মতামত

শিল্প সম্পর্ক উন্নয়নে মালিক-শ্রমিক ও রাষ্ট্রের ভূমিকা

-ফজলুল কবির মিন্টু

ফজলুল কবির মিন্টু (ফাইল ছবি)

শিল্প প্রতিষ্ঠান বলতে সাধারনত আমরা বুঝি যেখানে কাঁচা মাল প্রক্রিয়াজাত করে পণ্য উৎপাদন, মোড়কজাত ও বিপনন করা হয়। অবশ্য পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ছাড়া ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন, হসপিটালিটি, হাসপাতাল, ক্লিনিক এবং প্যাথলিক্যাল সেন্টারসহ বিভিন্ন ধরণের সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান সমূহকেও শিল্প প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। শিল্পের প্রধানত তিনটি পক্ষ –মালিক, শ্রমিক এবং রাষ্ট্র। শিল্পের এসকল পক্ষসমূহের আন্ত সম্পর্ককে শিল্প সম্পর্ক বলে।

উপরোক্ত তিনটি পক্ষসহ পরোক্ষভাবে শ্রম ইস্যুতে কাজ করে এমন বিভিন্ন এনজিও, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং উন্নয়ন সহযোগী দেশ, শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট বিদেশী ক্রেতা ইত্যাদিকেও  শিল্পের পক্ষ হিসাবে বিবেচনা করা হয়।

মালিক শিল্পের মূলধনের যোগানদাতা। শ্রমিক শিল্পের উৎপাদিকা শক্তি তবে ২০১৩ সালের সংশোধনীতে শ্রম আইনের ২(৬৫) ধারায় তদারকি কর্মকর্তা এবং ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গকে শ্রমিকের সংজ্ঞা থেকে বাদ দেয়ার ফলে পোশাক কারখানাসহ অন্যান্য সেক্টরের কলকারখানায় সুপার ভাইজার বা লাইন লীডাররা উৎপাদন কার্যক্রমের সাথে সরাসরি যুক্ত থাকা সত্ত্বেও তারা শ্রমিক কিনা তা নিয়েও ধোঁয়াশা আছে। অন্যদিকে রাষ্ট্র তার ভূখন্ডে অবস্থিত শিল্প পরিচালনায় বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দিয়ে আইন ও বিধিমালা প্রনয়ন করে শিল্পের মালিক  ও শ্রমিকের মধ্যে উন্নত শিল্প সম্পর্ক গঠনে ভূমিকা পালন করে থাকে।

শিল্পের মধ্যে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ পক্ষ আছে। পক্ষটি হচ্ছে, অফিস কর্মকর্তা বা কর্মচারী। এরা শিল্পের উৎপাদন বা সেবা কার্যক্রমের সাথে সরাসরি যুক্ত না থাকলেও শিল্প পরিচালনায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এদের অবস্থা সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণির মতই আমার কাছে মনে হয়। এমনকি বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এবং শ্রম বিধিমালা ২০১৫তেও এইসকল কর্মকর্তা বা কর্মচারীদেরকে তেমন কোন সুরক্ষা দেয়া হয়নি।

শিল্প সম্পর্ক প্রধানত দুইটি এপ্রোচ নিয়ে পরিচালিত হয়। একটি হচ্ছে সহযোগিতামূলক (Collaborative) আর অন্যটি হচ্ছে সংঘাতমূলক (Conflictive)। শিল্প সম্পর্ক সহযোগিতামূলক হবে নাকি সংঘাতমূলক হবে তা নির্ভর করে মালিকের দৃষ্টিভঙ্গি এবং ভূমিকার উপর। তবে শিল্পকে টেকসই করতে হলে -শিল্পের পরিবেশ স্থিতিশীল এবং সৌহার্দপূর্ণ করতে চাইলে  সহযোগিতামূলক  শিল্প সম্পর্কের কোন বিকল্প নেই। সংঘাতমূলক শিল্প সম্পর্ক অনেক সময় আপাত দৃষ্টিতে কিছু বিভ্রান্ত মালিক পক্ষের কাছে লাভজনক মনে হতেও পারে কিন্তু চূড়ান্ত বিবেচনায় সংঘাতমূলক শিল্প সম্পর্ক শিল্পের জন্য কখনোই মঙ্গলজনক হতে পারে না।

