মতামত

১৩৭তম মে দিবসে শ্রমিকের অধিকার কতটুকু প্রতিষ্ঠা পেলো? (শেষ পর্ব)

-তপন দত্ত

 

বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিক সংখ্যা প্রায় সাত কোটি। তার মধ্যে বড়জোর দেড় থেকে দুই কোটি শ্রমিক প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত। বাকী শ্রমিকরা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে।
এই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা সারা বছর কাজ পায় না। তাদের একটি বড় অংশ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার বঞ্চিত। শ্রমিকদের অর্জিত অধিকার ক্রমশ সংকুচিত করা হচ্ছে। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে বহুজাতিক পুঁজি, কর্পোরেট পুঁজি দেশীয় লুটেরা পুঁজি নুতন নুতন শব্দ ও ¯েøাগান আমদানী করছে।
এই সব ¯েøাগান বা কথার মূল বক্তব্য হলো পুুঁজির মালিক একদিকে নির্মম শ্রম শোষণ অব্যাহত রাখবে, দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলী দিয়ে বিদেশে পুঁজি পাচার করবে, কানাডা, বেগম পাড়া, মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম, দুবাই আমীরাতে বিশাল পুঁজি ব্যবসা খাতে বিনিয়োগ করেছে। সব দেশের ব্যাংক লুট করা টাকা আর ঘুষ দুর্নীতির টাকা। বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ‘‘মানি লন্ডারিং” করে পাচার করার অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করবে আর দেশের শ্রমিকদের উপর নির্যাতন, নিষ্পেষন শোষণ অব্যাহ্যত রাখবে। তারা আবার বলে ‘‘মালিক শ্রমিক ঐক্য গড়, ডায়ালগ কর ডায়ালগ কর।’’
‘‘এবার ঈদের মাস এপ্রিলে প্রবাসী আয় এসেছে ১৬৮ কোটি ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৬% কম (সূত্র-প্রথম আলো, ৪ঠা মে) প্রবাসীদের আয়ের একটি বড় অংশ মানি লন্ডারিং এর মাধ্যমে পাচার হয়। দেশে আসে না বৈদেশিক মুদ্রা। অথচ সরকারী সূত্রে প্রকাশ (২২-২৩) অর্থবছরে গড়ে প্রতিমাসে ১ লক্ষ লোক বিদেশে গেছে। কিন্তু ২০২২ সালের জুলাই থেকে ২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত ৯ মাসে বৈধ পথে রেমিটেন্স প্রবৃদ্ধির হার ডলারের হিসাবে মাত্র ৫% শতাংশ। এর মানে সিংহভাগ প্রবাসীই হুন্ডি পদ্ধতিতে রেমিটেন্স পাঠাচ্ছেন।’’ রেমিটেন্স প্রবাহ কমে গেল কেন ফলে রিজার্ভের সংকট (৬ সে. প্রথম আলো, ড. মইনুল ইসলাম) । যত ডলার দেশে আসার কথা তার বেশীর ভাগ মানি লন্ডারিং এর মাধ্যমে বিদেশে পাচার হয়েছে। লুটেরা পুঁজির মালিকরা ব্যাংকে ঋণ লোপাট করে ঘুষ, দুর্নীতি, কন্ট্রাকটরীর মাধ্যমে অর্জিত অবৈধ পুঁজি দিয়ে বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা অবৈধ ভাবে পাচার করছে।
আমাদের দেশ একটি জনবহুল দেশ। প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনঘনত্ব প্রায় দেড় হাজার। ঢাকা শহরে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৪৫,০০০ লোক বাস করে। ঢাকা শহর এখন উত্তপ্ত চুল্লীতে পরিণত হয়েছে। এইসব লুটেরারা নদী নালা, খাল বিল মিল সব কিছু দখল করে নিয়েছে। চট্টগ্রামে চলছে অবাধে পাহাড় কাটা। জনপ্রতিনিধি পাহাড় কেটে সাবাড় করছে। জলবায়ুর খাতে পরিবর্তনে ভূমিকম্প, ঘুর্ণিঝড়-আইলা-সুনামী বজ্রপাত ইত্যাদি সাংবাৎসরিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এই লুট-পাটও চালাচ্ছে লুটেরা ভূমি-দস্যু গোষ্ঠী।
মানুষকে পুঁজি লুটপাটকারী আর ভূমি লুটপাটকারীরা জিম্মি করে ফেলেছে। তাদের থায় সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়, শ্রমিকরা বিভান্ত হয়।
এখন শুনি চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কথা- তার সাথে আর্টিফিশিয়্যাল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কথা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সীমাবদ্ধতা আছে। সামাজিক সমস্যা সৃষ্টির সম্ভাবনা আছে। তারপরও উন্নত প্রযুক্তি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে এড়িয়ে চলার সম্ভাবনা দেখি না। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার রোবট মানুষের অনেক কাজ করে ফেলছে। লেখাপড়াও করছে। ফলে শ্রম অবমূল্যায়িত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। মালিকরা এখন কারখানা প্রতিষ্ঠানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্বলিত রোবট আমদানী করছে। আমাদেরও তাই প্রযুক্তি শিক্ষিত দক্ষ জনশক্তি তৈরী করতে হবে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সর্বশেষ সংযোজন চ্যাট জি.পি.টি বট। চ্যাট জিপিটি কিভাবে শ্রমকে অবমূল্যায়িত করবে তার একটি উদাহরণ তুলে ধরছি।
