বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (৯৫): যুদ্ধ কথা 

-বিজন সাহা

অনেক দিন যুদ্ধ নিয়ে কিছু লিখি না। অনেকেই ইনবক্সে বা ফোন করে জানতে চায়। কেউ কেউ দেশের পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত খবর পাঠায়, জানতে চায় খবরের সত্যতা। কী বলব? আসলে যেকোন যুদ্ধে মৃত্যু একমাত্র সত্য আর সেই মৃত্যুকে মহৎ বা দানবীয় করার জন্য যা বলা হয় সেটা মিথ্যা না হলেও বিভিন্ন মোড়কে মোড়ানো। এটা ভালো বা মন্দ নয়। এটা যুদ্ধের কৌশল। আসলে প্রোপাগান্ডা যুদ্ধের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত সেই প্রাচীন কাল থেকেই। মনে আছে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের কথা? যুদ্ধের এক পর্যায়ে দ্রোণাচার্য যখন অজেয় হয়ে ওঠেন যুধিষ্ঠির বাধ্য হন মিথ্যা বলতে। তিনি বলেছিলেন “অশ্বত্থামা হত ইতিঃ গজ” মানে অশ্বত্থামা নামে হাতি মারা গেছে। যদিও সেটা  মোটেও মিথ্যা ছিল না কারণ একটু আগেই ভীম ঐ নামের এক হাতি বধ করেছিলেন, তবে কারোই বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে যুধিষ্ঠিরসহ পাণ্ডব পক্ষের সবাই চেয়েছিলেন যেন দ্রোণাচার্য বিশ্বাস করেন যে তাঁর ছেলে অশ্বত্থামা মারা গেছেন। বাস্তবে সেটাই ঘটে। পুত্রশোকে কাতর দ্রোণাচার্য তীরধনুক সরিয়ে মৃত্যুকে বরণ করে নেন। আবার ইলিয়ডে আমরা দেখি গ্রীক সেনারা ট্রয়ের প্রাচীরের বাইরে এক কাঠের ঘোড়া রেখে জাহাজে করে ট্রয় ত্যাগ করে। সেটাও ছিল ডাহা মিথ্যা। কারণ রাতের অন্ধকারে এরা ফিরে এসে ঘোড়ার মধ্যে লুকিয়ে থাকা সেনাদের সাহায্যে ট্রয় নগরীতে ঢুকে তা ধ্বংস করে ফেলে। তাই যুদ্ধ মানেই মিথ্যা, যুদ্ধ মানেই বিশ্বাসঘাতকতা। জয়ের জন্য যেকোন কৌশলই সঠিক। তাই পরাজয়ের মুখে ইউক্রেনের সেনারা যে অমানবিক ও সন্ত্রাসী হামলার আশ্রয় নেবে এটা অপ্রত্যাশিত নয়। যুদ্ধে নেমে শান্তির সময়ের রীতিনীতি অনুসরণ করা বোকামি না হলেও অদ্ভুত তো বটেই। এতে যুদ্ধের মেয়াদ বাড়ে। ফলে যুদ্ধ শেষে মৃত ও আহতের সংখ্যা প্রায় একই হয় আর মানুষের কষ্টের দিনের পরিমাণ হয় অনেক বেশি।

রুশ সংবাদ মাধ্যমে যেটা নিয়ে বেশি আলোচনা হয় তা হল আর কত সহ্য করবে রাজনৈতিক নেতৃত্ব। নর্থ স্ট্রীম, দারিয়া দুগিনা, ভ্লাদলেন তাতারস্কি, এখন ক্রেম্লিনের উপর ড্রোন হামলা। একটার পর একটা রেড লাইন পার হচ্ছে আর এরা কিছুই করছে না। অনেকের ধারণা পশ্চিমা বিশ্ব এখন বিশ্বাসই করে না যে এরা কিছু করার ক্ষমতা বা সাহস রাখে। যখন ক্রিমিয়ায় আমেরিকার ড্রোন ফেলে দিল কয়েকদিন হইচই করলেও পরে আমেরিকা এই এলাকায় ড্রোন পাঠানো সাময়িক ভাবে হলেও বন্ধ রেখেছে। এটা প্রমাণ করে যে ওরা শক্তের ভক্ত নরমের যম। যখনই শক্ত হাতে উত্তর দেয়া হয় ওরা পিছু হটে। আমেরিকা আর ব্রিটেন এক রকম জোর করেই যুদ্ধটা চালিয়ে যাচ্ছে ইউক্রেনকে দিয়ে। ওদের বিশ্বাস এতে ওদের না আছে দায় দায়িত্ব, না