মতামত

এরদোগান কী তবে সত্যিই কামাল আতাতুর্ক এর পথ ধরে হাঁটবেন! —রবীন গুহ

রবীন গুহ (ফাইল ছবি)

গত শনিবার তৃতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেওয়ার পর প্রথম ভাষণে এরদোগান কিছু প্রতিশ্রুতির কথা বলেন। এরদোগান সব নাগরিকের মধ্যে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন তুলে ধরে বলেন, সবার রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং জাতিসত্তাকে শ্রদ্ধা করতে হবে। শপথে এরদোগান আরো বলেন, আমি প্রেসিডেন্ট হিসাবে মহান তুর্কি জাতি ও এর ইতিহাসের সামনে আমার সম্মান ও সততার, রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ও স্বাধীনতা রক্ষার শপথ করছি। তিনি আরও বলেন, আমি সংবিধান, আইনের শাসন, গণতন্ত্র, আতাতুর্কের নীতি ও সংস্কার এবং ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্রের নীতি মেনে চলব।

এবার উপরোক্ত বক্তব্যের সাথে তার অতীতের রাজনীতির পথপরিক্রমা মিলিয়ে দেখা যাক। শুরুর দিকে তুরস্কে ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নয়ন, সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী ও আধুনিকরণ, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তুরস্কের গুরুত্বপূর্ণ রাস্ট্র হিসেবে আবির্ভুত হওয়া, ইসলামিক মূল্যবোধের পুনর্জাগরণ ইত্যাদি কারণে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান। মুসলিম মূল্যবোধের পক্ষে সরাসরি বক্তব্য দেওয়ার কারণেও এরদোগান বহু তুর্কির কাছে জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। তার নেতৃত্বে ইসলামপন্থি দল একেপি ক্ষমতায় আসার পর সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণকে তুষ্ট করার জন্য নানা ধরনের পদক্ষেপ নিতে শুরু করে। কিন্তু, এসব ছাপিয়ে যে বিষয়টা চোখে পড়ার মত তা হলো, এরদোয়ানের দুই দশকের শাসনামলে তুরস্ক ক্রমেই একটি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। দ্বিতীয় দফায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর তুরস্কের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বদলে দিয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন এরদোগান। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাই মনে করেন, একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থেকেও এরদোগান ক্রমশ দূরে সরে গেছেন। যতই তিনি ক্ষমতার কাছাকাছি গেছেন, ততই তিনি ক্ষমতাকে এককেন্দ্রিক করেছেন। সেটা তিনি সাংবিধানিকভাবে করেছেন। প্রেসিডেন্টের হাতে সব ক্ষমতা দিয়ে তিনি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিয়েছেন। বিচার বিভাগ, সংবাদমাধ্যমসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে তার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে গেছেন। এর পাশাপাশি তিনি তুরস্কের আদর্শিক অবস্থানেও পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। জনসমর্থন পাওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি দেশটিকে আধুনিক তুরস্কের নির্মাতা কামাল আতাতুর্কের সেক্যুলার রাজনীতির উল্টোপথে হেঁটেছেন। সাম্প্রদায়িক ও ইসলামপন্থি ধারায় দেশের শাসন পরিচালিত করেছেন। এরদোগানের শাসনামলে মত প্রকাশের স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ করা এবং সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর প্রতি বৈরিতা বৃদ্ধির করা হয়েছে-এমন অভিযোগও রয়েছে। মূলধারার মিডিয়া সরকারপন্থী করা, ইন্টারনেটে ব্যাপক সেন্সরশিপ, নতুন সোশ্যাল মিডিয়া আইন করে অনলাইনে মতপ্রকাশের অধিকার সীমাবদ্ধ করেছেন। এছাড়াও তিনি প্রায়ই জাতিগত কুর্দি ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের সদস্যদের লক্ষ্যবস্তু করেছেন।
তুরস্কের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় নেতৃত্ব দেয়া এই নেতা ২৮ মে রান অফ ভোটে ৫২.২ শতাংশ সমর্থন পেয়ে তার প্রতিদ্বন্দ্বী কামাল কিলিকদারোগ্লুকে পরাজিত করে বিজয় লাভ করেন। এখানে লক্ষনীয় বিষয় হচ্ছে, বড় রকমের মেরুকরণের এই নির্বাচনে দেশের প্রায় অর্ধেক ভোটার তুরস্ক সম্পর্কে তার কর্তৃত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গি সমর্থন করেনি। বিরোধী নেতা এই নির্বাচনে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে সবচেয়ে অন্যায় নির্বাচন বলে উল্লেখ করেন। নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থী কিলিকদারোগ্লু বলেছেন, রাষ্ট্রপতির রাজনৈতিক দল তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের সমস্ত উপায় একত্রিত করেছে এবং তিনি স্পষ্টভাবে পরাজয় স্বীকার করেননি। ধর্মপরায়ণ ভোটারদের অকুণ্ঠ সমর্থন এরদোগানের জয়ের একটা বড় কারণ। কট্টর ইসলামপন্থী ভোটারদের কাছে এরদোয়ান একজন ত্রাতা ও ধর্মীয় নায়ক হিসেবে বিবেচিত হন।

এদিকে তিনি নির্বাচিত হওয়ার পরপরই দেশটির মুদ্রা লিরার রেকর্ড দরপতন ঘটেছে। ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানের খবরে বলা হয়েছে, লিরার এই রেকর্ড দরপতন এরদোয়ানের শাসনের তৃতীয় দশকে দেশটিতে অর্থনৈতিক বিপত্তি ঘটতে পারে এমন ইঙ্গিতই দিচ্ছে। বর্তমানে ১ মার্কিন ডলারের বিনিময়ে প্রায় ২০ দশমিক ১৫ লিরা পাওয়া যাচ্ছে। দ্রুতই লিরার এই মান আরও পড়তে পারে বলে আভাস অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের। নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি এটা স্বীকার করে বলেন, “মূল্য বৃদ্ধি এবং মুদ্রাস্ফীতির কারণে সৃষ্ট সমস্যার সমাধান আগামী দিনের সবচেয়ে জরুরি বিষয়।”

তৃতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হওয়ার পর এরদোগানের একদিকে যেমন পুরোদস্তুর বিভক্ত একটা জাতিকে আবার একত্রিত করতে হবে, অন্যদিক অর্থনীতি পুনরুদ্ধারসহ নানা সংকট মোকাবেলা করতে হবে।এছাড়া আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও তুরস্কের নব্য খলিফা হিসেবে আবির্ভূত হওয়া এরদোগানকে নতুন নতুন চ্যালেন্জ মোকাবিলা করতে হবে। বিশেষ করে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ আরো দীর্ঘায়িত হলে একই সাথে ন্যাটো সদস্য হিসেবে ভুমিকা রাখা ও রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সাথে সুসম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে কতটা ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে পারবেন-সেটাও দেখার বিষয়। আরেকটা প্রশ্ন,
নির্বাচনের শপথ মোতাবেক, অতীতের ধর্মীয় রাজনীতি বদলে সেক্যুলার নীতি মেনে এরদোগান কী তবে সত্যিই কামাল আতাতুর্ক এর পথ ধরে হাঁটবেন!

# রবীন গুহ, সম্পদক মন্ডলির সদস্য, প্রগতির যাত্রী