শিল্প সাহিত্য

আসহাব উদ্দীন আহমদ: “বহুমাত্রিক জ্যৈতির্ময় প্রতিভা”

-আলমগীর মোহাম্মদ

আসহাব উদ্দীন আহমদ (ফাইল ছবি)
“প্রত্যেক যুগে যুগে কিছু মহৎ মানুষের জন্ম হয়। আশ্চর্যজনকভাবে এ- লোকগুলো পৃথিবীর তাবৎ মানুষের আপনজন হয়ে ওঠেন তাঁদের চিন্তাভাবনা ও আপন কৃতকর্মের মাধ্যমে। আপন প্রাণ নিবেদিত করে তাঁরা অপরের সুখ নিশ্চিতকরণে তৎপর।” অধ্যাপক আসহাব উদ্দীন আহমদ এমন একজন মানুষ যিনি ব্যক্তিগত প্রাপ্তি, সুখ দুঃখ ও খ্যাতির মোহ ছেড়ে মানবসমাজের মুক্তির জয়গান গেয়ে গেছেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।
আসহাব উদ্দীন আহমদের জন্ম ১৯১৪ সালে বাঁশখালী থানার সাধনপুর গ্রামে। গ্রামের মক্তবে পড়ালেখার হাতে খড়ি তাঁর। স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয় হয়ে বাণীগ্রাম সাধনপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বৃত্তিসহ মাধ্যমিক পাস করেন। তারপর চট্টগ্রামে কলেজ থেকে আই এ, ও বিএ পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন। প্রফেসর আবদুল করিমের “ বাঁশখালীর ইতিহাস ও ঐতিহ্য” পড়ে জানা যায় আসহাব উদ্দীন আহমদ ছিলেন বাঁশখালীর পঞ্চম এম এ ডিগ্রিধারী। আর মুসলমানদের মধ্যে দ্বিতীয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে চট্টগ্রাম কলেজে ইংরেজির প্রভাষক হিসেবে শিক্ষকতা শুরু করেন। শিক্ষকতা নিয়ে তাঁর মনস্থির ছিল আসলে স্কুল জীবন থেকে। স্কুল পরিদর্শক তাঁকে জানতে চেয়েছিলেন , ‘ভবিষ্যতে কি হতে চাও?’ আসহাব উদ্দীনের উত্তর ছিল, ‘ আমি একজন শিক্ষক হতে চাই।‘ অবশ্যই এজন্য তাঁকে শিক্ষকদের তিরস্কার সইতে হয়েছিল।
কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছেন, সকলেই কবি নয়। কেউ কেউ কবি। তেমনি বলা যায় সকলেই শিক্ষক নয়, কেউ কেউ শিক্ষক। শিক্ষকতা একটা শুধু পেশা বা উপার্জনের মাধ্যম নয়। এটা একটা ব্রত। শিক্ষক হওয়া প্রসঙ্গে আসহাব উদ্দীন আহমদ বলেছেন, “ আমি যখন নবম শ্রেণীতে পড়ি তখন থেকে আমি ভেবে রেখেছিলাম যে অভিভাবক যদি ম্যাট্টিক পাস করার পর আর পড়াতে না পারেন তাহলে আমি অন্য চাকরি না নিয়ে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হব, সৎ আদর্শ জীবনযাপন করব এবং দরিদ্র মানুষের সেবা করব।”
লেবাননের বিখ্যাত কবি খলিল জিবরান তাঁর একজন শিক্ষককে জ্যোতির্বিদের সাথে তুলনা করেছেন। শিক্ষকের কাজ একজন শিক্ষার্থীর মধ্যে জ্ঞানের তৃষ্ণা জাগিয়ে দেওয়া। শিক্ষক- শিক্ষার্থী সম্পর্ক কেমন হবে সে প্রশ্নের জবাবে আসহাব উদ্দীন আহমদ বলেন, “শিক্ষক হিসেবে আমার অভিজ্ঞতা হলো ছাত্রের প্রতি গভীর স্নেহবোধ এবং তাঁর শুভকামনা হবে ছাত্র- শিক্ষক সম্পর্কের মূল ভিত্তি। ‘ শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করেন যিনি।‘ শিক্ষার্থীকে নানান ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে মুক্ত করতে হলে প্রয়োজনে তার প্রতি শিক্ষকের কড়াও হতে হবে। কিন্তু ছাত্রকে উপলদ্ধি করতে হবে যে, শিক্ষক যা করেন, যা বলেন তা তার অপরিসীম হিতকামী হিসেবেই বলেন বা করেন।”
চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ, ফেনী কলেজ, লাকসাম নবাব ফয়জুন্নেসা কলেজ ও কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে অধ্যাপনা করেন অধ্যাপক আসহাব উদ্দীন আহমদ। চৌদ্দ বছর শিক্ষকতা করার পর বড় আশা নিয়ে রাজনীতিতে মনোনিবেশ করেন। কমিউনিস্ট আদর্শের ধারক বাহক এই বিপ্লবী পঞ্চাশের দশকে আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগ দেন। ৫৪- ৫৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান আইনসভার সদস্য ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। পরপর্তীতে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাপ গঠন করেন। কৃষকমুক্তির জন্য আমৃত্যু লড়ে যান। যে আশা নিয়ে রাজনীতিতে এসেছিলেন সেটা পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় আশির দশকের দিকে রাজনীতি ছেড়ে পুরোপুরি লেখক হিসেবে নিজেকে নিয়োজিত করেন। নিজেকে ‘ বোকামিয়া’ ভাবা এই বিপ্লবী পুরুষ তার রাজনৈতিক জীবনকে মূল্যান করেন এভাবেঃ “বোকার ফসল পোকায় খায়। এটা একটা সর্বজন স্বীকৃত প্রবচন। পার্টির ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা পোকারা বোকাদের উৎপাদিত ফসল খেয়ে মোটা-তাজা , নাদুস নুদুস হয়ে ক্ষমতার মসনদে বসে তা মোচে দিচ্ছে। এ ধরণের রাজনীতিকরা ত্যাগী কর্মীদের মই হিসেবে ব্যবহার করে নেতা বনে যায় । নেতৃত্বের বা মন্ত্রীত্বের গদিতে সমাসীন হয়ে মইটি পায়ে ঠেলে নিচে ফেলে দেয়। ” বোকামিয়ার ইতিবৃত্ত নামে তাঁর বইয়ে তিনি বলেছেন, “আমার মতো সরল মানুষের জন্য রাজনীতি নয়।আমি যেন পথ ভুলে রাজনীতিতে এসেছি। আমার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক জীবনকে একটা দুঃস্বপ্ন মনে হতে লাগল।“ বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সকল গুরুত্বপূর্ণ জন আন্দোলনে নেতৃত্ব সক্রিয় ভূমিকা পালনকারী এই ব্যক্তিকে রাজনৈতিক দলগুলোও সেই অর্থে মনে রাখেনি।
লেখালেখির মাধ্যমে সমাজ সংস্কারের ব্রত নিয়ে বাংলাদেশ লেখক শিবিরের সাথে যুক্ত হন। পত্রপত্রিকায় রম্যের সুরে সমাজে প্রচলিত সকল অনাচার, কুসংস্কার ও অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। দেশের স্বনামধন্য প্রায় পত্রিকায় তিনি কলাম লিখতেন নিয়মিত। তাঁর রচিত গ্রন্থ সংখ্যা ২৬।
