চলমান সংবাদ

শিশুদের মধ্যে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসারে কাজ করছেন সেঁজুতি সাহা

বিজ্ঞানমনস্ক জাতি গঠনের লক্ষ্যে শিশুদের মধ্যে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসার ঘটাতে কাজ করছেন অন্যতম বিশ্বসেরা তরুণ অণুজীব বিজ্ঞানী সেঁজুতি সাহা। বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞান সাময়ীকি ল্যানসেটের জরীপে তিনি ২০২২ সালে বিশ্বের সেরা দশ বিজ্ঞানীর মধ্যে একজন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন।
বাসসকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে সেঁজুতি সাহা বলেন, আমরা চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশন থেকে শিশুদের সঙ্গে অনেক কাজ করি। ২০২২ সাল থেকে ‘গড়বো বিজ্ঞানী, সাজাবো বাংলাদেশ’ নামে একটি কর্মসূচি হাতে নিয়েছি। এই কর্মসূচির মূল লক্ষ্যই হচ্ছে শিশু। এর তিনটা ধারা আছে। একটা ধারা হচ্ছে- বিজ্ঞানকে মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়া। দ্বিতীয় হচ্ছে-মানুষকে বিজ্ঞানের কাছে নিয়ে যাওয়া এবং তৃতীয় হচ্ছে-স্কিল ডেভেলপমেন্ট।
তিনি বলেন, “প্রথম দুটো ধারা একদম স্কুলের বাচ্চাদের জন্য। এই কর্মসূচির আওতায় সাধারণত ঢাকার বাইরে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে বিজ্ঞান ক্যাম্প আয়োজন করা হয়। সেখানে আবার মেয়ে শিশুদের প্রাধান্য বেশি। কারণ, মেয়েদের এক্সপোজারটা সবসময় কম হয়। আমরা সাথে একটা মাইক্রোসকোপ নিয়ে যাই। সাথে কিছু কালচার প্লেট নিয়ে যাই। কলা থেকে ডিএনএ এক্সট্রাক্ট করি। ওরা একটু দই নিয়ে আসে। দই এ একটু ব্যাকটেরিয়া দেখে। ওরা দেখে যে আমাদের আশেপাশে কত ব্যাকটেরিয়া ঘোরাঘুরি করছে, অণুজীবের পৃথিবীটা কত কালারফুল।”
এর মাধ্যমে বাচ্চাদের বোঝানো হয় যে, বিজ্ঞান খুবই সোজা। বিজ্ঞান মানে হচ্ছে প্রশ্ন করা। প্রশ্ন করে করে তথ্য সংগ্রহ করে নিজে নিজে উত্তর খুঁজে বের করা। বিজ্ঞান মানে একেবারেই মুখস্ত করা নয়। বিজ্ঞান কঠিন কিছুও না।
সেঁজুতি বলেন, আমরা গল্পের মাধ্যমে, কাজের মাধ্যমে এক্সপেরিমেন্টের মাধ্যমে বিভিন্ন কিছু শিখি। ক্যাম্পগুলো করার পরে আমরা আবার আলোচনা পর্ব রাখি। যেখানে যে কোনো কেউ যেকোন প্রশ্ন করতে পারে। বিজ্ঞানী হয়ে আমরা উত্তর দেয়ার চেষ্টা করি। অনেক ক্ষেত্রে আমরা বলি, জানি না। এটা বোঝানো যে বিজ্ঞান কঠিন কিছু না। সবাইকে বিজ্ঞানী হতে হবে এমন কিছুও না। সবাইকে হতে হবে বিজ্ঞান মনস্ক।
দ্বিতীয় ধারায়, যারা গবেষণা বা ল্যাবরেটরি দেখতে আগ্রহী হয়, তাদের ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। তারা ঢাকা ল্যাবে কাজ করা দেখে। অণুজীব বিজ্ঞানীরা তাদের দেখায় যে, ইনফেকটিভ ডিজিজ কিভাবে কাজ করে। ওরা তখন দেখে যে হয়তো বা ওদের গ্রাম থেকেই কেউ গবেষণাগারে এসে কাজ করছে। ওদেরই একজন বিজ্ঞানী হয়ে উঠছে। তিনি বলেন, এসব দেখে ওরা অনুপ্রাণিত হবে। কেউ হয়তো বিজ্ঞানী হয়ে উঠবে, বিজ্ঞান মনস্ক হয়ে উঠবে।
তৃতীয় ধারায় আরেকটু বড়রা আসে। আন্ডার গ্রাজুয়েট হতে পারে। গ্রাজুয়েট হতে পারে। এসে তারা বিভিন্ন ধরনের স্কিল শেখে। যেমন: পিসিআর শিখলো কেউ। কেউ সিকোয়েন্সিং শিখলো বা কেউ ক্লিনিক্যাল মাইক্রোবায়োলজি। এরকম কিছু প্রশিক্ষণও তাদের দেয়া হয়।