জার্মান প্রকাশক হেগেল স্প্রিংগার বলছেন,‘‘সাংবাদিকের চাকরীর জায়গায় বুদ্ধিমত্তা সম্ভাবনার নুতনদ্বার উন্মোচন করতে চলেছে, অন্যদিকে সাউথ চায়না মর্নিং পোষ্টের মুখপাত্র অস্কার লিউ জানালেন, চ্যাট জি.পি.টি সাংবাদিক হিসাবে রিপোর্ট লিখছে। গবেষণা করে দেখা গেছে, যে রিপোর্ট লিখতে একজন সাংবাদিকের ২ দিনের বেশী সময় লাগে জিপিটি মাত্র ৪০ সেকেন্ড ৯০০ শব্দের গ্রহনযোগ্য নির্ভর করার মত রিপোর্ট আধুনিক ভাষায় লিখে দিয়েছে। তাহলে ২ দিনের শ্রম আর ঘন্টার পর ঘন্টা ঘোরাঘুরির বদলে প্রত্যাশিত রিপোর্ট তৈরী হয়ে গেলে তা ভবিষ্যতে সাংবাদিকতার ঝুঁকির কথা ইঙ্গিত করে। কিন্তু যারা প্রম্পট্ (সঠিক শব্দের দিক নির্দেশনা) ব্যবহার জানবেন তারাই ভবিষ্যতের সাংবাদিকতায় টিকে থাকবেন। নুতন সময়ের দৌড়েঁ চাকুরী হারানোর ঝুঁকি এড়িয়ে যাওয়া কঠিন হবে-তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। জার্মান সংবাদপত্র মাধ্যম ‘বিল এন্ড ডাই ওয়েল্ট’ কর্মী ব্যয় কমিয়ে রাজস্ব বাড়াতে এবং পরিপূর্ণ ডিজিটাল মিডিয়া প্রতিষ্ঠান বিনির্মাণে কর্মী ছাঁটাই করার কথা ভাবছে। কারণ এ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এ আই) ক্রমবর্ধমান ভাবে সাংবাদিকদের কর্মক্ষেত্রে নিজের দক্ষতার পরিচয় দিতে শুরু করেছে। সুতরাং সাংবাদিকতা পেশায় কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তা ক্রমেই চাপ ও ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। শুধু তাই নয় স্বাধীন সাংবাদিকতাকেও তা চাপে ফেলবে।
জার্মানীর এক্সেল স্প্রিংগার তার কতজন কর্মীকে চাকুরীচ্যূত করবেন তা স্পষ্ট করেন নি। তবে প্রতিশ্রæতি দিয়েছেন প্রতিবেদক, বিশ্লেষক, সম্পাদক বা লেখকের সংখ্যায় তেমন কাটছাঁট হবে না। শুধু সাধারণ মানের কর্মীদের বিষয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ব্যাপকভাবে কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তা সম্বলিত ব্যবস্থা চালু হলে আমাদের দেশের মত শ্রম ঘন দেশে বহু মানুষ বেকারত্বের ঝুঁকিতে পড়ে যাবে। অর্থাৎ আরেকটি সামাজিক সংকট তৈরী হবে, বেকারত্ব প্রচন্ড বেড়ে যাবে বলে মনে হয়। কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তার প্রয়োগের ফলে যে সংকট সৃস্টি হবে তার সমাধানের পথ কি সেটাও ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনকে ভাবতে হবে।
আমাদের দেশ সহ বিশ^ব্যাপী নতুন আন্দোলনের যে ঢেউ দেখা যাচ্ছে তাতে সবকিছু হতাশাজনক বলে মনে হয় না। ”যতই মালিক-শ্রমিক ঐক্য গড়” ডায়লগ করার-কথা বলা হোক না কেন শ্রমিকেরা দাবী আদায ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকারে প্র¯তুত-বলে প্রতীয়মান হয়। সম্প্রতি বাংলাদেশের লক্ষাধিক চা শ্রমিকের দাবীর প্রতি মালিকপক্ষের চরম অবহেলা ও ন্যায্য মজুরি প্রদানে অস্বীকারের ফলে ৩ সপ্তাহব্যাপী চা শ্রমিকদের অভূতপূর্ব ধর্মঘট, ফ্রান্সে পেনশনের বয়সসীমা বৃদ্ধির বিরূদ্ধে, জার্মানীতে দ্রব্যমুল্যের উর্ধ¦গতির কারণে সারা দেশব্যাপী শ্রমিক ধর্মঘট-বিক্ষোভ মিছিল জানান দেয় কর্পোরেট পুজি-দেশীয় লুঠেরা পুজিঁ যতই মালিক-শ্রমিক ঐক্য গড় ¯েøাগান দিক না কেন পেটের তাগিদে শ্রমিকরা আন্দোলন-সংগ্রাম-লড়াই চালিয়ে যাবে। এ আন্দোলন-সংগ্রামকে সংগঠিতভাবে পরিচালনা করার জন্য সত্যিকারের শ্রম-বান্ধব আইন প্রণয়নের জন্য ও ন্যায্য মজুরি আদায়, অধিকার প্রতিষ্টার জন্য গণমুখী ট্রেড ইউনিয়ন-এর বিকল্প নেই। কর্পোরেট পুজিঁ, লুঠেরা পুজিঁর শোষন চির¯হায়ী নয়।
মে দিবস দীর্ঘজীবি হোক। দুনিয়ার মজদুর এক হও।

পড়ুন:  ১৩৭তম মে দিবসে শ্রমিকের অধিকার কতটুকু প্রতিষ্ঠা পেলো? (১ম পর্ব) -তপন দত্ত

-সমাপ্ত-

লেখকঃসভাপতি-টিইউসি, চট্টগ্রাম জেলা কমিটি ।