চলমান সংবাদ

আন্তর্জাতিক নারী দিবস এবং প্রাসঙ্গিক ভাবনা

-ফজলুল কবির মিন্টু

ফজলুল কবির মিন্টু

আজ ৮ মার্চ।  বিশ্ব জুড়ে পালিত হচ্ছে -আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসাবে। এটি একটি ঐতিহাসিক দিন –নারী জাগরণের দিন। নারীদের অর্জন উদযাপনের দিন। বিশ্বব্যাপী নারীসমাজ যে চ্যালেঞ্জ বা বাধা সমূহ মোকাবেলা করছে সেগুলো চিহ্নিত করে তা থেকে উত্তরণে উদ্যোগ গ্রহণ ও সেগুলো সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষে এ দিনটি পালন করা হয়।

বাংলাদেশের সর্বশেষ আদম শুমারি অনুসারে পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা বেশি হলেও কর্মক্ষেত্রে তাদের অংশগ্রহণ পুরুষের অর্ধেক। তথাপি দেশের কর্মজগতের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে নারী এবং তারা এদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

বাংলাদেশের অন্যতম শিল্পখাত পোশাক শিল্পে নারীদের ভূমিকা অত্যন্ত প্রশংসার দাবীদার। গার্মেন্টস আমাদের দেশের বৃহৎ ও রপ্তানীমুখি শিল্প। বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয় এই খাত থেকে। পোশাক শিল্পে মোট শ্রমিকের ৮০%ই নারী শ্রমিক। নারীরা শুধু যে গার্মেন্টস শিল্পে অবদান রাখছে তাই নয় তারা গার্মেন্টস সেক্টর ছাড়াও কৃষি খাত, স্বাস্থ্য সেবা খাত এবং শিক্ষা খাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, নারীরা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ননে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও কম মজুরি, অনিরাপদ কর্ম পরিবেশে চাকরি করা থেকে শুরু করে বৈষম্য ও হয়রানি সহ প্রতিনিয়ত নানাবিধ চ্যালেঞ্জের সম্মুখিন হচ্ছে।

অনিরাপদ কর্ম পরিবেশ বলতে কেবল স্বাস্থ্যগত, পরিবেশগত কিংবা অবকাঠামোগত নয় -নারীকে তার ছায়ার সাথেও যেন যুদ্ধ করে কলকারখানায় কাজ করতে হয়। পুরুষ নামক কিছু  অমানুষের লোলুপ দৃষ্টি প্রতিনিয়ত নারীদের যেন তাড়িয়ে বেড়ায়। কাজে যোগ দিতে বাসা হতে বের হয়ে কর্মস্থলে যোগদান করে এবং কাজ শেষে বাসায় ফেরা পর্যন্ত নারীকে একটা অজানা শঙ্কায় থাকতে হয়।

আসা-যাওয়ার পথে ইভ টিজিং, বখাটেদের  উৎপাত আবার কর্মস্থলে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এবং পুরুষ সহকর্মীদের নিপীড়ন -কর্মজীবী নারীর জীবন বিষাক্ত করে তুলে। এছাড়া চাকরিতে নিয়োগ, পদোন্নতি, মজুরি নির্ধারন ইত্যাদি ক্ষেত্রেও নারীরা প্রতিনিয়ত বৈষম্যের শিকারতো হচ্ছেই।

এই অবস্থার উন্নয়নে রাষ্ট্র, মালিক পক্ষ, ট্রেড ইউনিয়ন এক্টিভিস্ট এবং সর্বোপরি মিডিয়ার ভূমিকা অপরিহার্য।

নারীর অবস্থা উন্নয়নে রাষ্ট্র নানামাত্রিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। প্রথমত রাষ্ট্রের উচিৎ নারী শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় বিদ্যমান শ্রম আইন বাস্তবায়ন করে ন্যায্য মজুরি, অতিরিক্ত কাজের ভাতা, কর্মঘন্টা, ছুটি, পেশাগত স্বাস্থ্য নিরাপত্তা, নারী শ্রমিকদের সম্ভ্রম সুরক্ষা ইত্যাদি  কঠোরভাবে মেনে চলার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। রাষ্ট্র প্রয়োজনে নারী শ্রমিকদের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিতে পারে।

নিয়োগকর্তা বা মালিকপক্ষ নারী শ্রমিকদের অবস্থা উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। সর্ব প্রথমে মালিক পক্ষের উচিৎ নারী শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি ও নিরাপদ কর্ম পরিবেশ নিশ্চিত করা। নিয়োগকর্তা নারীর প্রতি বৈষম্য ও হয়রানি মোকাবেলার জন্য নীতিমালা ও কর্মসূচী গ্রহণ করতে পারে এবং সর্বোপরি সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় বেশি সংখ্যক নারী শ্রমিকের অংশ গ্রহণ নিশ্চিত করতে পারে।

ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন সমূহ এডভোকেসির মাধ্যমে নারী শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষায় কাজ করতে পারে। তারা নানাবিধ বৈষম্য ও হয়রানির শিকার নারীদের সহযোগিতা দিয়ে এবং সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কর্মস্থলের পরিবেশ উন্নয়ন, শ্রমিকের জীবনমান উন্নয়ন ও ন্যায্য মজুরি নিশ্চিতকল্পে ট্রেড ইউনিয়ন প্রয়োজনে রাষ্ট্র ও মালিক পক্ষের সাথে লবি, এডভোকেসি ও আলোচনার উদ্যোগ নিতে পারে। দরকষাকষি প্রতিনিধি তথা সিবিএ ইউনিয়ন শ্রম বিরোধ উত্থাপন করেও সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিতে পারে।

নারী অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন সংগঠন সমূহ, বিভিন্ন এনজিও এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরাও বাংলাদেশের নারী শ্রমিকদের অবস্থার উন্নয়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তারা মূলত ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন সমূহের কর্মসূচী ও দাবি সমূহের পক্ষে প্রচার প্রপাগান্ডা, সভা সমাবেশ করে সংশ্লিষ্ট পক্ষ সমূহের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে। শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে অধিকার প্রতিষ্ঠায় ও সুরক্ষায় এবং আইন প্রনয়নে ভূমিকা রাখতে পারে।

আন্তর্জাতিক নারী দিবস বাংলাদেশের নারী শ্রমিকদের অর্জন উদযাপনের এবং প্রতিনিয়ত তারা যে বাধার সম্মুখিন হচ্ছেন তা থেকে উত্তরনে সচেতনতা সৃষ্টির এক অন্যন্য সুযোগ।  বাংলাদেশের নারী শ্রমিকেরা বাংলাদেশের অর্থনীতি উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখলেও কম মজুরি, অনিরাপদ কর্ম পরিবেশ, বৈষম্য ও হয়রানি সহ পদে পদে তাদের নানামুখি সংকট অতিক্রম করতে হয়। আমরা সম্মিলিতভাবে কাজ করে নারীর ক্ষমতায়ন ও সম্মান নিশ্চিত করতে পারি।

(লেখকঃ শ্রমিক আন্দোলনের সংগঠক)