বিজ্ঞান প্রযুক্তি

স্পেস থেকে ভূপৃষ্ঠে ফিরে আসা, এক ভীষণ চ্যালেঞ্জিং বিষয় মহাকাশচারীদের

-অপর্ণা চক্রবর্তী

আজকে আমি লিখতে যাচ্ছি দুর্দান্ত ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে অত্যন্ত কৌতূহল পূর্ণ তথ্য।
অ্যাসট্রনট বা নভোচারীরা কীভাবে পৃথিবীতে ফিরে আসেন?
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে সাধারণত তিন থেকে ছয়জন নভোচারী অবস্থান করেন সবসময়। তাই সবসময় ই নভোচারীদের স্পেসে যাতায়াত চলতে থাকে।
এখন নভোচারীরা পৃথিবীতে ফিরে আসেন কীভাবে?
আমরা সবাই জানি এবং দেখি স্পেসে যাবার সময় নভোচারীরা রকেটে করে যান। এই রকেটে করে যাবার বিষয়টি অত্যন্ত জটিল ইঞ্জিনিয়ারিং। আমি আরেকদিন লিখব রকেট সায়েন্স নিয়ে। আজ নভোচারীদের ফেরার বিষয় নিয়ে লিখছি।
স্পেস থেকে ফেরার সময় মূলত স্পেসশীপের গতি কমিয়ে দিলেই তা পৃথিবীতে ফিরে আসবে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের টানে। কিন্তু তাতে থাকে জীবন সংশয়।
শুরু থেকে এখন পর্যন্ত স্পেসে যাওয়া এবং আসার বেলায় যে যান ব্যবহার করা হয়, তার নাম সয়ুজ। ২০১১ পর্যন্ত ব্যবহার হয়েছিল স্পেস শাটল। ২০২০ থেকে সয়ুজ এর পাশাপাশি ব্যবহার হয় ড্রাগন ২ ক্যাপসুল।
সয়ুজ এবং ড্রাগন ২ ক্যাপসুলের মেকানিজম প্রায় এক, শুধু সয়ুজ ল্যান্ড করে মাটিতে আর ড্রাগন ২ ল্যান্ড করে জলে।
যাইহোক আমি সয়ুজ নিয়ে ই লিখছি।
সয়ুজ রুশ স্পেসশিপ। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন, পৃথিবী থেকে ৪০০ ( চারশ) কিলোমিটার উপরে ২৮০০০ কিমি/ ঘন্টায় গতিশীল রয়েছে।
সয়ুজ ল্যান্ড করে কাজাকিস্তানে।
এখন নভোচারীরা পৃথিবীতে ফেরার আগে পৃথিবীর একদল বিশেষজ্ঞ আইএসএস( আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন) এর কারেন্ট অরবিট অনুযায়ী সয়ুজ কোথায় ল্যান্ড করবে সেই স্থান নির্বাচন করেন। থাকে অত্যন্ত দক্ষ একদল রেসকিউ। তারা যেকোনো প্রতিকূলতার সাথে লড়ার সক্ষমতা রাখে।
আইএসএস এ থাকা নভোচারী দের মাঝে যারা ফিরে আসবেন, সাতদিন আগে থেকে তাদের করণীয় সম্পর্কে নানা রকম ট্রেনিং দেয়া হয়।
সমস্ত কিছু নিয়মমাফিক সম্পন্ন হলে কনফার্মেশান পেয়ে নভোচারী রা সয়ুজ এ প্রবেশ করেন সবার থেকে বিদায় নিয়ে।
সয়ুজ থাকে রুশ ডকিং পোর্টে। আইএসএস এ অনেকগুলো রুশ ডকিং পোর্ট আছে। এখন সয়ুজের গতি বাড়িয়ে বা কমিয়ে তাকে আইএসএস থেকে বি্যুক্ত করা হয়। নির্ভর করে সয়ুজ আইএসএস এর কোথায়, পাশের বা নীচের দিকে সংযুক্ত রয়েছে। পাশের দিকে থাকলে গতি কমিয়ে দেয়া হয় আর নীচের দিকে থাকলে ৪০ মিনিট আগে আইএসএস এর ওরিয়েন্টেশান চেঞ্জ করা হয়।
এখন আসি গতি কমানোর বিষয়ে। আইএসএস এর সাপেক্ষে সয়ুজের গতি প্রতি সেকেন্ডে ১২/১৫ সেন্টিমিটার বেগে ভীষণ ধীরে ধীরে আলাদা করা হয়। তিন মিনিটের মধ্যেই সয়ুজ ২০ মিটারের মত দূরে সরে আসে আইএসএস থেকে।
