বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (৮৬): একুশের আয়নায় স্বদেশ

-বিজন সাহা  

গত সপ্তাহে আমরা একুশ নিয়ে বেশ কিছু কথা বলেছিলাম। আরও দুই একটা পর্বে এ নিয়ে আলোচনা করব। যদিও জাতীয়তাবাদ বিভিন্ন ভাবেই গড়ে উঠতে পারে – ধর্ম, ভাষা, ভৌগলিক অবস্থান থেকে শুরু করে অনেক কিছুই জাতীয়তাবাদের জন্ম দিতে পারে তবে আমার মনে হয় আমাদের ক্ষেত্রে অন্তত ভাষাটাই ক্যাটালিস্ট ছিল। এটা ঠিক যে ১৯৪৭ সালে এই অঞ্চলের মানুষ ধর্মীয় ভিত্তিক জাতীয়তাবাদ গড়ে তুলতে চেয়েছিল, এমনকি সেক্ষেত্রে অনেকটাই সফল হয়েছিল ভারত ভাগ করে, পাকিস্তান নামে মুসলমানদের জন্য আলাদা দেশ তৈরি করে, কিন্তু সেটা শুরু থেকেই অকেজো হয়ে পড়ে। কারণ যাদের ডাকে সাড়া দিয়ে পূর্ববাংলার মানুষ ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের পক্ষে দাঁড়ায়  তারাই পরে আঞ্চলিকতার আর ভাষার রাজনীতি শুরু করে – এ দেশের মানুষ রাজা হতে চেয়েছিল – তারা আবার প্রজায় পরিণত হয়। শুরু হয় আবার নতুন আন্দোলন যার মূলে ছিল ভাষা কেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদ। বর্তমানে দেশের যে রাজনৈতিক সমস্যা, রাজনীতিতে যে সাম্প্রদায়িকতা সেটা আসলে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের কাছে একদা পরাজিত ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের প্রতিশোধ। আর সেজন্যেই এরা বারবার ভাষার উপর আঘাত করে, ধর্মের দোহাই দিয়ে বাংলা ভাষার প্রথিতযশা কবি লেখকদের মূল ধারার বাইরে রাখতে চায়, বাংলা সংস্কৃতিকে হিন্দু সংস্কৃতি বলে নিষিদ্ধ করতে চায়। তাই একুশকে ভুললে চলবে না, একে শুধু উৎসব হিসেবে পালন করলেই চলবে না। একুশ আমাদের জাতীয় স্বত্তা, আমাদের জাতীয়তাবাদের অঙ্কুর এখানেই, আজ আমাদের যা কিছু আছে তার সব কিছুর উৎস এখানেই। তাই যে স্বপ্ন দিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছিল সেই স্বপ্নকে সত্যিকার অর্থে বাস্তবে রূপ দিতে হলে একুশের চেতনা শুধু ধরে রাখলেই চলবে না, একে বিকশিত করতে হবে। সেদিক থেকে একুশের চেতনা বহুল আলোচিত একাত্তরের চেতনার চেয়ে কোন অংশেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয় আমাদের দেশের জন্য। আর সেই গুরুত্ব শুধু ভাষার দিক থেকেই নয়, রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক সব দিক থেকেই। আজ একুশ একটা ব্র্যান্ড যা সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ডিভিডেন্ড বয়ে আনে। একুশকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে ব্যবসা – ফ্যাশান, গার্মেন্টস, এমনকি সাহিত্য। আজ বাংলা ভাষায় বই মানেই একুশের বই মেলা। তাই এ নিয়ে আরও বেশ কিছু কথা বলব। এসব কথার বেশির ভাগ ২০১৫ সালে লিখেছিলাম। কিন্তু একুশ এমন একটা বিষয় যা কখনই পুরানো হয় না, হবে না আরও অনেক অনেক যুগ।

বছর ঘুরে আবার ফিরে আসে ফেব্রুয়ারি। ফেব্রুয়ারি বাঙালির বাঙালি হবার মাস। ফিরে আসে বই, ফিরে আসে বই  মেলা। লেখকরা ব্যস্ত বই প্রকাশে, পাঠকরা বই মেলায় যায় লেখকদের সাথে দেখা করতে, বই কিনতে, যায় নতুন ফ্যাশনের পোশাক পরে, যায় নানা স্বাদের খাবার খেতে। আজকাল ঈদ, পূজা, নববর্ষের মত বই মেলাও হয়ে উঠেছে বাঙালির জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমাদের ছোটবেলায় ছেলেমেয়েরা যেমন রাশের বা রথের মেলার জন্য অপেক্ষা করত, এখন অনেকেই ঠিক একই ভাবে অপেক্ষা করে বই মেলার জন্য। রথের মেলা নিয়ে স্কুলে আমাদের এক ভাব সম্প্রসারণ ছিল