শিক্ষকতা, রাজনীতি ও সাহিত্যচর্চা এই তিনের অপূর্ব সমন্বয় আসহাব উদ্দীন আহমদের জীবন। সাহিত্যচর্চা সম্পর্কে তাঁর আত্মমূল্যায়ন হলো, “রীতিমতো সাহিত্যিক বলতে যা বুঝায়, আমি তা নই। খেয়ালের চাপে লিখি। খেয়াল না চাপলে মাথায় লাঠির বাড়ি মারলেও কলম দিয়ে কিছু বের হয় না।‘’ এটা ঠিক যে তিনি লেখালেখির ক্ষেত্রে প্রচলিত লেখকদের ছায়া এড়িয়ে গেছেন। লেখালিখি নিয়ে তাঁর অন্য একটা মন্তব্য এখানে তুলে ধরা প্রাসঙ্গিক মনে করছি। “আমার লেখায় হাসি ঠাট্টার ভেতর দিয়ে সামাজিক, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও অবিচারকে তুলে ধরা হয়েছে এবং গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিকে প্রচার করা হয়েছে, প্রোপাগাণ্ডা আকারে নয়, সাহিত্যরূপে।“ লেখক আসহাব উদ্দীন সম্পর্কে সময়ের সবচেয়ে অগ্রগামী চিন্তক সলিমুল্লাহ খান বলেছেন, “আসহাব উদ্দীন আহমদের জীবনস্মৃতি গোত্রের কিছু লেখা আছে। এইগুলি কিন্তু খুব কাজের জিনিস হইয়াছে। সাহিত্য হিসাবে নাহোক, সত্য হিসাবে। বিশেষ করে গত একশত বছরে বাঙ্গালী মুসলমান সমাজেত যোগ্যতা ও আর উর্ধতনের কাহিনি যাঁহারা পরিহার করতে চাহেন না তাহাঁরা এখানে কিছু পোষ্যোচিত ভালোমন্দ খোরাকও পাইবেন। আসহাব উদ্দীন নামক একজন মানুষকে বুঝিতে পারিলে লাভ আছে সন্দেহ নেই। “
রাজনীতিতে তিনি সুযোগ পেয়েছিলেন ক্ষমতার মসনদের মই বেয়ে উপরে উঠার। কিন্তু, তিনি সেটা করেননি। বেছে নিয়েছেন বন্ধুর পথ। মানব মুক্তির সংগ্রামের পথ। তাঁর জন্মস্থান বাঁশখালীর সাথে সড়ক পথে শহরের যোগাযোগ ছিল না। এইক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। মাওলানা আবদুল হামিদ ভাসানী ও বঙ্গবন্ধুর খুব কাছে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল তাঁর। ভাসানীর সাথে ন্যাপে যাওয়ায় আওয়ামীলীগের সাথে তাঁর একটা দুরত্ব তৈরি হয়েছিল। পরবর্তীতে তা আর কখনো ঘুচেনি। শিক্ষাক্ষেত্রে আসহাব উদ্দীনের ভূমিকা দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষ সারাজীবন স্মরণ করবে। বাঁশখালী ডিগ্রি কলেজ, সাতকানিয়া কলেজ, চট্টগ্রাম সিটি কলেজ, সাধনপুর পল্লী উন্নয়ন হাইস্কুল, পশ্চিম বাঁশখালী হাইস্কুল, বাহারছড়া রত্নপুর হাইস্কুল প্রতিষ্ঠায় তিনি অনন্য ভূমিকা পালন করেন।
ব্যক্তি আসহাব উদ্দীনের সফলতা হলো তিনি নিজের আত্মার কথা শুনতেন এবং নিজের আবেগের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তাঁর রচনা পাঠ আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় আমেরিকার দার্শনিক হেনরি ডেভিড থরো ও রালফ ওয়াল্ডো এমারসনের কথা। বর্তমানের এই বিকৃত সমাজব্যবস্থায়, যেখানে আনুগত্যকে দাসত্বের সমপর্যায়ে ভাবা হয়, আসহাব উদ্দীন আহমদের রচনা পাঠ জরুরি। মান সমাজের মুক্তির এই অগ্রনায়ককে তাঁর ঊনত্রিশতম মৃত্যুবার্ষিকে (২৮ মে) শ্রদ্ধাভ’রে স্মরণ করছি।
[তথ্য সহায়িকাঃ আসহাব উদ্দীন আহমদ ও মানবসমাজের মুক্তিভাবনা, মোহাম্মদ আলম চৌধুরী।]
# লেখকঃ শিক্ষক, বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি