মতামত

১৩৭তম মে দিবসে শ্রমিকের অধিকার কতটুকু প্রতিষ্ঠা পেলো? (১ম পর্ব)

-তপন দত্ত

মহান মে দিবস শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের স্মারক হিসেবে সারা বিশ্বে পালিত হয়। উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত শ্রমিকদের ছিল না ন্যায্য মজুরীর নিশ্চয়তা ও কাজের নির্দিষ্ট সময়সীমা । নারী-শিশু নির্বিশেষে ১৬-১৮ ঘন্টা কাজ করতে হতো। অনেকটা দাস জীবন। তাদের কোন সংগঠন ছিল না। শ্রমিকেরা ছিল নির্যাতনে অতিষ্ঠ, বিচ্ছিন্ন বিদ্রোহ, কাজ ছেড়ে পলাতক হওয়া, ‘‘মেশিনই যত নষ্টের মূল’’ ভেবে মেশিন ভেঙ্গে ফেলা ইত্যাদি নৈরাজ্যিক অবস্থা সৃষ্টি শুরু হলো ইউরোপের শিল্প কারখানাগুলোতে।
জার্মান দার্শনিক কার্ল মার্কস, ফ্রেডরিক এঞ্জেলসের মত দার্শনিক ও সমাজ বিজ্ঞানীরা এই নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি গভীর অর্ন্তদৃষ্টি দিয়ে ভাবলেন। তাঁরা ইংল্যান্ডসহ বিভিন্ন ইউরোপীয় শিল্পায়নের গতি প্রকৃতি, শোষনের মাত্রা, অর্থনৈতিক অবস্থা, কৃষি ব্যবস্থা ভেঙ্গে শিল্পের যুগে প্রবেশ, যন্ত্রের ভূমিকা, উৎপাদনে শ্রমের ভূমিকা, মালিকের মুনাফা ইত্যাদি নিয়ে ব্যাপক গবেষণা/পর্যবেক্ষণ করে এই সিদ্ধান্তে আসলেন যে শ্রমিক যদি ৮ ঘন্টা কাজ করে তবে তার নিজের শ্রমের মূল্য ৪ ঘন্টায় অর্জিত হয়। বাকী ৪ ঘন্টা কাজ করে নতুন বিনিয়োগ ও মালিকের মুনাফা নিশ্চিত হয়। কাজেই ১৬/১৮ ঘন্টা কাজ করানো শুধু মুনাফা নয় অতি মুনাফার হাতিয়ার। অতিরিক্ত শ্রম ঘন্টার কারণে নিস্পেষণে শ্রম শক্তি অল্পদিনেই নিঃশেষ হয়। শ্রমের মজুরী দেওয়ার ক্ষেত্রেও মালিকের ইচ্ছাই শেষ কথা। কোন নিয়ম নীতি, সামঞ্জস্যপূর্ণ আইন, শ্রমিকের স্বপরিবারে দৈনন্দিন গ্রাসাচ্ছদনের প্রয়োজনটুকু সম্পর্কেও মালিক তোয়াক্কা করে না।


