শিল্প সাহিত্য

বিজয় দিবস ও একটি শকুন!

-শাহীন আকতার হামিদ

লাল সবুজ আলো ও শাড়ি গয়না, পাজামা পাঞ্জাবীতে ঝলমল করছে বাড়িটি। বাচ্চারাও পড়েছে লাল সবুজ ফ্রক ও প্যান্ট সার্ট। আমরাও নিমন্ত্রিত অতিথি, আজ বিজয় দিবস।

আমাদের বিজয় তাই আমরা খাব খিচুরি, কোন বিদেশি খাবার টেবিলে আসতে  পারবেনা। বিশাল বাড়িটির একরুম সাজানো হয়েছে দেশের পতাকার মত করে, সেখানে চলছে গান,  যেসব গান স্বাধীনতার যুদ্ধকালীন সময়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বাজান হত সেইসব গান। আমার দুচোখ ভর্তি স্বপ্ন, আহা  এভাবেই চেয়েছিলাম, দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ুক আমার স্বাধীনতার গল্প, জানুক বর্তমান প্রজন্ম।

এসব ছেলেমেয়েরা বাংলাই পড়তে পারেনা। তবুও নিশ্চয় ওরা মা বাবার কাছ থেকে শুনেছে দেশের গল্প, শুনেছে নয়মাসের যুদ্ধ জয়ের গল্প। বলুক ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজি উচ্চারণে বাংলা, তারপরওতো তারা অনুভব করছে তাদের পূর্ব পুরুষদের একটা দেশ আছে।

রান্না ঘরে চলছে মেয়েদের গল্প, ভাবি কোত্থেকে নিয়েছেন শাড়িটি, ও গ্রীন স্ট্রিটে। আমারটা সাউদ হল থেকে। না না আমি লুটন গিয়েছিলাম, ওখানে সব পাকিস্তানী কাপড়, আজকের দিনে অগুলো পড়তে ভাল লাগেনা। আপা আপনার শাড়িটি কোথা থেকে নেয়া, একদম আলাদা। এগুলো কি হাতে ছাপ মারা। অনেক কষ্টে হাসি ছাপিয়ে বললাম আমার এক বন্ধু ভালবেসে রাজশাহী সিল্কের উপর ব্লক করে  দিয়েছে। আপা আপনার গয়না নেই কেন? এইযে আমি দেশ থেকে স্বর্ণের উপর সবুজ ও লাল মিনা করিয়ে এনেছি, সুন্দর না আপা, আপনার ভাই দেশে গিয়েছিল, বলেছি এটা না আনলে আর ফিরনা। একজন বলল ভাইতো আনবেই। একজন এসে লালসবুজের এক বিশাল মালা আমার গলায় ঝুলিয়ে দিল।

ছেলেরা সব একরুমে জড় হয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি ও ক্রিকেট নিয়ে তুমুল আড্ডা দিচ্ছে। একজনে বলছে গণতন্ত্র নামে কিছু ওদেশে নেই, আর একজনে বলছে একসময় ছিল। কেউ বলছে সে সময় ডিক্টেটরশিপ আরও বেশি ছিল। একজনে বলল পাকিস্তান আমল ভাল ছিল। বুঝলাম যার যার মতাদর্শকে তারা প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমি শুনছি আর দেখছি।

এ আড্ডায়, কেউ কেউ অক্সফোর্ড কেম্রিজের ছাত্র ছিল, সবাই বেশ ভাল কাজ করে, কেউই অড জব করেনা, কেউ কারি ব্যবসার সাথে জড়িত নয়। জামা, জুতা  সার্ট, প্যান্ট, কোর্ট, শাড়ি সব মিলিয়ে বেশ একটা এলিট এলিট ভাব। কেউ পান খায়না, সব মেয়েদের ঠোটে শাড়ির লাল রংয়ের মত লিপস্টিকে রাঙ্গান। নানা ভঙ্গিতে আমরা ছবি তুলে যাচ্ছি। কাধে কাধ, হাতে হাত, ছবি তুলছি আর তুলছি, খাবারের ছবি তুলছি ফেইসবুকে দিব।

ঘরে ঢুকল আরও কয়েকজন, পরিচয় করান হল পাকিস্তানীদের সাথে । আমার হাত পা সেধিয়ে  যাচ্ছে শরীরের মধ্যে। চোখে ভাসছে বাড়ির সামনের খাল দিয়ে ভেসে যাচ্ছে মুন্ডুহীন মানুষের শরীর। পাকিস্তান সৈন্যরা ঘাটে নিয়ে তাদের মাথা কেটে ধর আলাদা করে ফেলছে। আমার স্যারকে সৈন্যরা বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারছে। আমরা ভয়ে দিকবিদিক হয়ে দৌঁড়াচ্ছি দীর্ঘ নয় মাস। আমি ভয় পাচ্ছি কেউ একজন হয়ত বলবে আমার বাবা বা দাদা বাংলাদেশের যুদ্ধের সময় ওখানে ছিল। সবাই ওদের সাথে কোলাকুলি করছে। আমি দূরে আরও দূরে যেতে যেতে বাথরুমে ঢুকে গেলাম। নিজেকে সামলানোর চেস্টা করছি।