শিল্প সম্পর্কের প্রধানতম ভিত্তি হচ্ছে পারস্পরিক বিশ্বাস। কোন প্রতিষ্ঠানে স্বচ্চতা (Transparency), জবাবদিহিতা (Accountability) এবং পরস্পরের প্রতি সম্মানবোধ (Respect to each other) এর চর্চা থাকলে উক্ত প্রতিষ্ঠানে পক্ষ সমূহের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস স্থাপিত হয় এবং ফলশ্রুতিতে সেই প্রতিষ্ঠানের শিল্প সম্পর্ক সহযোগিতামূলক হয় এতে শিল্পের শ্রমিকদের আত্মবিশ্বাস ও কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি পায় এবং উৎপাদনে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পেতে সহজ হয় আর যদি শিল্প পরিচালনায় এই তিনটা বিষয়ের কোন একটার ঘাটতি থাকে তাহলে তা শিল্প সম্পর্ককে নেতিবাচক (Negative) তথা সংঘাতমূলক সম্পর্কের দিকে ধাবিত করে। যা শিল্পের জন্য সুখকর হয়না।

শিল্প সম্পর্ক ব্যবস্থাপনাকে অনেকে কাঁচের পাত্র রক্ষনাবেক্ষনের সাথে তুলনা করে থাকে। কেননা সম্পর্ক যতই দৃঢ় হোক সামান্য ক্ষুদ্র ইস্যুতেও সম্পর্কের অবনতি হওয়ার আশংকা থাকে। অর্থাৎ কাঁচের পাত্রের মতই এই সম্পর্ক অনেক যত্ন সহকারে সাবধানতার সাথে পরিচালনা করতে হয়। একটি টেকসই, গঠনমূলক শিল্প সম্পর্ক বজায় রাখার মূল দায়িত্ব মূলত মালিক পক্ষের পক্ষ থেকে মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের। সুতরাং প্রতিষ্ঠানের পারস্পরিক বিশ্বস্থতা অর্জনে এবং সহযোগিতামূলক শিল্প সম্পর্ক গঠনে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য।

সুস্থ্য শিল্প সম্পর্ক বজায় রাখতে হলে প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে একটি নীতিমালা থাকা বাঞ্চনীয়। একজন শ্রমিকের প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ লাভের পর হতে চাকুরী অবসান পর্যন্ত এবং চাকুরীকালীন মজুরি প্রদান, বছর শেষে মজুরি বৃদ্ধি, দৈনিক কর্মঘন্টা, অতিরিক্ত কর্মঘন্টা, সবেতন ছুটি, নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটি, শৃংখলা ভঙ্গের দায়ে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পদ্ধতি, শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও নিরাপত্তা, ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার এবং দরকষাকষি করার অধিকার, শ্রমিকদের পক্ষ থেকে ব্যক্তিগতভাবে এবং দলগতভাবে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ বরাবর অভিযোগ জানানোর পদ্ধতি ইত্যাদি নানাবিধ বিষয় নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, সম্পূর্ণ নির্মোহভাবে নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোন থেকে নীতিমালা পালনের চর্চা করতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে শিল্পের মধ্যে পক্ষ সমূহের মধ্যে সংঘাত এবং অবিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি হয়। তবে সংঘাতের পরিস্থিতি তৈরি হলেই সম্পর্ক নষ্ট হয় না। সংঘাতের বিষয়গুলো সঠিকভাবে চিহ্নিত করে তা যদি সমাধানের উদ্যোগ নেয়া যায় তাহলে বরং শিল্প সম্পর্ক দৃঢ় হয় এবং টেকসই হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হচ্ছে আমাদের দেশে কলকারখানায় কোন রকম সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ সংঘাতের কারন খুঁজে বের না করে ধামাচাপা দেয়ার বা কৌশলে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। এধরনের চর্চা সুস্থ্য ধারার শিল্প সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। এপ্রসঙ্গে আমার একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা আলোচনা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি। আমার জানা মতে চট্টগ্রাম ইপিজেডে সবচেয়ে বড় শ্রমিক অসন্তোষ হয়েছিল কোরিয়ান মালিকানাধীন ইয়ং ওয়ান গ্রুপের কারখানাগুলোতে। অথচ চট্টগ্রাম ইপিজেড সম্পর্কে ন্যুনতম জ্ঞান রাখেন এমন সবাই এক বাক্যে স্বীকার করবেন ইয়ং ওয়ানের কর্ম পরিবেশ এবং শিল্প সম্পর্ক অত্যন্ত চমৎকার। কিন্তু এরমধ্যেও যে সমস্যাটি ছিল সেটা হচ্ছে –শ্রমিকদের ছোট-খাটো অভিযোগকে যথাযথভাবে আমলে না নেয়া। ফলে অনেকগুলো ছোটখাট সমস্যা জমতে জমতে এক সময় বড় সমস্যায় রূপান্তরিত হয়ে বিস্ফোরিত হয়েছে। ইপিজেডের উক্ত ঘটনায় আমাদের শিক্ষা দেয় যে, প্রতিষ্ঠানের কর্ম পরিবেশ যতই সুন্দর থাকুক কিংবা মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক যতই মধুর হোক না কেন ছোট-খাট সমস্যা থাকতেই পারে এবং এই সকল সমস্যা থাকা কোনভাবেই খারাপ কিছু নয় কিন্তু সমস্যা বুঝতে না পারা কিংবা সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ না নেয়া কিংবা সমস্যাকে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করা কোন প্রতিষ্ঠানের জন্য কখনোই  উত্তম অনুশীলনের দৃষ্টান্ত হতে পারে না।