আছে রিস্ক। তাই অনেকের দাবি রাশিয়ার নেতৃবৃন্দের উচিৎ সোজা বলে দেওয়া কোন অবস্থায় তারা ইংল্যান্ড বা আমেরিকা আক্রমণ করবে। কারণ এমনকি যারা ওখানে যুদ্ধে চায়, তাদের অধিকাংশই যুদ্ধ শেষে বেঁচে থাকতে চায়। যদি এখান থেকে স্পষ্ট করে স্ট্র্যাটেজিক নিউক্লিয়ার ওয়ারের কথা বলা হয় হয়তো তখন গরম মাথার অনেকের মনেই মৃত্যুর খাঁড়া ঝুলতে শুরু করবে। কেননা বাইরে থেকে নয় একমাত্র ভেতর থেকেই ওদের থামান সম্ভব। একমাত্র ধ্বংসের ভয় আমেরিকাকে লাগাম টানতে বাধ্য করবে। তবে সেটা বলাও ততটা সহজ নয়। কেননা পশ্চিমা বিশ্ব চায় রাশিয়াকে ম্যাক্সিমাম আইসোলেট করতে। এখনও পারছে না। পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের সতর্কবাণী পশ্চিমা বিশ্বকে চীন, ভারতের উপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করার সুযোগ দেবে। তাই বাইরে থেকে যতটা সহজ মনে হয়, এসব উচ্চারণ ততটা সহজ নয়।

অনেকেই এখানকার হতাহতের কথা জানতে চায়। অনেক দিন সেরকম কোন খবর দেখিনি। তবে ধারণা করতে পারি সংখ্যাটা বেশ বড়। এরা তো বটেই এমনকি পশ্চিমা বিশ্বও স্বীকার করে যে এদের হতাহতের পরিমাণ ইউক্রেনের হতাহতের আট ভাগের একভাগ। পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন হিসাব অনুযায়ী ইউক্রেনের মৃতের সংখ্যা প্রায় তিন লাখ আর হতাহতের পরিমাণ প্রায় দশ লাখ। এর অর্থ রুশ সেনাদের হতাহতের সংখ্যা কম করে হলেও এক লাখ পঁচিশ হাজার আর মৃতের সংখ্যা ৩৫ থেকে ৪০ হাজার। উল্লেখ করা যেতে পারে যে আফগানিস্তানের ৮ বছরব্যাপী যুদ্ধে মারা গেছিল ১৪৪২৭ জন সোভিয়েত সেনা আর ভিয়েতনামের যুদ্ধে প্রায় ৫৮ হাজার আমেরিকান সেনা। এটা বিশাল সংখ্যা। এই সংখ্যাটা বের করা কঠিন নয়, তবে সেটা উচ্চারণ করা খুব কঠিন। এর মানে চাক বা নাই চাক সব পক্ষই অনেক অপ্রিয় সত্য এড়িয়ে যায়। এটাও যুদ্ধের কৌশল। আরও একটা ব্যাপার মনে রাখতে হবে যে যুদ্ধ শুধুমাত্র ইউক্রেনে সীমাবদ্ধ থাকলেও এর ভৌগলিক বিস্তৃতি ব্যাপক। ইদানীং এক আমেরিকান জেনারেল বলেছেন ন্যাটো ও তার মিত্ররা ইউক্রেনের যে পরিমাণ অস্ত্র এখন সরবরাহ করেছে সেই পরিমাণ অস্ত্র কোন একেক দেশের নেই। আসলে এই যুদ্ধে যে পরিমাণ অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে সেটা কল্পনাতীত। দুই দিকে কম বেশি একই ধরণের সেনারা যুদ্ধ করছে। দুই পক্ষই অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত। তাছাড়া আমরা বাইরে থেকে যা দেখি ভেতর থেকে দেখতে সেটা ভিন্ন রূপ নেয়। সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ শুধু সবলতা দেখে না, নিজের দুর্বলতাও জানে আর সেটা জেনেই সিদ্ধান্ত নেয়। আর জানে বলেই ধীরে অগ্রসর হয়।

কয়েকদিন আগে এক কলিগের সাথে কথা হচ্ছিল। ওর স্বামী সৈনিক। এখন দনবাসে যুদ্ধ করছে। কিছুদিন আগে ছুটিতে বাড়ি এসেছিল। নাতাশাকে জিজ্ঞেস করলাম,
কি বলে তোমার বর?
