শিল্প সাহিত্য

অতীতের ঘর গৃহস্থালী

– নাহিদ ফারজানা

“সেথা এসে তার স্রোত নাহি আর,
কল কল ভাষ নীরব তাহার==
তরঙ্গহীন ভীষণ মৌন তুমি তারে কোথা লও!
হে অতীত, তুমি হৃদয়ে আমার কথা কও কথা কও । _____রবীন্দ্রনাথ ।

মন টানছিল কয়েকদিন ধরেই । ইচ্ছে হল অতীতে কান পাতি ।,তাই, এবার যখন দেশে গেলাম, কজনকে জুটিয়ে চলে গেলাম সোনারগাঁ । সবাই যায় , অনেকেই যায় ।কে কেন যায় জানিনা । আমি যাই অতীতের নীঃশব্দের কথাবলা শুনতে । বাংলাদেশ তো নয়ই, পূর্বপাকিস্তানও নয় এমনকি অবিভক্ত বঙ্গদেশও নয় তখনও । বঙ্গ, পুণ্ড্র, সমতট, সুহ্ম, হরিকেল এইসব রাজ্য নিয়ে আজকের বাংলা । সেন বংশের শাসকরাও এই স্থানটিকে নির্বাচন করেছিলেন অন্যতমরূপে । দেব বংশের দশরথদেব তাঁর রাজপাট পরিচালনা করার জন্যই এই সুবর্ণ গ্রামকেই বেছে নিয়েছিলেন রাজধানী ,তাই বিক্রমপুর থেকে সরিয়ে নিয়ে এলেন এখানেই । মেঘনা, শীতলক্ষ্যা , ব্রহ্মপুত্র নদী তিন দিকে ঘিরে রেখেছে ।

 

এই সোনারগাঁ প্রাচীন কাল থেকেই ছিল একটি নদীবন্দর, বিখ্যাত মসলিন নাকি এই বন্দর দিয়েই রপ্তানী হত । শৌর্য বীর্যে এই অঞ্চলের শাসকরা ছিলেন শক্তিশালী । খৃষ্টের জন্মের ৩২৬ বছর আগে আলেকজাণ্ডারের বিজয় রথ থমকে গিয়ে পিছু হঠে গিয়েছিল বঙ্গের শাসকের হস্তিযূথের সৈন্যবাহিনী দেখে । “ রাজা যায় , রাজা আসে” । দীর্ঘ সুলতানী আমল, বারো ভুঁইয়ার ঈশা খাঁ ও তার বংশধর এখানেই । এবং শেষ পর্যন্ত মোগল আমলের সম্রাট ঔরঙজেব ১৬১০ খৃষ্টাব্দে বাংলার রাজধানী এখান থেকে ঢাকায় না যাওয়া পর্যন্ত, এইখানেতেই ছিল শাসন কেন্দ্র বা বাংলার রাজধানী । এই সেই স্বর্ণগ্রাম , বর্তমানের সোনারগাঁ । কত কাহিনী , কত বিষাদ বেদনা , কত মিলন বিরহ , কত বসন্তের ফুল ফোটার কাহিনী ছড়িয়ে আছে এর পথে পথে ।ঘুরে ঘুরে দেখলাম। কান পেতে রইলাম অতীতের কথা শোনার জন্য । । কিন্তু দুটি বিষয় আমাকে পীড়া দিল । খণ্ড খণ্ড করে দেখার এলাকাগুলি ভাগ করে বারে বারে টিকিটের টাকা আদায় নির্দিষ্ট সময়ের জন্য । ছড়ি হাতে মাষ্টারের মত পাহারাদার ঘড়ি দেখে তাড়া করছে পর্যটকদের । এদের আরো নম্র হওয়া প্রয়োজন বলে মনে হল । আর একটিকিটে সব কিছু ঘুরে দেখার , অতীতকে অনুভব করার সময় দেবার ব্যবস্থা বিদেশীদের কাছে সুনাম অর্জন করবে । আর একটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হল । প্রাচীন অবশেষকে নবায়নের ক্ষেত্রে সেই সময়কালকে বর্তমানে উপস্থিত করার জন্য পুরাতাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞ স্থপতির পরামর্শ দরকার । নির্মাণের প্রাচীন শৈলীর সাথে মিলিয়ে নবায়ন করাই উচিত নইলে আমাদের দেশের এত প্রাচীন ঐতিহ্যের যে ইতিহাস তা ফুটে ওঠেনা । তবু দিন কেটে গেল হু হু করে । মনের ঝোলায় আনন্দের সওদায় পূর্ণ করে ফিরে এলেম । গর্ব অনুভব করলাম আমার জন্মভূমির বহতা সংস্কৃতির ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের জন্য ।

আটলান্টা, জর্জিয়া, ইউ এস এ। ।