চলমান সংবাদ

প্রবাসে বাঙালির বর্ষবরণ

নতুন বছরের আবাহন বাংলার মানুষ,  প্রকৃতি ও সমাজ জীবনের একটি বিশেষ প্রথা। এই নবীন বরণের ধারা বাঙালি জীবন যাপনের মধ্যে সমাজিক ও ধর্মীয় রীতিকে  অতিক্রম করে বৃহত্তর বাঙালি সত্বাকে সমৃদ্ধ করে।

এই বছর আমরা আধুনিক বাংলা ক্যালেন্ডারের ১৪৩০ তম বছরে পদার্পণ করলাম, সূর্য্য সিদ্ধান্ত নির্ভর এই ক্যালেন্ডার নিয়ে ধারণা করা হয় যে সম্রাট আকবরের সময় থেকে এটি প্রচলিত। অনেকের ধারণা এটি গৌড়াধিপতি শশাঙ্কের সময় চালু হওয়া বাংলা ক্যালেন্ডার এর পরিবর্তিত রূপ। এই তর্কের গভীরে না গিয়েই বোঝা যেতে পারে যে বাংলা পঞ্জিকার (অর্থাৎ ক্যালেন্ডার) মূল প্রয়োজন, মধ্যযুগ ও তার পরবর্তী আধুনিক ইতিহাসের সময়কালে, মূলত ঋতুর পরিবর্তনের সাথে মানুষের জীবন, জীবিকার প্রবাহ কে মসৃন করা। সম্ভবতঃ সেন রাজাদের সময় থেকে, বাংলার সুলতানী পর্যায় অতিক্রম করে, মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনস্থ সুবাহ বাংলার নবাবরাও এই সনাতনী পঞ্জিকা ব্যবহার করতেন তাদের রাজ্য পরিচালনার সময়সূচি হিসাবে। আর বাংলার জনসাধারণ তাদের জীবন যাত্রার সব ক্ষেত্রে এই পঞ্জিকা অনুসরণ করে এসেছেন কয়েক দশক আগে পর্যন্ত, এবং এখনও করেন ধর্মীয় ও পারিবারিক ক্ষেত্রে। প্রশাসনিক ও আধুনিক নাগরিক জীবনে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার প্রভাব বিস্তার করলেও, গ্রাম বাংলার প্রাত্যহিক ও সমাজ জীবনে বাংলা ক্যালেন্ডার এখনো অপরিহার্য।

বিগত ৪ বছর মার্কিন দেশে থাকার অভিজ্ঞতায় এই প্রথম বার আমি বাংলা নববর্ষ উদযাপনে অংশী হলাম, “আটলান্টা বেঙ্গলি ফোরাম” এর মানুষদের এই রকম একটি সুন্দর পরিপাটী আয়োজনের জন্য ধন্যবাদ ও বাহবা অবশ্য প্রাপ্য। বছরের পর বছর এই ভাবে বিদেশে নিজের ভাষা, সংস্কৃতিকে ধারণ করা শুধু নয়, নিয়মিত চর্চার মাধ্যমে তার শ্রীবৃদ্ধি ঘটানো, অন্তরের ভালোবাসা ও আবেগ ছাড়া সম্ভব নয়। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে যখন নতুন বছরের ভোর হবে, আটলান্টায় তখনও আগের বছরের শেষ সন্ধ্যা। কিন্তু আমরা সবাই এই সন্ধ্যায় একত্রিত হলাম, নতুন বছরকে বরণ করার উদ্দেশ্যে। “এস হে বৈশাখ” এর সুরে ও কথায় ফোরাম এর মহিলা বর্গের মধুর আহ্বানে অনুষ্ঠানের শুরু হয়, এরপর সারা সন্ধ্যা রবীন্দ্রসঙ্গীত, আবৃত্তি, স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি,  লোকগান, নৃত্য, ইত্যাদি কর্মকান্ড দিয়ে ফোরাম এর প্রবীণ, নবীন ও ছোট্ট সভ্যবৃন্দ নতুন বছরের শুরুটা প্রাণবন্ত করে তুলেছিলেন। এর সাথে ছিল দারুন এক ভোজের আয়োজন, এখানেও সবাই তাদের রন্ধন শিল্পের উৎকর্ষ প্রমাণ করে, একের পর আরেক অসাধারণ পদ দিয়ে, সকলের রসনাকে পরিতৃপ্ত করে তুলেছিলেন।