উন্নত ও সুস্থ্য ধারার শিল্প সম্পর্ক বজায় রাখার স্বার্থে শ্রমিকদেরকে পক্ষ হিসাবে স্বীকার করা নেওয়া এবং শিল্প পরিচালনায় ও উৎপাদন কার্যক্রমে সিদ্ধান্ত গ্রহনে শ্রমিক পক্ষের মতামতকে আমলে নেয়া উচিৎ। এই কাজটা তখনই সফলভাবে সম্পন্ন করা যায় যদি প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের ইউনিয়নে যোগদানের সুযোগ, দরকষাকষির ও শিল্প বিরোধ উত্থাপনের সুযোগ থাকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের দেশে মালিক পক্ষের কাছে ট্রেড ইউনিয়ন সম্পর্কে ধারণা খুবই নেতিবাচক। মালিক পক্ষের এমন ধারণাও শিল্প সম্পর্ক রক্ষায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। সুতরাং শিল্পের স্বার্থে মালিক বা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের এমন ধারণা যত দ্রুত পরিহার করা যাবে ততই উত্তম।

মনে রাখতে হবে টেকসই শিল্পের জন্য মালিক-শ্রমিকের সমান অবদান অপরিহার্য। কোন ধরণের দ্বন্দ্ব, বিবাধ বা মত পার্থক্য দেখা দিলে সম্মানজনকভাবে সমাধাননের পথ খুঁজে বের করতে হবে। কোন পক্ষই যেন মনে না করে যে, সে অন্যায় কিংবা অবিচারের শিকার হয়েছে। কারন সেরক্ষত্রে সংকট থেকে যাবে যা ভবিষ্যতে আরো বড় সংকটের কারন হতে পারে। এছাড়া রাষ্ট্রের শিল্প সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সমূহকে নিয়মিত তদারকি কার্যক্রমের মাধ্যমে সুস্থ্য শিল্প পরিবেশ বজায় রাখার উদ্যোগ অব্যাহত রাখতে হবে। শিল্প প্রতিষ্ঠান যেকোন দেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি। শিল্পে কোন রকম অস্থিরতা দেখা দিলে তা দেশের অর্থনীতিতে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। তাই রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সমূহকে কলকারখানা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানে শৃংখলা বজায় রাখার জন্য সম্পূর্ণ নিরপেক্ষে দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দায়িত্ব পালন করতে হবে। অনেক সময় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সমূহের ভূমিকা নিয়েও নানাবিধ প্রশ্ন দেখা দেয় –যা কোনভাবেই কাম্য নহে।

(লেখকঃ সংগঠক, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, কেন্দ্রীয় কমিটি)