পথ ভাবে আমি দেব, রথ ভাবে আমি,
মূর্তি ভাবে আমি দেব, হাসে অন্তর্যামী

আমার কেন যেন মনে হয় বই কেনা, বই মেলায় যাওয়া আর জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থা ঠিক একই রকম। আর সেটা কী ব্যক্তি মানুষ হিসেবে, কী জাতি হিসেবে। যতদূর জানি একুশের মূল মন্ত্র ছিল বাংলা ভাষা, বাঙালি সংস্কৃতিকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠা করা, সর্বস্তরে বাংলা চালু করা, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি বিকশিত করা। বাস্তবে চকচকে বই, মেলা আর পোশাক পরিচ্ছদের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে বাংলা চর্চা, পাঠ্য পুস্তক থেকে নির্বাসিত হচ্ছে বাংলার শ্রেষ্ঠ কবি সাহিত্যিকরা।

প্রথমেই বলে নেই কেন একুশের আয়নায় – একাত্তরের নয় কেন? একাত্তরের সংগ্রাম ছিলো রাজনৈতিক স্বাধীনতার সংগ্রাম আর একই সাথে অর্থনৈতিক স্বাধীনতারও বটে। তবে বর্তমান বিশ্বে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ব্যাপারটা খুবই আপেক্ষিক, এমনকি ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতাও। পৃথিবীর সব দেশ আজ বড় বড় কিছু রাঘব বোয়ালের উপর এমন ভাবে নির্ভরশীল যে এদের স্বাধীনতা অনেকটা কাগুজে ব্যাপার। আর একুশ হচ্ছে আমাদের বাংলা ভাষাকে, বাঙালি সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াই। একটা জাতির বেঁচে থাকার জন্য, বিকাশের জন্য ভাষা আর সংস্কৃতির গুরুত্ব তার রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক স্বাধীনতার চেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। তাইতো আমরা বার বার ফিরে আসি একুশের ডাকে, শপথ নেই একুশের নামে। এটা অনেকটা মায়ের কোলে ফেরার মত, মায়ের বুকে মাথা রেখে নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখার মত, নতুন জীবন গড়ে তোলার অঙ্গীকার নেবার মত।

বাংলার মাঠ ঘাট আজ জ্বলে পুড়ে ছারখার। মানুষ মরছে, শ্মশানে পরিণত হচ্ছে সোনার বাংলা। বিগত কযেক বছরের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে, এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এটা আমাদের দেশের ক্রনিকাল ব্যাধি। কেন এমন হয়? সবার মনে একই প্রশ্ন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় কী সরকারী দল, কী বিরোধী দল, কী তথাকথিত সুশীল সমাজ – কেউ আর রাজনীতি করছে না। রাজনীতি করার জন্য রাজার মত মন থাকা দরকার, কালোবাজারী মন নিয়ে রাজনীতি করলে সেটা আর রাজনীতি থাকে না, রাজনীতির ব্ল্যাকমেইল হয়ে যায়। আমরা শুধু মুখেই গণতন্ত্রের কথা বলি, মন থেকে আদৌ কি চেয়েছি আমরা গণতন্ত্র? ইতিহাস ঘাটলে  দেখব, আমরা বারবার গণতন্ত্রকে বাইপাস করে চলে গেছি। রাজনীতিকে ব্যবহার করেছি সম্পদের পাহাড় গড়ার জন্য যার বেশির ভাগই আবার ইংরেজ আর পাকিস্তানীদের মত বিদেশে পাচার করছি। ওরা করত নিজ দেশে, আমরা বিদেশে।

