্ত্রী জর্জা মেলোনি৷ ছবি: ফাবিও ফ্রুসটাচি/জুমা প্রেস ওয়্যার/ইমাগো
অনিয়মিত অভিবাসনকে নিরুৎসাহিত করা এবং নিয়মিত পথে জনশক্তি রপ্তানির সহজীকরণ নিয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ইটালির প্রধানমন্ত্রী জর্জা মেলোনি৷ ছবি: ফাবিও ফ্রুসটাচি/জুমা প্রেস ওয়্যার/ইমাগো

মিয়ানমার থেকে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার হয়ে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতেও ইটালির প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন শেখ হাসিনা৷

বৈঠক শেষে দুই প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে সাংস্কৃতিক সহযোগিতা এবং জ্বালানি সহযোগিতা সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারকে সই করে দুই দেশ৷

তার আগের দিন অর্থাৎ সোমবার জাতিসংঘের খাও ও কৃষি সংস্থার (এফএও)-এর সদর দপ্তরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ইটালির কৃষিমন্ত্রী ফ্রান্সেসকো ললোব্রিগিদা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাত্তেও পিয়ান্তোদোসি এবং আইন ও বিচারমন্ত্রী কার্লো নর্দিও৷

সাক্ষাৎকালে দেশটির মন্ত্রীরা বাংলাদেশ থেকে আরো জনশক্তি নিতে, বিশেষ করে কৃষি ও সেবা খাতে তাদের আগ্রহের কথা তুলে ধরেন৷ ইটালির রক্ষণশীল সরকারের তিন মন্ত্রীও অনিয়মিত অভিবাসন নিয়ে তাদের উদ্বেগের কথা জানান৷ অনিয়মিত পথে বাংলাদেশিরা যাতে ইটালিতে না আসেন, সেদিকে নজর দিতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে তারা আহ্বান জানান৷

নিয়মিত এবং অনিয়মিত—দুই ধরনের জনশক্তিই ইটালি এবং বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য অবদান রাখছে জানিয়ে, অনিয়মিতদের নিয়মিত করার অনুরোধ রাখেন শেখ হাসিনা৷ তবে সেটা কতোটা বাস্তবায়ন হবে তার কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি৷

করোনাভাইরাস মহামারির ক্ষত কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ করলে অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব পড়ে বিশ্বের অনেক উন্নত দেশেও৷ ফলে ইটালিতে অবস্থানরত নিয়মিত অভিবাসীরা ভালো থাকলেও অনিয়মিতরা আছেন সংকটে৷ নিয়মিতকরণ তো দূরের কথা, তাদের খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার জন্য একটি কাজ জোটানো কঠিন হয়ে পড়েছে৷ মিলছে না থাকার জায়গাও৷

পড়ুন:  সাইপ্রাসে বাংলাদেশি অভিবাসী নিহতের প্রতিবাদে বিক্ষোভ

আটটির মতো দেশ ঘুরে সম্প্রতি ইটালিতে রহমান সেলিম নামের একজন বাংলাদেশি৷ ভেবেছিলেন ইটালি আসতে পারলেই বদলে যাবে ভাগ্য৷ কিন্তু বাস্তবতা সেরকম নয়৷

তিনি বলেন, ‘‘ইটালিতে যখন এলাম তখন দেখতে পেলাম কল্পনার সঙ্গে কোনো মিল নেই৷ সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপ৷ এক মাসের বেশি হবে, আমার থাকার জায়গা নেই৷ কোনো কাজ নেই৷’’

ইব্রাহিম খলিল নামের আরেক বাংলাদেশি ১২ বছরের চেষ্টায় সম্প্রতি ইটালি এসেছেন৷ হতাশা ভর করেছে তার মাঝেও৷ কারণ কোনো কাজ জুটেনি, তারও নেই থাকার জায়গা৷

তিনি বলেন, ‘‘খুব কাছের কেউ না থাকলে এখানে আসার কোনো দরকার নেই৷ বরং দেশে কিছু করা উচিত৷’’

‘‘আমি এখন কাজের পেছনে ঘুরছি৷ কাজ যেন সোনার হরিণের মতো হয়ে গেছে৷’’—বলছিলেন ইব্রাহিম৷

অনিয়মিতভাবে আসা এই দুই প্রবাসী এখন মনে করেন, এভাবে আসাটা মোটেও ঠিক হয়নি তাদের৷

রহমান সেলিম বলেন, ‘‘আমি আপনাদের বিনীতভাবে অনুরোধ করব আপনারা যেন (অনিয়মিতভাবে) না আসেন৷’’

এ প্রসঙ্গে প্রবাস কথা’র ইউরোপ ব্যুরো প্রধান এম কে রহমান লিটন বলেন, ‘‘যারা অনিয়মিত আছেন তাদের অবস্থা খুব একটা ভালো না৷ তারা ভেবেছিলেন, হয়তো তাদের নিয়মিত হওয়ার একটা সুযোগ দেয়া হবে৷ যেটাকে বলা হয় সানাতোরিয়া৷ ২০২০ সালে কোভিডের পর একবার দেয়া হয়েছিল৷ তার আগে ঘোষণা করা হয়েছিল ২০১২ সালে৷’’

অনথিভুক্তদের নিয়মিত করার সুযোগ দিতে অধিকার সংস্থাগুলো অবশ্য সরকারের ওপর এ বিষয়ে চাপ দিয়ে আসছেন বলে জানালেন তিনি৷ কিন্তু বাস্তবায়নন হবে কিনা, হলেও কবে হতে পারে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই বলে মন করছেন এম কে রহমান৷

চলতি বছর ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইটালিমুখী অভিবাসনপ্রত্যাশীদের সংখ্যা ক্রমশ বেড়ে চলেছে৷ এই অভিবাসনপ্রবাহ সামাল দিতে গত এপ্রিলে এসে দেশজুড়ে ছয় মাসের জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে মেলোনি সরকার৷ লাম্পেদুসার আশ্রয় শিবিরেও উপচে পড়া ভিড়৷

ইটালির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ২৬ জুলাই পর্যন্ত মোট ৮৭ হাজার ৪৮৭ জন অভিবাসী অনিয়মিত পথে দেশটিতে এসেছেন৷ ২০২২ সালে ঠিক একই সময়ে এই সংখ্যাটি ছিল ৩৭ হাজার ৮৭৪৷ আর ২০২১ সালে এই সময়কালে সংখ্যাটি ছিল ২৭ হাজার ৪৭৪৷

এ বছর এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ এসছে আইভরি কোস্ট থেকে৷ দেশটির ১০ হাজার ৩৯২ জন নাগরিক অনিয়মিতভাবে ইটালিতে প্রবেশ করেছেন৷ তালিকার দ্বিতীয় অবস্থানে আছে গিনির নাম৷ এই দেশটি থেকে এসেছেন ১০ হাজার ৮৮ জন৷ আর সাত হাজার ৭৮৬ জন এসেছেন মিশর থেকে৷ দেশটির অবস্থান তৃতীয়৷

আর চতুর্থ অবস্থানে আছে বাংলাদেশের নাম৷ এ বছরের ২৬ জুলাই পর্যন্ত ছয় হাজার ৭০৪ জন বাংলাদেশি অনিয়মিত পথে ইটালি এসেছেন বলে জানিয়েছে দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়৷