কিছুই বলে না। শুধু বলে তোমাদের এসব না জানাই ভালো। তবে তোমরা সংবাদ মাধ্যম বা টিভিতে যে খবর পাও তার সাথে বাস্তবের মিল তেমন নেই। যুদ্ধ যুদ্ধই। সেখানে আমাদের সব সময় শুধু শত্রু নয় মৃত্যুর সাথেও লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয়। এখানে বসে যুদ্ধক্ষেত্রের পরিস্থিতি বোঝা কষ্ট। সেটা একেবারে ভিন্ন জগত।

ইউক্রেন কি চায় সেটার তোয়াক্কা না করে ন্যাটো ইউক্রেনকে আক্রমণে ইন্ধন দিচ্ছে। এটা যে ন্যাটোর যুদ্ধ তাতে আর কারোই সন্দেহ নেই। প্রচুর লোকক্ষয় হচ্ছে জেনেও ন্যাটো বাখমুত থেকে ইউক্রেনকে সরে যেতে দিচ্ছে না। কেন? আমার মনে হয় কিছু দিনের মধ্যে ওরা নিজেরাই যুদ্ধে নামতে চায়। এখনও যে ইউক্রেনে ন্যাটোর সৈন্য নেই তা কিন্তু নয়। ন্যাটোর প্রচুর সৈন্য যুদ্ধ করছে। তবে তারা সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়ে এখানে এসেছে ভলেন্টিয়ার হিসেবে। এখন ওরা সরাসরি যুদ্ধে নামতে চায়। তাই সেটা ওদের বর্ডার থেকে যত দূরে হয় ততই মঙ্গল।

মহাভারতের কথা যেহেতু উঠল তাই বলি ইউক্রেনের এই যুদ্ধ অনেকটা কৌরব পাণ্ডবদের যুদ্ধের মত। কয়েক দিন আগে এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের সাথে দেখা হল। ও ক্রেমলিনের রক্ষীবাহিনীর সদস্য। বার সাতেক সিরিয়ায় গেছে যুদ্ধ করতে। বলল ইউক্রেনে দুই দিকেই আমরা। এটা সাইকোলজিক্যালি এফেক্ট করে। আমার মনে হল কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুনের কথা। দু’ দিকে নিজেদের লোক। এখানেও এমনকি ভাই ভাই, পিতা পুত্র দুই বিরোধী পক্ষের হয়ে লড়াই করছে এমন উদাহরণ অনেক। এটা যাকে বলে গৃহযুদ্ধ, যেখানে সন্ধি হয় না। কোন এক পক্ষের চুড়ান্ত বিজয়ের মধ্য দিয়ে যুদ্ধ শেষ হয়। কুরুক্ষেত্রে সারা ভারত যুদ্ধে নেমেছিল, এখানে প্রায় পঞ্চাশটি দেশ, তথাকথিত সমগ্র সভ্য দুনিয়া – যদিও তাদের সভ্যতা নিয়ে প্রশ্ন করার যথেষ্ট কারণ আছে। যদি সভ্যতা বলতে আমরা সাহিত্য, শিল্প, বিজ্ঞান প্রযুক্তি বুঝি আর বিগত কয়েক শ বছর ধরে বিশ্বের দেশে দেশে এদের লুটপাট, গণহত্যা আর নির্মম শোষণের কথা ভুলে যাই – তাহলে তারা নিঃসন্দেহে সভ্য। তবে সব কিছুর মত সভ্যতাও আপেক্ষিক। সোভিয়েত আমলে শীতল যুদ্ধ ছিল আদর্শের জন্য যুদ্ধ। এখানেও সেই অর্থে দুই ভিন্ন আদর্শের যুদ্ধ। একদিকে শত বছরের মূল্যবোধ, অন্যদিকে নিও লিবারেল দৃষ্টিভঙ্গি। একদিকে ট্র্যাডিশনাল পরিবার, অন্যদিকে এলজিবিটি বিপ্লব। যদি সমাজতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদের দ্বন্দ্ব