এরপর নভোচারীরা ১৫ সেকেন্ডে সয়ুজের জ্বালানী পুড়িয়ে গতি বাড়িয়ে দেন বা কমিয়ে দেন। গতির বিপরীতে জ্বালানী পোড়ালে বেগ বাড়বে আর গতির দিকে জ্বালানী পোড়ালে বেগ কমবে।
এখন সয়ুজ ডকিং পোর্টের কোন অংশ থেকে আলাদা হচ্ছে তার উপর নির্ভর করে তার গতি বাড়িয়ে বা কমিয়ে আপার বা লোয়ার অরবিটে আসে আইএসএস এর সাপেক্ষে, কারণ আইএসএস এর সাথে যেন কোনোরকম সংঘর্ষ না হয়।
আইএসএস থেকে আলাদা হয়েও সয়ুয পৃথিবীর কক্ষপথে ঘুরতে থাকে।
সয়ুজের অরবিট পরিবর্তন করার পর ই আসে সবচে ক্রিটিকাল পয়েন্ট। এটাকে বলে ডিঅরবিট বার্ন।এইসময় সয়ুজের গতি ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে। মানে গতির দিকে জ্বালানী পুড়তে থাকে। আর সয়ুজ নীচের অরবিটে আসতে থাকে। এইসময় নভোচারীদের ভীষণ ভীষণ সতর্ক থাকতে হয়। নভোচারীরা যদি ডিঅরবিট বার্ন না করেন তবে সয়ুজের গতি অনেক বেশি থাকবে আর তখন সয়ুজ বায়ুমন্ডলে ধাক্কা খেয়ে আবার স্পেসে ফিরে যাবে। আর ডিঅরবিট বার্ন যদি বেশি হয়ে যায় তখন সয়ুজের গতি অনেক বেশি থাকবে এবং বায়ুমন্ডলে প্রবেশের কৌনিক গতি প্রচন্ড হবার ফলে নভোচারীরা ভয়ংকর তাপে জীবন্ত সেদ্ধ হয়ে যাবেন। তাই এই সময়ে সয়ুজের উপযুক্ত বার্ন হচ্ছে সেকেন্ডে ১২০ মিটার।
সয়ুজ ঠিকমতো ডিঅরবিটবার্ন করার পর পৃথিবী থেকে ১৪০ কিলোমিটার উপরে বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করার আগ মুহূর্তে সে তিনটে ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। অরবিট মডিউল,ডিসেন্ট মডিউল এবং সার্ভিস মডিউল। অরবিট মডিউলে স্পেসে যাবার সময় নভোচারীদের খাবার, ওষুধ থাকে। আর ফেরার সময় থাকে সব আবর্জনা। ডিসেন্ট মডিউলে থাকেন নভোচারী রা। আর সার্ভিস মডিউলে থাকে ইঞ্জিন। যে জ্বালানী পুড়িয়ে ডিঅরবিট বার্ন সম্পন্ন হয়। । এই তিনটি অংশ ভাগ হয়ে দূরে সরে যায় সম্ভাব্য সংঘর্ষ এড়াতে। ভাগ হয়ে যাবার পর অরবিট মডিউল আর সার্ভিস মডিউল সরাসরি বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করে আর বাতাসের কণার ঘর্ষণে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এরপর ডিসেন্ট মডিউল বক্রভাবে বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করে। ডিসেন্ট মডিউলের যেদিকে হিট শিল্ড রয়েছে সেটি পৃথিবীর দিকে মুখ করে থাকে। কারণ এই হিট শীল্ড ই প্রচন্ড তাপ থেকে ডিসেন্ট মডিউল কে রক্ষা করে। বায়ুমন্ডল এ প্রবেশের সাথে সাথে ডিসেন্ট মডিউলের চারপাশের বাতাস এতটাই উত্তপ্ত হয়ে যায় যে বাতাসের কণা গুলো প্লাজমা তে পরিণত হয়। তাই সেইসময় নভোচারীদের সাথে নাসার কন্ট্রোলরুমের কোনো যোগাযোগ রাখা সম্ভব হয় না। ডিসেন্ট মডিউল ডান থেকে বামে আর বাম থেকে ডানে নড়তে পারে আর এভাবেই গতি স্থির রাখে। বায়ুমন্ডলে প্রবেশের সময় মডিউলের গতিবেগ থাকে ঘন্টায় ২৮০০০ কিলোমিটার, কিন্তু বায়ুমন্ডলের নিজের বেগ আছে তাই কিছুক্ষণ পরেই মডিউলের গতি কমে আসে ৮০০ কিলোমিটারে। বায়ুমন্ডলে প্রবেশের সাথে সাথেই নভোচারীরা মাধ্যাকর্ষণ অনুভব করতে থাকেন। তারা 4g পর্যন্ত অনুভব করেন আর এইসময়টাই খুব অস্বস্তিকর। কারণ ছ’মাস ভরহীন অবস্থায় থেকে ভর অনুভব করাটা খুব অস্বস্তিকর।