সেঁজুতি বলেন, শিশুরাই তো আমাদের ভবিষ্যত। আমি তো জানি যে, আমার বাবা মা কিরকমের আমার ওপর ছাপ ফেলেছেন আমার ছোটবেলায়। আমার বাবা মা ল্যাব খুলে দিয়েছিলেন আমার জন্য। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমার বন্ধুদের জন্য। বাবা মা আমাকে সুযোগ করে দিয়েছিলেন বলে আমি আজ এখানে আছি। আমি মনে করি, এটা আমার দায়িত্ব যে আমি এটা পরবর্তী জেনারেশনকে দিয়ে যাই। আরেকটু বড় পরিসরে যদি আমি করতে পারি, তাহলে আমি মনে করবো যে, আমি আমার বাবা মার কাছ থেকে যা পেয়েছি তা আমি সার্থকভাবে আমার পরবর্তী প্রজন্মের কাছে দিয়ে যেতে পারছি। আমি খুব ভালো করে বুঝি যে, আমার অনেক প্রিভিলেজ আছে। এ প্রিভিলেজগুলোকে আমি ব্যবহার করার চেষ্টা করছি। যেন ভবিষ্যতে শিশুরা বিজ্ঞানী হয়, বিজ্ঞান মনস্ক হয় । যেন বিজ্ঞানের জন্য অন্তত: একটা শ্রদ্ধা থাকে।
নিজের দেশকে একটি বিজ্ঞান মনস্ক জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতেই দেশে একটি একটি উন্নতমানের গবেষণাগার তৈরি করার স্বপ্ন দেখছেন সেজুঁতি সাহা। তিনি বলেন, আগামী দশ বছরে আমি একটা রিসার্চ ইন্সটিটিউট তৈরি করতে চাই। আমি জানি না কিভাবে করবো। কে আমাকে হেলপ করবে। কিন্তু আমি একটা রিসার্চ ইন্সটিটিউট করতে চাই।
কেবল বিজ্ঞানমনস্ক জাতি নয়, স্বদেশ বিমুখ কিংবা দেশে সুযোগের অভাবে যেসব উদীয়মান বিজ্ঞানী বিদেশে পাড়ি জমান তাদের দেশে গবেষণা করার সুযোগ তৈরি করাও তার অন্যতম লক্ষ্য। তিনি এমন গবেষণাগার তৈরি করতে চান যেখানে দেশ-বিদেশের সবাই গবেষণা করতে পারবে। যেসব বিজ্ঞানী বিদেশ থেকে ফেরত আসতে চান না, তারা বাংলাদেশে এসে গবেষণা করার একটা জায়গা পাবেন।
একটা রিসার্চ ইন্সটিটিউটের সাথে একটা রিসার্চ হাসপাতালও গড়ে তুলতে চান সেঁজুতি। এমন একটা হাসপাতাল যেখানে শুধু রোগীদের চিকিৎসা সেবাই দেয়া হবে না। সাথে সাথে রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে যে জ্ঞান অর্জন হবে, সেসব রিসার্চেও ব্যবহৃত হবে।
তিনি বলেন, রিসার্চ ইন্সটিটিউট উইদ এ রিসার্চ হসপিটাল। যেখানে আমি চাই যে সেখানে একটা বড় ফোকাস থাকবে নারী এবং শিশু। কারণ, আমি এখনও মনে করি যে, নারীদের জন্য, শিশুদের জন্য আমরা পর্যাপ্ত কাজ করছি না। শিশুদের জন্য বাংলাদেশে খুব কম ভালো হাসপাতাল আছে। আর নারীদের জন্যও খুব কম হাসপাতাল আছে। যেখানে তিনি শিশু ও নারীদের ক্যান্সার নিয়ে কাজ করতে চান। বাংলাদেশের রোগগুলোর ব্যাপারে কাজ করতে চান। বাংলাদেশের মানুষের জন্য এসব গবেষণার ফলাফলগুলো ব্যবহৃত হবে।

# মাহফুজা জেসমিন, ঢাকা, ১ এপ্রিল, ২০২৩