ছিল মূলতঃ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক, বর্তমান দ্বন্দ্ব আরও গভীরে – বায়োলজিক্যাল, সাইকোলজিক্যাল। একদিকে অতীতের ভালোমন্দ সব কিছু স্বীকার করে, অতীতের ঐতিহ্য সাথে করে ভবিষ্যতের দিকে হাঁটা, অন্যদিকে অতীতের সবকিছু অস্বীকার করে অজানা পথে হাঁটা। এটা অনেকটা অক্টোবর বিপ্লবের পর পর রাশিয়ার সাথে পুঁজিবাদীদের যুদ্ধ – শুধু রাশিয়া এখন ট্র্যাডিশনের পক্ষে, ওরা সেটা ভাঙার পক্ষে। তবে রাশিয়া চেয়েছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তথা গরীবের মুক্তি, এরা চায় অধিকাংশ মানুষকে আরও বেশি করে শোষণের কারাগারে বন্দী করতে। আমার দৃষ্টিতে এই যুদ্ধে রাশিয়া পাণ্ডব পক্ষের প্রতিনিধি, তবে কেউ কেউ সেটা অন্যভাবেও ভাবতে পারে। কারণ ভালোমন্দ সেটাও নির্ভর করে কে কোথায় দাঁড়িয়ে, কোন এক্সিওম ব্যবহার করে ভালো বা মন্দ নির্ধারণ করছে তার উপর।

পড়ুন:  বিজ্ঞান ভাবনা (৯৬): নস্টালজিয়া -বিজন সাহা

যদিও আমাদের জীবন বলতে গেলে আগের মতই চলছে, রাস্তাঘাটে চলে বোঝার উপায় নেই যে দেশ একটা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে – একেবারে যে টেনশন নেই সেটা কিন্তু নয়। অন্তত আমি নিজে অনুভব করি। রাস্তাঘাটে অনবরত বিভিন্ন কাজকর্ম হয়। হঠাৎ অন্য রকম কিছু দেখলে প্রথমেই মনে হয় কোন সন্ত্রাসবাদী কিছু নয় তো। কিছুদিন আগে শুক্র আর বৃহস্পতি প্রায় গলাগলি করে দাঁড়িয়েছিল। দুবনার আকাশে ওদের স্থির দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রথমেই মনে হল ড্রোন নয় তো? মনে হয় আমি একা এমনটা ভাবি না। কারণ ইউক্রেন এখন সন্ত্রাসবাদী পথ ধরেছে। অনবরত আবাসিক এলাকা আক্রমণ করছে দনবাসে, রাশিয়ার সাধারণ মানুষের মনেও ভয় ঢোকানোর চেষ্টা করছে, তাই একটু সতর্ক না হলে চলে? এখানে মেট্রোয় ঢোকার সময় হাতের ব্যাগ বরাবরই চেক করে – ওটা এয়ারপোর্টের মত স্ক্যান করে। আগে যদি সেটা সিলেকটিভ ছিল এখন মোটামুটি সবাইকে ব্যাগ স্ক্যান করতে বলে।
আমাদের যাদের ছেলেমেয়ে আছে তাদের বাড়তি চিন্তা। জানি ছেলে যেহেতু এখনও আর্মিতে রুটিন ডিউটি করেনি  হুট করে ওকে যুদ্ধে পাঠাবে না। তবে যদি রুটিন ডিউটিতে ডাকে যেতে হবে। সেখানে তেমন কিছু শেখায় না, মূলত ব্যায়াম ইত্যাদি। যাকে বলে ডিসিপ্লিন শেখায়, যুদ্ধ করতে শেখায় না। কিন্তু সেই ট্রেনিং-এর পর ওকে ফর্মালি যুদ্ধে পাঠাতেই পারে। এটা অনেকটা ট্যাক্সের মত – ৯৯৯৯৯ টাকা বেতন হলে এক ট্যাক্স আর ১০০০০০ হলে ভিন্ন। সেদিক থেকেও যাদের বয়সী ছেলে আছে এবং যারা ছেলেদের যুদ্ধে পাঠাতে খুব একটা আগ্রহী নয় তাদের টেনশন তো থাকবেই।

বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী আক্রমণের কথা আগেই বলেছি। ক্রিমিয়ার ব্রীজ তাদের অন্যতম। টার্গেট কিলিং হয়েছে, হচ্ছে। বিভিন্ন সময় সীমান্ত এলাকায় গ্রাম বা অন্য কোন জনপদে আক্রমণ হচ্ছে। এখানে সেখানে রেল লাইন তুলে নেওয়া হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত ক্রেমলিনের উপর আঘাত। তবে এসবের বেশির ভাগই হচ্ছে মানুষের লোভের কারণে। যেমন ক্রিমিয়ার ব্রীজে যে বিস্ফোরণ হয় সেই ট্রাকের ড্রাইভার একটু বেশি ভাড়া পেয়ে কনটেইনার চেক করেনি। রেল লাইনে সন্ত্রাসী আক্রমণ করছে মূলত সরকার বিরোধী লোকজন যারা বিদেশী অর্থে তৈরি বিভিন্ন ছোটখাটো দল সমর্থন করে। সত্য বলতে কমবেশি জনসমর্থন প্রাপ্ত দলগুলো আর যাই করুক বিদেশের দ্বারস্থ হয় না দেশে রাজনীতি করার জন্য। যাদের তেমন জনসমর্থন নেই তারা বিদেশ থেকে আর্থিক ও প্রযুক্তি সাহায্য পায় আর পায় কি করতে হবে তার নির্দেশ। না, এটা রাশিয়া বা রুশদের ভালবেসে কেউ করে না, করে নিজেদের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ থেকে। আমাদের সব দেশে অনেক দলই ক্ষমতার জন্য বিদেশীদের সাথে দেন দরবার করে। তারা ভুলে যায় এভাবে ক্ষমতায় এসে বা ক্ষমতায় টিকে থেকে তারা আসলে দেশের স্বার্থ বিক্রি করে। ক্রেমলিনের উপর আক্রমণ সেই রকমের একটা। হয় সরকার বিরোধী বা ফ্যাসিবাদে বিশ্বাসী কাউকে রিক্রুট করেছে আদর্শগত কারণে অথবা কাউকে টাকা দিয়ে কিনেছে। অনেক সময় যারা এসব করে তারা নিজেরাই জানে না কার হয়ে কাজ করছে। সব জিনিসপত্র আর অর্ডার তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে পায়। ক্রেমলিন আক্রমণ সে রকমই কিছু। এখানে যতটা না আক্রমণ করা তারচেয়ে বেশি মিডিয়া হাইপ তৈরি করা। অন্যদিকে সাথে সাথে এসব ড্রোন রাডারে ধরা পরলেও শহরের উপর আক্রমণ করা রিস্কি। তাছাড়া এখানে এখন এত লোক ড্রোন চালায় যে কোনটা কি বলা কষ্ট। আমার অনেক বন্ধুরাই এসব করে ছবি তোলার জন্য। এই ঘটনার পরে মস্কো ও মস্কো অঞ্চলে ড্রোন ওড়ানো নিষিদ্ধ করা হয়েছে যেটা অনেককেই অখুশি করবে। পশ্চিমা বিশ্ব মানুষের মধ্যে সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ জাগিয়ে তুলতে চায়। অনেকের মতে এই আক্রমণের ধরণ ব্রিটেনের মি-৬ এর দিকে ইঙ্গিত করে।  