চলমান সংবাদ

কবি সেলিনা শেলীকে হয়রানি বন্ধের দাবিতে চট্টগ্রামে সর্বস্তরের নাগরিকদের মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ

– ধর্মের নামে বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ চলবে না

কবি সেলিনা শেলীকে হয়রানি বন্ধের দাবিতে চট্টগ্রামে সর্বস্তরের নাগরিকদের মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশের একাংশ
ফেসবুকে দেয়া পোস্টকে কেন্দ্র করে কবি, শিক্ষক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক সেলিনা আক্তার শেলীকে হয়রানির প্রতিবাদে মাননবন্ধন ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। সমাবেশ থেকে সেলিনা শেলীকে অবিলম্বে চট্টগ্রাম বন্দর মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পদে পুনর্বহাল এবং তাকে হয়রানি বন্ধের জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানানো হয়েছে। একইসঙ্গে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করে মানুষের বাকস্বাধীনতা ফিরিয়ে দেয়ারও দাবি জানানো হয়েছে। সমাবেশে চট্টগ্রামের বিশিষ্ট নাগরিকেরা বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আমরা যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। স্বাধীন দেশে একজন নাগরিক তার মত প্রকাশ করতে পারবে না, কথা বলতে পারবে না, এমন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু আমাদের দেননি। ধর্মের নামে নানা অজুহাত তুলে ধর্মান্ধ গোষ্ঠী প্রতিনিয়ত দেশের মুক্তচিন্তার নাগরিকদের যেভাবে হেনস্থা করছে, এর বিরুদ্ধে আমরা সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানাচ্ছি। একইভাবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা কেড়ে নেয়ার প্রতিবাদ জানাচ্ছি। এই আইন অবিলম্বে বাতিল করুন। ধর্মান্ধ-প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর লাগাম টেনে এদেশের আপামর নাগরিকদের স্বাধীনভাবে বসবাস ও মতপ্রকাশের অধিকার সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে।’ বুধবার (১৯ এপ্রিল) বিকেলে চট্টগ্রাম নগরীর চেরাগি চত্বরে ‘সর্বস্তরের সংস্কৃতিকর্মী ও সচেতন নাগরিক সমাজ’র ব্যানারে এ কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে মুক্তিযুদ্ধের গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ বাঙ্গালি করেছে। কোনো ধর্মীয় পরিচয়ে কেউ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়নি। একাত্তরে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান আমরা সবাই এক থালায় ভাত খেয়ে মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জন করেছিলাম। এখন হিন্দু-মুসলিম যে বিভাজন, এটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী। চট্টগ্রাম বন্দরে আমি একবার গিয়েছিলাম মুক্তিযুদ্ধের গণকবরগুলো দেখতে। একটি গণকবরের উপর রাস্তা হয়ে গেছে, তার কোনো চিহ্ন নেই। বন্দর কর্তৃপক্ষ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণে কোনো ভূমিকা রাখেনি। আমি বন্দর কর্তৃপক্ষকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত করতে চাই। এই বন্দর কর্তৃপক্ষ অহেতুক মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে সরকারকে বিরুদ্ধে লাগানোর চেষ্টা করছে।’
ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক সভাপতি প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার বলেন, ‘আজ হতাশা নিয়ে আমি বলতে চাই, আমরা জীবন বাজি রেখে কি এই দেশটি অর্জন করেছিলাম ? এদেশে একটি শব্দ উচ্চারণের পর আমাকে দ্বিধায় থাকতে হয় যে, আমি কোনো ষড়যন্ত্রে পড়ে যায় কি না। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া দলের সরকার ক্ষমতায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আমরা দেশ স্বাধীন করেছিলাম। আমরা কথা বলতে পারবো না, আমরা নিঃশ্বাস নিতে পারবো না, এমন বাংলাদেশ তো বঙ্গবন্ধু আমাদের উপহার দেন নি। আপনারা বঙ্গবন্ধুর উত্তরসূরী হিসেবে নিজেদের দাবি করেন। আমরা প্রমাণ চাই যে, আপনারা বঙ্গবন্ধুর উত্তরসূরী। বন্দরের যে কুলাঙ্গাররা স্বাধীন মতপ্রকাশের জন্য সেলিনা শেলীর গলা কাটার চেষ্টা করছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন। আমাদের কন্ঠ কেউ থামাতে পারবে না। আমরা কথা বলে যাবো।’
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান বলেন, ‘আমরা ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে এদেশ পেয়েছি। সেই রক্ত শুধু মুসলমানের নয়, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান সবার রক্তে আমরা এই স্বাধীনতা পেয়েছি। স্বাধীন দেশে ধর্মের নামে বিভাজন, ধর্মীয় উন্মাদনা তৈরির চেষ্টা কাম্য নয়। যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে না, যারা এখনও অখণ্ড পাকিস্তানে বিশ্বাস করে, তারাই সরকারকে বিপদে ফেলতে ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়িয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা করছে। এদের বিরুদ্ধে আমাদের নিরন্তর সংগ্রাম করে যেতে হবে। স্বাধীন বাংলাদেশ আমরা ধর্মান্ধ, মৌলবাদী গোষ্ঠীর হাতে তুলে দিতে পারি না। সামনে নির্বাচন, সেজন্য ধর্মান্ধ জামাতি, রাজাকার-আলবদররা আবার মাথা তোলার চেষ্টা করছে। তাদের প্রতিরোধ করতে হবে।’ বাংলাদেশ কলেজ -বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, ‘সেলিনা শেলী বিশাল সময়ের শিক্ষকতা জীবনে তার বিরুদ্ধে কখনো কেউ কোনো অভিযোগ আনতে পারেনি। ঠুনকো একটি বিষয়, ফেসবুক পোস্ট নিয়ে তার বিরুদ্ধে বন্দর কর্তৃপক্ষ যে ব্যবস্থা নিয়েছে, সেটা অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক। তাকে স্বপদে বহাল করতে হবে। তার যে সম্মানহানি হয়েছে, সেটা যাতে পুনরুদ্ধার হয় সেই ব্যবস্থা নিতে হবে। যারা উসকানি দিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। উসকানিদাতারাও কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বরখেলাপ করেছেন। কারণ তারাও ডিজিটাল মাধ্যমে সেলিনা শেলীকে হেনস্থা করছে।’ কবি ও সাংবাদিক কামরুল হাসান বাদল বলেন, ‘সেলিনা শেলী রামাদান শব্দ উল্লেখ করে কেন ফেসবুকে লিখেছিলেন, এটার একটা পটভূমি আছে। পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রাকে যেভাবে আক্রমণ করা হচ্ছিল হিন্দুয়ানি বলে, এই শব্দ হিন্দুয়ানি শব্দ, এই কথা হিন্দুয়ানি কথা, এই কালচার হিন্দুয়ানি কালচার- তাতে আমাদের সন্তানরা ভাবতে পারেন হিন্দুয়ানি বোধহয় ঘৃণ্য, পরিত্যক্ত কোনো বিষয়। বাংলা ভাষার মধ্যে আবার হিন্দু-মুসলমান কেন ? সেই পটভূমিতে সেলিনা শেলীর বক্তব্যের কারণে তার বাড়ির চারপাশে এখন অসংখ্য হায়েনার আনাগোণা, পেলেই যেন তার কল্লা কেটে নেবে। এই অসহায় নারী আজ কোথায় আছেন, কী দুর্বিষহ অবস্থায় তিনি প্রতিটি মুহুর্ত পার করছেন, সেটা আমরা কেউ জানি না। এমন অনিরাপদ বাংলাদেশ আমরা চাই না। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দিয়ে মানুষের মুক্তচিন্তাকে রুদ্ধ করা হচ্ছে। এই আইন এখন ব্লাসফেমি আইনে পরিণত হয়েছে। আমরা এই আইন অবিলম্বে বাতিল চাই।’