চলমান সংবাদ

যৌতুকের কারনে মধ্যযুগীয় বর্বরতার শিকার বিলকিসের পরিবার

-দেখতে দেওয়া হয়নি মৃত বাবার লাশ

-বিয়ের পর তিন বছর পরিবারের সাথে যোগাযোগ করতে দেয়নি

আহত শাহনাজ বেগম

।।ফজলুল কবির মিন্টু।।

শাহনাজ বেগম একজন শ্রমিক নেত্রী। বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র পাঁচলাইশ-বায়েজিদ আঞ্চলিক কমিটির নারী বিষয়ক সম্পাদক। তার তিন মেয়ে এবং ছেলে। বুক ভরা আশা নিয়ে মেজ মেয়ে বিলকিস বেগমকে বিয়ে দিয়েছিলেন আজ থেকে প্রায় পাঁচ বছর পূর্বে স্বন্দীপ নিবাসী এবং কুয়েত প্রবাসী শেখ ফরিদের সাথে। বর্তমানে থাকেন রাজধানী ঢাকার গুলশান-২ এর নতুন বাজার, পুরান মছজিদ এলাকায়।

বিগত ১৬ মে ’২৩ বিলকিস তার মাকে ফোন করে  জানায় তাকে যেন অতিসত্বর স্বামীর বাসা থেকে নিয়ে আসে। স্বামীর অত্যাচারে সে অতিষ্ঠ হয়ে গেছে। সে আর স্বামীর ভাত খাবে না। স্বামী ফরিদ কথায় কথায় বিলকিসকে চাকু দেখিয়ে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। মেয়ের ফোন পেয়ে শাহনাজ বেগম মেয়ে জামাই ফরিদের সাথে ফোনে কথা বলতে চাইলে সে কথা না বলে ফোন বন্ধ করে দেয়। মেয়ে বিলকিস আবার ফোন করে জিজ্ঞাসা করে, “মা তুমি আসবে কি আসবেনা বলো। নাহলে আমি আত্মহত্যা করতে বাধ্য হবো”।

মেয়ের এমন আর্তনাদ শুনে কিংকর্তব্যবিমূঢ় শাহনাজ  চিন্তা করলো আর অপেক্ষা করা ঠিক হবে না। তাই বিলম্ব না করেই শাহনাজ  তার একমাত্র ছেলে সাজ্জাদ হোসেন মুন্নাকে সাথে নিয়ে পরের দিনই তথা ১৭ই মে  ঢাকায় যান। মা-ছেলে ঢাকায় পৌঁছে মেয়ের বাড়িতে গেলে সেখানে দেখা হয় মেয়ে জামাই শেখ ফরিদের সাথে। কথা-বার্তা মোটামুটি চলছিল। শাহনাজ বেগম মেয়ে জামাইকে বুঝানোর চেষ্টা করছিল তার এতিম মেয়াটাকে যেন অত্যাচার না করে। কোন কিছুতেই পাষান্ড-বর্বর ফরিদের মন গলে না। বরং সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকে তোদেরকে এরশাদ শিকদারের মত টুকরা টুকরা করে নদীতে ফেলে দেয়া হবে। এভাবে কথা-বার্তার এক পর্যায়ে ফরিদ প্রথমে শ্বাশুড়ি শাহনাজ বেগমকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে এবং কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই শ্বাশুড়িকে বুকে-পিঠে প্রচন্ড লাথি ও  কিল-ঘুষি মেরে মাটিতে ফেলে দেন। পরবর্তীতে পকেট থেকে ক্ষুর বের করে বিলকিসের মাথার উপর চালালে বিলকিস কোনরকমে নীচু হয়ে নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম হলেও তার মাথার উপরে থাকা স্কার্প  ক্ষুরের আঘাতে কেটে যায়। কেটে যাওয়া স্কার্প দেখলেই আন্দাজ করা যায় কী ভয়াবহ বিপদ থেকে হতভাগ্য বিলকিস রক্ষা পেয়েছে। বিলকিস নিজেকে রক্ষা করতে পারলেও পরক্ষণেই ছোট ভাইয়ের উপর চালানো হয় ভয়াবহ নির্মমতা। যে ক্ষুর দিয়ে সে বিলকসকে আঘাত করতে চেয়েছিল সে একই ক্ষুর দিয়েই আঘাত করা হয় বিলকিসের ভাইকে। ছোট ভাই মুন্নার মুখে-গলায় বেশ কয়েকবার ক্ষুরের পোজ দিয়ে মারাত্মকভাবে আহত করা হয়। মুন্নার রক্তে পুরো এলাকা রক্তাক্ত হয়ে যায়।এমন ঘটনায় স্থব্দ হয়ে যায় উপস্থিত এলাকাবাসী। সবার মুখে মুখে শুধু এক কথা এমন বিবৎসতা কিংবা হিংস্রতা একজন মানুষ আরেকজন মানুষের উপর কিভাবে দেখাতে পারে? এলাকাবাসীর তাই প্রশ্ন পাষান্ড ফরিদ কি আসলেই মানুষ নাকি মানুষরূপী অন্য কেউ?