যদি তুলনা টানতে হয় বিদেশে বর্ষবরণ এর সাথে, দেশে আধুনিক এই রীতির, তাহলে আমার সীমিত অভিজ্ঞতায় বিশেষ পার্থক্য চোখে পড়েনি আনুষ্ঠানিকতায়; ধর্মীয় আচার, পূজা পার্বন পালনের তারতম্য ভৌগোলিক দূরত্ব ও প্রবাসে থাকার কারণে খুব স্বাভাবিক। আমার অভিজ্ঞতা সীমিত বলার কারণ, আমার শৈশব থেকে ৩ দশক কেটেছে পশ্চিমবাংলার শহরতলি, মফস্বল ও গ্রামাঞ্চলের চৈত্রসংক্রান্তি ও নববর্ষ প্রত্যক্ষ্য করে। সেক্ষেত্রেও সমগ্র পশ্চিবাংলার জেলাগুলি আমার প্রতক্ষ্য করা হয়নি, আর অতবড় বাংলাদেশ আমার জানার পরিধির বাইরেই থেকেছে অন্তত ৫-৬ বছর আগে পর্যন্ত, এবং চাক্ষুস করা এখনো হয়ে ওঠেনি। যাইহোক পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী দক্ষিণবঙ্গে আমার দাদু বাড়ি হওয়ায়, চৈত্রসংক্রান্তি, শিবের গাজন, নীল পূজা, চড়ক পূজা, ইত্যাদি নিয়ে অনেক স্মৃতি আছে। যেমন গাজন উপলক্ষ্যে গ্রামে যুবকদের সাময়িক সন্যাস যাপন করা, আগুন ঝাঁপ, কাঁটা ঝাঁপ (অনেক ক্ষেত্রে খেজুর গাছের ওপর উঠে কাঁটা ভরা পাতার গোড়ায় পা রেখে গাছ কে প্রদক্ষিণ করা ও কাঁটা সমেত পাতা ভেঙে ছুড়ে ফেলা), এই সব প্রথা সাধারণত নীলপূজার আগের দিন পর্যন্ত হয়ে থাকে, এবং চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন নীল পূজা ও সংক্রান্তির দিন চড়ক পূজা হয়ে থাকে। নীলের উপবাস, শিবের পূজা, চড়ক পূজার মেলা, ইত্যাদি পশ্চিমবাংলার গ্রাম, শহর, মহানগর কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে হয়ে থাকলেও, গাজন এর প্রথা সাধারণত গ্রামাঞ্চলে প্রত্যক্ষ্য করা যায়। কলকাতা ও শহরতলির বর্ষবরণ বলতে গেলে, সীমিত অঞ্চলে সংক্রান্তির দিনে চড়ক পূজা, নতুন বছরে সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আমিষ, নিরামিষ বাহারি রান্না, মিষ্টি খাওয়া ও খাওয়ানোতে সীমাবদ্ধ। তাই নাগরিক জীবনের এই প্রথায় প্রাচীন বাংলার জীবন চিত্রের থেকে আধুনিকতার ছাপ বেশি; এবং এইক্ষেত্রে হয়তো বিদেশে বসবাসরত বাঙালিদের উদযাপনের নির্ঘন্টের সাথে বিশেষ পার্থক্য হবে না, যদিও বিদেশে থাকা বাঙালিদের এই বর্ষবরণ অনেক বেশি ঘরোয়া ও আন্তরিক বলে আমার মনেহয়েছে।

এখন বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হিন্দু ধর্মের মানুষদের মধ্যে, এমনকি ভারতের ত্রিপুরার বাঙালিদের মধ্যেও গাজন, নীল পূজা, চড়ক পূজার প্রথা ছাড়াও, তাঁদের নিজস্ব আচার, পার্বন, রীতি, ইত্যাদি প্রচলিত থাকবে, খুব স্বাভাবিক। কিন্তু জাতি হিসাবে বাংলাদেশের মানুষ এই দিনটি বিশেষ ভাবে উদযাপন করেন, যা আমার সংবাদ, দূরদর্শন ও কিছু পরিচিত মানুষের থেকে জানা। এর মধ্যে বৈশাখী মেলা, মঙ্গল শোভাযাত্রা, ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া বাংলাদেশ ও ত্রিপুরার মানুষদের সংক্রান্তিতে রকমারি সবজি, শাক, বীজ, ডাল সব মিশিয়ে নানান স্বাদের সমন্বয়ে পাচঁন নামক পদ রান্না ও খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। এছাড়া দুই বাংলার প্রভূত গ্রাম, গঞ্জে বৈশাখের মেলা, সব ব্যবসায়ীদের হালখাতা, ইত্যাদি প্রথা উল্লেখযোগ্য।

সব শেষে বলতে হয় যে এত বহুবিধ সংস্কৃতিক, ধর্মীয়, সামাজিক অনুষ্ঠান, রীতি, প্রথার ভেতর দিয়ে, আধুনিকতা কে সঙ্গে নিয়েই, বিপুল সংখ্যক মানুষ, যাদের মাতৃভাষা বাংলা, তাঁরা এই ভাষা, সংস্কৃতিকে ক্রমাগত পরিপুষ্ট করে যাবেন, এই বিশ্বাস আমাদের সিংহভাগের আছে বলেই মনেহয়।

তরুণ সরকার, ২২সে এপ্রিল ২০২৩ (বাংলা ১০ই বৈশাখ ১৪৩০)

আটলান্টা , জর্জিয়া, ইউ এস এ।