ভারত বিভাগের অনেক কারণ ছিল, তবে যে ধারণাকে সামনে এনে দেশটা ভাগ করা হয়, তা হল দ্বিজাতিতত্ত্ব, যা বাস্তবে সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের সংখ্যাগুরু হিন্দুদের শাষন মেনে নেবার অনিচ্ছা, যদিও কংগ্রেস শাষনকে কোন মতেই হিন্দুদের শাষন বলা যাবে না। অর্থাৎ গণতন্ত্রকে বা সংখ্যাগরিষ্ঠের মতকে না মানার প্রতিশ্রুতি নিয়ে জন্ম নেয় পাকিস্তান। আর বছর না ঘুরতেই পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা বাংলাকে জাতীয় ভাষার মর্যাদা দিতে অস্বীকার (বস্তুতঃ উর্দুকে একমাত্র জাতীয় ভাষার মর্যাদা দেবার অঙ্গীকার) করে গণতন্ত্রের পায়ে আবার কুড়াল মারে পাকিস্তান সরকার। মুসলিম লীগকে পূর্ব বাংলার মাটিতে জনপ্রিয় করার মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলকে পাকিস্তানে পরিণত করার স্থপতি হবার পরেও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আর শেখ মুজিবকে বাইরে রেখে গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লীগ সরকার। এ প্রসঙ্গে শেখ মুজিবের লেখা কয়েক লাইন তুলে ধরা যায়। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি লেখেছেন “মাওলানা আকরাম খাঁ  সাহেবের বিবৃতির পর আমরা আর মুসলিম লীগের সদস্য থাকলাম না। অর্থাৎ আমাদের মুসলিম লীগ থেকে খেদিয়ে দেয়া হল।” এ ঘটনায় উনিই আবার লিখেছেন “দুঃখের বিষয় এই কর্মীরাই পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিল। এখন যারা এদের উপর আক্রমণ করেছিল তাদের প্রায় সকলেই পাকিস্তান আর মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে ছিল।…. প্রায় সমস্ত জায়গায় মুসলিম লীগ কমিটিতে শহীদ সাহেবের সমর্থক বেশী ছিল বলে অনেক লীগ ও পাকিস্তান বিরোধী লোকদের এডহক কমিটিতে নিতে হয়েছিল।” জিন্নাহ ফান্ডের নামে সরকার জোর করে মানুষের কাছ থেকে টাকা ওঠাতে শুরু করে। “চারিদিকে জুলুম শুরু হযেছে। চৌকিদার, দফাদার নেমে পরেছে। কারো গরু, কারো বদনা, থালা, ঘটিবাটি কেড়ে আনা হচ্ছে। এক ত্রাসের রাজত্ব।”.. এক মাঝির সঙ্গে কথপোকথনের উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন “মাঝি বলে “পাকিস্তানের কথা তো আপনার কাছ থেকেই শুনেছিলাম, এই পাকিস্তান আনলেন।” আমি শুধু বললাম “এটা পাকিস্তানের দোষ না।”” শেখ মুজিবের এ লেখা থেকে দুটো জিনিস পরিষ্কার বেরিয়ে আসে – সব আমলেই শেষ পর্যন্ত সুবিধাবাদিরাই ক্ষমতা দখল করে। তবে এত কিছুর পরেও তিনি অনেকদিন পর্যন্ত পাকিস্তানের মোহ ত্যাগ করতে পারেননি। আর পাকিস্তানের বিরোধিতা নয়, পাকিস্তানের আদর্শ আর কাঠামো মধ্যে থেকেই উন্নত এক পাকিস্তান গড়ার স্বপ্ন নিয়ে গঠিত হয় আওয়ামী মুসলিম লীগ। কিন্তু প্রথম থেকেই এর উপর খড়গহস্ত হয় মুসলিম লীগ সরকার।

 

আসলে পূর্ব পাকিস্তানের ইতিহাস পুরোটাই আন্দোলন আর সংগ্রামের ইতিহাস। তবে এই সংগ্রাম ছিলো পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যেই পশ্চিমের সাথে সমান অধিকারের ভিত্তিতে উন্নত পূর্ব পাকিস্তান গোড়ার সংগ্রাম। তবে ১৯৭০ এর নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হবার পরও আওয়ামী লীগকে সরকার গঠন করতে না দিয়ে পাক সরকার আবারও গণতন্ত্রের পিঠে ছুরি মারলে বাংলার মানুষ বাধ্য হয় অস্ত্র হাতে নিজেদের অধিকার রক্ষা করতে।  যেহেতু বাংলার মানুষ শেখ মুজিব তথা আওয়ামী লীগকেই তাদের কান্ডারী হিসেবে ভোট দিয়েছিলো, স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্বও স্বাভাবিক ভাবেই তাদের হাতে যায়, যদিও লড়াই করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলো দলমত নির্বিশেষে বাংলার সাধারণ মানুষ (অবশ্যই রাজাকার, আল বদর আর পাক সেনাদের দেশির দোসরদের বাদ দিয়ে)। আর শেখ মুজিব তখন শুধু আওয়ামী লীগের নেতাই ছিলেন না, ছিলেন সমগ্র জাতির নেতা। তাই আজ যখন জাতীয় নেতা আর স্বাধীনতাকে দলীয় করণ করার চেষ্টা করা হয়, তাতে না বাড়ে দলের সম্মান, না বাড়ে নেতার সম্মান। এতে করে জাতীয় নেতা ও স্বাধীনতা সংগ্রামকে তো বটেই, জাতিকেও হেয় করা হয়। এ  বিষয়ে পরের পর্বে।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা
শিক্ষক, গণ মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়, মস্কো, রাশিয়া