ডিসেন্ট মডিউল যখন পৃথিবী থেকে সাড়ে দশ কিলোমিটার উচ্চতায় থাকে। যখন তখন ই পর পর তিনটে প্যারাশুট ওপেন হয়। এরপর সাড়ে আট কিলোমিটার উচ্চতায় যখন আসে তখন ওপেন হয় ফাইনাল প্যারাশুট। গতি বেশি থাকায় ফাইনাল প্যারাশুট পরে খোলা হয়, যেন ঠিকঠাক কাজ করে। আর ফাইনাল প্যারাশুটের সাথে থাকে ব্যাক আপ প্যারাশুট। যদি ফাইনাল টা না খোলে। এই পুরো প্রক্রিয়াটিই অটোম্যাটিক। প্যারাশুটের সাহায্যে গতি কমিয়ে আনা হয়। গতি কমে হয় ২২ কিলোমিটার / ঘন্টা।
যখন ডিসেন্ট মডিউল সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার উপরে থাকে তখন আলাদা হয়ে যায় হিট শিল্ড। কারণ হিট শিল্ডে থাকে ছয়টি রেট্রোরকেট। ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি আসার সময় নভোচারীদের সিট কিছুটা উপরে উঠে যায়। এইসময় তারা ভীষণ সচেতন থাকেন। হাত পা,গুটিয়ে বসে থাকার নির্দেশণা থাকে। মুখের ভেতরে জিভ গুটিয়ে রাখেন যাতে দাঁতের কামড় না পড়ে।
ভূপৃষ্ঠ থেকে ৭০ মি উপরে থাকার সময়ই ছ’টি রেট্র রকেট ফায়ার করে, তখন মডিউলের গতি কমে আসে ঘন্টায় পাঁচ কিলোমিটার, যেন ল্যান্ডিং সফট হয়। কিন্তু পাঁচ কিলোমিটার গতিও তো কম নয়। মডিউল এই গতিতেই মাটি স্পর্শ করে। প্রচুর ধূঁয়ো হয়।
নভোচারীদের চোখে মুখে তখন যে আনন্দ থাকে তা ভাষায় প্রকাশের নয়। এক ভীষণ চ্যালেঞ্জিং বিষয় যে বায়ুমন্ডলের এক বিশাল বর্ম কে চ্যালেঞ্জ করে জীবন বাজি রেখে তারা সফলভাবে ভূপৃষ্ঠে অবতরণ করেন। এটা যে কীরকম অনুভূতি তা শুধু কল্পনা ই করা যায়।
সয়ুজের ডিসেন্ট মডিউলে তিনজন নভোচারী থাকেন। ড্রাগন ২ তে সাতজন থাকতে পারেন কিন্তু নাসা চারজনের বেশি এলাউ করে না। স্পেশ শাটল ল্যান্ডিং সবচে নিরাপদ ছিল কিন্তু প্রচন্ড ব্যয়বহুল।
জীবনের প্রতি এতটুকু মায়া না করেই যাঁরা আমাদের জন্য অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন, তাঁদের জন্য অন্তরের সব ভালবাসাও ক্ষীণ হয়ে যায়। এতটাই জটিল কঠিন ইঞ্জিনিয়ারিং এবং প্রযুক্তি র ব্যবহার।
মানুষ এই অসাধ্য সাধন করেছে।
লেখক পরিচিতি  – অপর্ণা চক্রবর্তী ১৯৮৫ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য কিশিনেভ স্টেট ইউনিভার্সিটি যান। পিওর কেমিস্ট্রিতে ১৯৯১ সালে মাস্টার্স কমপ্লিট করেন। পরে একটি বেসরকারি সংস্থায় কেমিস্ট হিসেবে তিনবছর কাজ করেন। ২০১৫ থেকে ২০২০ পর্যন্ত একটি বেসরকারি স্কুলে প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বেঁচে থাকার জন্য বহু কিছু ভালবাসেন। তার মধ্যে বাগান করা, গান শোনা, বেড়ানো, ছবি তোলা, রান্না করা অপর্ণার বিশেষ শখ।