উল্লেখ করা যেতে পারে যে যুদ্ধে এ ধরণের সন্ত্রাস বা নীতিহীনতা নতুন কিছু নয়। সেই মহাভারতের যুদ্ধেই সাত রথী মিলে অভিমন্যুকে চক্রব্যূহে আটকিয়ে হত্যা করে, অশ্বত্থমা ঘুমন্ত অবস্থায় পাণ্ডবদের পাঁচ সন্তানকে হত্যা করে অথবা রামায়ণের কাহিনী অনুযায়ী লক্ষণ উপাসনারত ইন্দ্রজিৎকে হত্যা করে। আমি ইউক্রেনের সন্ত্রাসবাদকে ন্যায়সঙ্গত রূপ দেবার চেষ্টা করছি না। তবে এসব ঘটনা যে হরহামেশাই ঘটে ইহিতাস তার সাক্ষী। আর সে কারণেই এর বিরুদ্ধে আগে থেকেই ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। উল্লেখ করা যেতে পারে যে ০৬ মে বর্তমানের শক্তিশালী রুশ লেখক, দনবাসের স্বাধীনতার প্রবক্তা জাখার প্রিলেপিনের উপর সন্ত্রাসী আক্রমণ হয়েছে। তিনি বেঁচে গেলেও তাঁর বন্ধু যিনি ঘটনাক্রমে সে সময় গাড়ি চালাচ্ছিলেন না, মারা গেছে। তাই এই আক্রমণ কমবে না, বরং দিন দিন বাড়তেই থাকবে। যুদ্ধ মানেই নির্মমতা। এটা ঠিক যে বর্তমানে যুদ্ধের নির্মমতা কমানোর জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তি আছে, আছে ভিয়েনা কনভেনশন যেটা যুদ্ধবন্দীদের রক্ষা করে। কিন্তু ইউক্রেন সেটা রক্ষা করেনি, বিভিন্ন সময়ে বন্দীদের হত্যা করে সেই ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ করেছে। এ নিয়ে রুশ কমেন্টাটরদের অনেকেই বিচলিত। কিন্তু যারা প্রকাশ্যে নিজেদের হিটলারের আদর্শের সেনা বলে দাবি করে তাদের কাছ থেকে কি মানবিক ব্যবহার আশা করা যায়? শুধু ওদের কথা বলি কেন? গণতন্ত্রের ধারক ও বাহক বলে পরিচিত আমেরিকাই কি কম যায়? আবু গ্রেইব, গুয়ান্টানামা এসব তো মাত্র কয়েক দিন আগের কথা।

আজকাল প্রায়ই যুদ্ধ বিরতির কথা শোনা যায়। আমেরিকা আর তার দোসররা বলে ইউক্রেন পাল্টা আক্রমণে জয়ী হলেই এমন চুক্তি হতে পারে। কিন্তু কার সাথে চুক্তি? মিনস্ক চুক্তি ছিল ইউক্রেন সমস্যা সমাধানের সর্বশ্রেষ্ঠ চুক্তি। কিন্তু ইউক্রেন সেটা মেনে চলেনি। এমনকি যাদের উপস্থিতিতে সেই চুক্তি সম্পন্ন হয়েছিল সেই জার্মানি ও ফ্রান্স স্বীকার করেছে যে তারা প্রথম থেকেই চুক্তি পালনের বিপক্ষে ছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল এই সুযোগে ইউক্রেনকে অস্ত্র সজ্জিত করা। এর মানে এদের সাথে কোন সমঝোতায় আসা একেবারেই অর্থহীন। তাছাড়া রুশরা প্রায়ই বলে ইউক্রেনের স্বাধীনভাবে কোন সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা নেই, সে পশ্চিমা বিশ্বের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। এর মানে চুক্তি করলে করতে হবে আমেরিকা বা ইউরোপের সাথে। কিন্তু বর্তমানে আমরা কি দেখি? ইউরোপের প্রতিটি দেশ নিজেদের ভালোমন্দ না দেখে অন্ধভাবে আমেরিকার