তাই শ্রমিকদের সংগঠিত প্রতিরোধ ছাড়া এই নির্মম শোষণ থেকে শ্রমিক শ্রেণী মুক্ত হতে পারে না। এই লক্ষ্যে মূলত ইউরোপের বিভিন্ন দেশের দার্শনিক, সমাজবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ শ্রমিক আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্টদের একটি আর্ন্তজাতিক সম্মেলন আহ্বান করা হয় ১৮৬৪ সালে লন্ডন শহরে। এই সম্মেলনে ৮ ঘন্টা শ্রম, ৮ ঘন্টা বিশ্রাম, ৮ ঘন্টা বিনোদন এই ন্যায্য দাবী গৃহীত হয়।
সম্মেলনে সর্বপ্রথম আর্ন্তজাতিক শ্রমিক আন্দোলন সংহত করার জন্য ‘‘১ম আর্ন্তজাতিক” নামে একটি সংগঠনের ভিত্তি শুরু হয়। তার পূর্বে অবশ্য ১৮৩০ সালে ‘‘লন্ডন ওয়ার্কম্যানস্ এসোসিয়েশন এবং চার্টিস্ট মুভমেন্ট’’ নামে ২টি শ্রমিক সংগঠন কাজ শুরু করেছিল। ‘র্চ্যর্টিস্ট মুভমেন্ট’ মূলত চার্টার অব ডিমান্ড আকারে একটি দাবীনামা বছর বছর ইংল্যান্ড পার্লামেন্টে পেশ করতেন এবং সেখানে কতকগুলি রাজনৈতিক দাবী যেমন- সাধারণ মানুষের ভোটাধিকার সম্বলিত দাবী প্রধান হয়ে উল্লেখ থাকতো। সাময়িক কিছু সুবিধার জন্য এ সংগঠন শুরু হয়েছিল।
শ্রমিক শ্রেনীর আন্দোলন যে বিশ্বব্যাপী অবিভাজ্য এবং শ্রমিকদের কর্মঘন্টা, ন্যায্য মজুরী, ট্রেড ইউনিয়নসহ সংগঠন করার অধিকার শ্রমিক শ্রেণীর যে বৈশ্বিক অধিকার তা ১৮৬৪ সালে ১ম আর্ন্তজাতিক থেকে সংগঠিতভাবে প্রথম উচ্চারিত হয়। শুধু মার্কস-এঙ্গেলস নয়, সম-সাময়িক বার্ণস্টাইন, হেগেল, মর্গাণ প্রমূখ দার্শনিক ও সমাজবিদগণও এ বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করেছিলেন।
কিন্তু বৃটিশ শাসক গোষ্ঠীর আগ্রাসনের ফলে লন্ডনে ১ম আর্ন্তজাতিক সংগঠনের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। ১৮৭৬ সালে আমেরিকায় ফিলাডেলফিয়ার ১ম আর্ন্তজাতিকের সদর দফতর স্থানান্তরিত হয়। তার দশ বছরের মধ্যে ১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরে ‘‘কর্মঘন্টা কমানো, নির্যাতন বন্ধ, ন্যায্য মজুরী, নারী শিশু শ্রমিকদের কর্মঘন্টা ইত্যাদি দাবীতে আন্দোলন আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে।
৮ ঘন্টা কর্মদিবসের দাবীতে গান বাঁধা হয়। এভাবে ৮ ঘন্টার দাবী বৈশ্বিক দাবীতে পরিণত হয়। ১৮৮৬ সালে আমেরিকার কতগুলি সফল ধর্মঘট পালিত হয়। ৪ঠা মে শ্রমিকদের সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান করা হয়। হে মার্কেটের সেই বিশাল সমাবেশকে রক্তের বন্যায় ডুবিয়ে দিতে মালিকপক্ষের, সরকারের ষড়যন্ত্র শুরু হয়। মালিকের লেলিয়ে দেওয়া গুন্ডা বাহিনী, ষড়যন্ত্রকারী আর পুলিশ বাহিনী শান্তিপূর্ণ সমাবেশকে রক্তের বন্যায় ডুবিয়ে দেয়। শত শত শ্রমিক নিহত আহত হয়। পরে এক সাজানো বিচারে শ্রমিক আন্দোলনের ৯ জন নেতাকে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়। পুঁজির স্বার্থ কত নির্মম হতে পারে তার ন্যাক্কারজনক উদাহরণ হলো হে মার্কেটের ঘটনা, প্রহসনের বিচার। ১ম আর্ন্তজাতিক প্রতিষ্ঠার ২৫ বছর পর ১৮৮৯ সালে এঙ্গেলসের নেতৃত্বে প্যারিসে ২য় আর্ন্তজাতিক সম্মেলন আহবান করা হয়। সেই সম্মেলনে প্রতিবছর ১ মে বিশ্বব্যাপী মে দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তখন থেকে বিশ^ব্যাপী শ্রমিক সংগঠনসমূহ ৮ ঘন্টা কাজের দাবী, ন্যায্য মজুরী ও অন্যান্য দাবীতে মে দিবস পালন করে আসছে। প্রথম মহাযুদ্ধ শেষ হলে ১৯১৯ বিশ্বের জাতিসমূহ যুদ্ধের বিপদ থেকে বিশ্বকে মুক্ত রাখার জন্য লীগ অব নেশনস গঠন করে। তার একটি অঙ্গ সংগঠন হিসাবে আর্ন্তজাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) প্রতিষ্ঠিত হয়। আই এল ও প্রথম অধিবেশনে ১নং কনভেনশন হিসাবে ৮ ঘন্টা শ্রম দিবসের দাবিটি সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে গৃহীত হয়। বিশ্বের যে সব রাষ্ট্র আইএলও’র সদস্য প্রায় সব দেশে ৮ ঘন্টা শ্রম দিবসের দাবী আইনগতভাবে স্বীকৃত। অর্থাৎ দীর্ঘ লড়াই সংগ্রাম রক্তে কেনা এই ৮ ঘন্টা কর্মদিবস মালিকের দয়ার দান নয়।
প্রায় ১৪ দশকে শুধু ৮ ঘন্টা কর্মদিবস নয়, বাঁচার মত মজুরী, শোভন কর্ম পরিবেশ, ট্রেড ইউনিয়ন করার স্বাধীনতা পছন্দমত নেতা নির্বাচনের অধিকার, মালিকের সাথে দর কষা-কষির অধিকার, সামাজিক নিরাপত্তামূলক পেনশন, গ্র্যাচুয়িটি, গ্রুপ বীমা, দূর্ঘটনা মুক্ত কর্মপরিবেশ দূর্ঘটনায় উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ, ন্যায্যমূল্যে রেসন, বাসস্থানের অধিকারসহ বহু দাবী অর্জিত হয়েছে।
কিন্তু দূর্ভাগ্যের বিষয় রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে শ্রমিক শ্রেণিকে অনেক অর্জিত অধিকার থেকে ক্রমান্বয়ে বঞ্চিত করা হচ্ছে। সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কন্ট্রাকটরী প্রথায় শ্রমিক নিয়োগ করার আইন, মালিকের প্রয়োজনে ৮ ঘন্টার স্থলে ১৬ ঘন্টা শ্রম দিতে বাধ্য করা, বাজার মূল্যের সাথে সঙ্গতিবিহীন মজুরী , কল-কারখানা প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তার ঘাটতি, ঘন ঘন দুর্ঘটনার শ্রমিক হতাহত হওয়ার ঘটনা ট্রেড ইউনিয়নে সংগঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে বল প্রয়োগ, চাকুরীচ্যূতির করে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা।
উৎপাদনের মূল উৎপাদিকা শক্তি তথা শ্রমিকদের গণতান্ত্রিক ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার হরণ করা ইপিজেড এসইজেড-এর ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার আইন করে নিষিদ্ধ রাখা, পছন্দমত নেতা নির্বাচনের অধিকারকে নানা আইনের মারপ্যাঁচে সীমাবদ্ধ রাখা, সর্বোপরি ট্রেড ইউনিয়নকে রাজনৈতিক দলের ভিত্তিতে বিভক্ত করা আজ বাংলাদেশের শ্রম সেক্টরে ট্রেড ইউনিয়নকে দুর্বল করে ফেলেছে। তার জন্য কিছু ট্রেড ইউনিয়ন নেতা কর্মীও দায় এড়াতে পারেন না। দেশী বিদেশী বিভিন্ন এনজিও নিজস্ব ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের জন্য টাকা পয়সা খরচ করছে। সাময়িক লাভের জন্য শ্রমিক নেতারাও বিভ্রান্ত হচ্ছে। সামগ্রিকভাবে, আজ বাংলাদেশের শ্রম সেক্টরে এই সংকট-সমস্যাসমূহ বিরাজ করছে।

পড়ুন:  ১৩৭তম মে দিবসে শ্রমিকের অধিকার কতটুকু প্রতিষ্ঠা পেলো? (শেষ পর্ব) -তপন দত্ত

২য় ও শেষ পর্ব আগামীকাল প্রকাশিত হবে

লেখকঃসভাপতি-টিইউসি, চট্টগ্রাম জেলা কমিটি ।