মারাত্মক আহত সাজ্জাদ হোসেন মুন্না

 

মুন্নাকে সাথে সাথে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়। ঢাকায় তাদের পক্ষে থাকা সম্ভবপর ছিল না বিধায় মুন্নাকে মা শাহনাজ এবং বিলকিস মিলে চট্টগ্রাম নিয়ে আসে এবং চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে সপ্তাহখানেক চিকিৎসা শেষে বর্তমানে কিছুটা সুস্থ্য বোধ করলেও তার মুখে ক্ষতের চিহ্ন বিরাজমান। পুরোপরি সুস্থ্য হতে হয়তো আরো সময় লাগবে। এখনো প্রচন্ড ব্যথা হয়। ব্যথার কারনে তার রাতে ঘুমাতেও খুব কষ্ট হয়। ছেলের এমন কষ্টের বর্ণনা দিতে দিতে মা শাহনাজ যেন চোখের পানি ধরে রাখতে পারছিলনা। পরে অসহায়ের মত এই প্রতিবেদকের ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। তিনি জানতে চান পাষান্ড ফরিদের বিচার কি আদৌ হবে নাকি বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদবে?

ঘটনার সূত্রপাতঃ কিছুদিন পূর্বে ফরিদ-বিলকিসের বাসার সামনে একজন বয়স্ক মহিলা পানের পিক ফেলেন। বিষয়টি ফরিদের নজরে আসলে সে রাগান্বিত হয়ে বাড়ির ইনচার্জ এবং বৃদ্ধার ছেলেকে অভিযোগ করে। কিন্তু  ইতিমধ্যে বৃদ্ধার ছেলে পানের পিক পরিস্কার করে দেয়ায় বাড়ির ইনচার্জ এসে দেখেন সেখানে কোন পানের পিক নাই। ফরিদের সন্দেহ পানের পিক বৃদ্ধার ছেলে পরিস্কার করে নাই। বিলকিস নিজে পরিস্কার করে হয়তো বলছে বৃদ্ধার ছেলে পরিস্কার করেছে। এমন সন্দেহের বশবতী হয়ে সে বিলকিসকে প্রচন্ড মারধর করে। বিলকিস জানায় সন্দেহ বাতিক ফরিদের একটি অন্যতম সমস্যা। সামান্য কিছু হলেই সে সন্দেহ করে। এমনকি কোন একটা মানুষের সাথে কথা বলতে দেখলেও কোন কারণ ছাড়াই সে সন্দেহ করে নানান নির্যাতন করে।

আহত শাহনাজ বেগম

ফ্ল্যাশ ব্যাকঃ

প্রায় পাঁচ বৎসর পূর্বে ফরিদের সাথে বিলকিসের বিয়ে হয়। ফরিদের বোন জামাইয়ের অনুরোধে বিলকিসের পরিবার বিয়েতে সম্মতি দেয়। বিলকিসের বাবা ছিলেন একজন ভ্যান চালক। দিন এনে দিন খায়। তেমন কোন জমি-জমা ছিলনা। তাই প্রচলিত অর্থে যৌতুক বলতে যা বোঝায় তা দেয়ার সক্ষমতা বিলকিসের পরিবারের ছিলনা। ফরিদের পরিবার থেকেও আশ্বস্থ করা হয়েছিল তারা কোন যৌতুক চান না। তারা শুধু মেয়েটাকেই চান। তাই এমন একটি উত্তম প্রস্তাব পেয়ে বরং বিলকিসের পরিবারে আনন্দের সীমা ছিলনা। কিন্তু বিয়ের কয়েক মাসের মধ্যেই বিলকিসের পরিবার বুঝতে পারলো মহাভুল হয়ে গেছে। ফরিদের যে বোন জামাইকে বিশ্বাস করে বিলকিসের পরিবার বিয়েতে রাজী হয়েছিল সেই বোনের আচরণ বদলে গেল। সে বিলকিসের সাথে বিভিন্নভাবে খারাপ আচরণ করতে লাগলো। বিলকিস ভাবে সময় গেলে হয়তো দিন বদলাবে। কিন্তু সময় যত যায় তাতে যেন ফরিদের মুখোশ আরো উম্মোচিত হতে থাকে বিলকিস ও তার পরিবারের কাছে। ফরিদ ছিল কুয়েত প্রবাসী কিন্তু বিয়ের পর সে আর কুয়েতে যায়নি। ফরিদ পাইকারী থেকে বিভিন্ন জিনিষ কিনে তা সাইকেলে করে দোকানে দোকানে সরবরাহ করতো। একদিন ফরিদ বিলকিসকে জানায় তার ব্যবসার জন্য টাকা লাগবে সে যেন তার পরিবার থেকে সে টাকা জোগাড় করে দেয়। বিলকিস ফরিদকে জানায় আমার বাবা একজন ভ্যান চালক, মা গার্মেন্টস এ চাকরি করে। আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে টাকা দেয়া কোনভাবেই সম্ভব নয়। কথাটা শুনে ফরিদ অগ্নিমূর্তি ধারণ করে। জ্বলে উঠে তেলে-বেগুনে। এভাবে আরো কয়েকবার টাকা চেয়ে না পেয়ে সে বিলকিসকে জানায় তোমার আর বাপের বাড়ির সাথে যোগাযোগ রাখার দরকার নাই। যে পরিবার আমাকে ব্যবসা করার জন্য সামান্য কিছু ক্ষমতা রাখেনা তাদের যোগাযোগ করে তোমার কী লাভ? ফরিদ বিলকিসকে পরিবারের লোকজনের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে বাধ্য করে।

 

প্রায় তিন বছর বিলকিস তার পরিবারের লোকদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি। এমনকি বিলকিসের বাবা মারা যাওয়ার পরেও সে বাবার মৃত মুখটিও দেখতে পারেনি। কারণে-অকারণে এবং কথায় কথায় ফরিদের অমানসিক নির্যাতনে বিলকিসের জীবন অতীষ্ট হয়ে গেছে। বিলকিস জানায় একসময় ফরিদের পরিবর্তন হবে এমন আশায় তার নির্মম অত্যাচার মুখ বুঝে সহ্য করেছি। ভেবেছিলাম বাচ্চা-কাচ্চা হলে, সংসারে নতুন মুখ আসলে ফরিদের কিছুটা হলেও পরিবর্তন হবে কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি। দিন যায় কিন্তু ফরিদের কোন পরিবর্তন হয়না। ইতিমধ্যে ফরিদ-বিলকিসের ঘর আলোকিত করে ফাতেমা এবং অলিউল্লাহ নামের দুই-দুটো ফুটফুটে সন্তানের জন্ম হয়েছে। ফাতেমার বয়স তিন আর অলিউল্লাহর বয়স দুই। এমন সুন্দর ফুটফুটে বাচ্চা দুইটার দিকে তাকালে যে কারও মন জুড়ে যায় কিন্তু ফরিদের কিছুটেই কিছু হয়না। পাষান্ড ফরিদের অত্যাচার যেন দিনে দিনে আরো বাড়তে থাকে। বিলকিস জানায় শত নির্যাতন সহ্য করে বাচ্চা দুটোর দিকে তাকিয়ে বাকী জীবন পার করে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ফরিদের নির্যাতন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তার সাথে আর এক মিনিটের জন্যও ঘর করা সম্ভব নয়। তাই একান্ত বাধ্য হয়েই তার সাথে আর ঘর না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

মামলাঃ

ফরিদের বিরুদ্ধে বাড্ডা থানায় একটি মামলা হয়েছে। মামলা নম্বরঃ ২৯/২০২৩। মামালার আইও রাজিবুল হাসান।

১৭ মে মামলা হয়েছে। এলাকাবাসীরা জানান ফরিদ এখনো প্রায়ই বাসায় আসে কিছুক্ষন অবস্থান করে চলে যায়। কিন্তু  পুলিশ জানায় ফরিদকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মামলা হওয়ার প্রায় ২০ দিন পার হলেও ফরিদকে গ্রেপ্তার করতে না পারা রহস্যজনক।

প্রত্যাশাঃ

এলাকাবাসী এবং বিলকিসের পরিবারের সদস্যদের প্রত্যাশা অবিলম্বে ফরিদকে গ্রেপ্তার করে তাকে আইনে আইনের আওতায় এনে তার শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। অন্যথায় ফরিদদের দৌরাত্ম কখনো থামানো যাবে না।