স্বার্থ রক্ষা করছে আর রুশ বিরোধিতা করছে। শুধু কি তাই? যুদ্ধের ফলে ইউরোপ ও আমেরিকার সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মানের অবনতি ঘটলেও তারা ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহ করেই যাচ্ছে। এর ফলে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হচ্ছে, বাড়ছে মানুষের কষ্ট। কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্ব জনগণের সমস্যার সামাধান না করে অস্ত্র ব্যবসায়ীদের সেবায় নিযুক্ত। তাই ইউরোপ আমেরিকার বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাথে কোন চুক্তিতে আসা না আসা সমান কথা। কারণ সিদ্ধান্ত নেয় অন্য লোক – তা সে জর্জ সরোস হোক আর অন্যান্য মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানি হোক। যদি দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাত পা বৃহৎ পুঁজির কাছে বাঁধা থাকে তাহলে তারা না পারে দেশের মানুষের স্বার্থে কিছু করতে, না পারে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে। তারা অনেকটা প্রদীপের দৈত্যের মত, শক্তিশালী কিন্তু স্বাধীন নয়। তারা যখন যে প্রদীপের মালিক তার আদেশ পালন করে। বর্তমানে প্রদীপের মালিক তারা যুদ্ধ যাদের ব্যবসা – যুদ্ধই যাদের উপার্জনের অন্যতম প্রধান উপায়।

এ এক অদ্ভুত যুদ্ধ। একদিকে যুদ্ধ হচ্ছে, অন্যদিকে ব্যবসা বানিজ্য চলছে দু’ দেশের মধ্যে। অন্তত সেটাই মনে হয়। যেখানে সাধারণ মানুষ চায় সে দেশের ইনফ্রাস্ট্রাকচার ধ্বংস করা হোক, কেন সেটা করা হচ্ছে না – সেটাও বিরাট প্রশ্ন। কেন ক্রেমলিনে আক্রমণের পরেও সেদেশে উপর ব্যাপক ভাবে বোমাবর্ষণ করা হচ্ছে না – সেটাও প্রশ্ন। কারণ পশ্চিমা বিশ্ব একের পর এক সব অস্ত্রই ইউক্রেনকে দিচ্ছে। এভাবে হেলেদুলে যুদ্ধ করলে হয়তো একসময় আরও উন্নত অস্ত্রশস্ত্রের মোকাবিলা করতে হবে। আর তখন যুদ্ধ শুধু ইউক্রেনে নয় এদেশের মাটিতেও ছড়িয়ে পড়তেই পারে। সবচেয়ে বড় কথা পশ্চিমা বিশ্ব মনেপ্রাণে সেটা চায়। তারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কখন রাশিয়া ক্লান্ত হবে আর তারা হায়েনার মত ক্লান্ত ভালুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলবে। তবে আমার কেন যেন মনে হয় সেরকম অবস্থা হলে আমেরিকা, ইউরোপসহ উত্তর গোলার্ধের  সব দেশই পারমাণবিক ছাইয়ের নীচে ঢাকা পড়বে।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা
শিক্ষক, গণ মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়, মস্কো, রাশিয়া