গান বাজছে, “একটি বাংলাদেশ একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার . . . ,”     ঘরে ঢুকল সাদা   পাজামা পাঞ্জাবী পড়া স্বাস্থ্যবান একজন, সাদা দাড়ি, পেছনে আরব স্টাইলের  বোরখা পরা এক মহিলা যার বোরখার ঘেরের মধ্যে দশজন লুকাতে পারবে।  সবাই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। স্লামালাইকুম ভাই, ভাবি, স্লামাইকুম ভাই ভাবি ধ্বনিতে চারিদকি মুখরিত। বিনয়ের অবতার দেরি হয়ে গেল দেরি হয়ে গেল  বলতে বলতে লম্বা টেবিলে যেখানে বিশ চল্লিশজন বসতে পারে তার মাথায় মূল চেয়ারটি দখল করে বসল। সে বসার পরে সবাই বসল আমাকে যতই আসন গ্রহণ করতে বলা হচ্ছে আমি ততই দূরে যেতে যেতে জানলার কাছে গেলাম। ভাবছি কোথায় একে দেখেছি! দেখেছিতো, একটি প্লাস্টিকের ব্যাগ হাতে গাড়ির দিকে হেঁটে যাচ্ছে।

গৃহকর্তীর কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম, কে এই ব্যক্তি, বলল আরে মাইনুদ্দিন ভাই  চিনেন না সবাই উনাকে চিনে, খুব ভাল আলেম মানুষ, আমরা ভাবীর কাছে  কোরান শিখতে যাই। আমি দেখছি, একটি শুকু্ন তার সহযোগী শকুনদের নিয়ে খুবলে খুবলে খাচ্ছে মানুষদের গায়ের মাংস। আনন্দে নাচছে, পা দাঁপড়াচ্ছে, উল্ট  ডিগবাজি খাচ্ছে। তার সারা গায়ে রক্ত, লম্বা গলাটা থেকে টপ টপ করে রক্ত  পড়ছে, বাকি শকুনেরা তা চেটে চাটে খাচ্ছে আর আনন্দের শব্দ করছে।

কি হল কি হল রব চারিদিকে। আমার মাথায় ঘুরছে আলতাফ মাহমুদ, শহীদুল্লাহ  কায়সার, সেলিনা পারভীন, সিরাজুদ্দীন হোসেন, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, রণদাপ্রসাদ সাহা, জহির রায়হান, মেহেরুন্নেসা, নূতন চন্দ্র সিংহ, ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, ড. মুনির চৌধুরী, এম সাদত আলী, সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য, গিয়াসউদ্দিন আহমদ, অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী, অধ্যাপক ডা. আলিম চৌধুরী, অধ্যাপক ডা. শামসুদ্দীন আহমেদ, অধ্যাপক ডা. আবদুল আলিম চৌধুরী, ডা. মোহাম্মদ শফী, আরো কত না জানা নামের গুনী মানুষেরা। দেশের এ সূর্য সন্তানদের কেন মেরে ফেলা হয়েছিল। কি দোষ ছিল তাদের! চোখে ভাসছে রায়ের বাজার, চোখে ভাসছে একজনের গায়ের উপর আরেকজনের শরীর, কারো মাথা নেই, কারো চোখ নেই। কার ব্রেস্ট কাটা হয়েছে। কারো সারাগায়ে কেটে দেয়া হয়েছে, কারো হাত পা গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, আরো কত কি যা বলার ভাষা থাকেনা।

তিনদিন পরে হাসপাতালে দেখতে আসল সেই গৃহকত্রী, আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। সে বলে যাচ্ছিল আপানার এপিলেপ্সি আছে আমাদের বলবেন না, খুব ভয় পেয়ে গেছি সবাই আপা।উঠে বসলাম হাসপাতালের বিছানায়। নার্স বলল বেশি  কথা বলা যাবেনা, আমি হাসলাম, বললাম একে আমার কিছু বলার আছে। গৃহকত্রীর দিকে তাকিয়ে বললাম শাওন, সুমন নুসরাত ও আরো অনেক সূর্য সন্তানদের বাচ্চারা যদি তোমাকে প্রশ্ন করে কি করে তোমরা পার একটি শকুনকে সাথে নিয়ে এক টেবিলে খাবার খেতে? তোমাদের কি একবারও আমাদের বাবাদের কথা মনে হয়না!

মহিলা মাথা নিচু করে আমার কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল।