বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (৮৩): শিক্ষার শিখা জ্বলে উঠুক

-বিজন সাহা

 

 

আজকাল স্লোগানের কোন শেষ নেই। সাম্য, মৈত্রী, মানবাধিকার – কত গালভরা নাম। কেউ বলে রাম রাজত্বের কথা, কেউ মদিনা সনদ, কেউ বা গণতন্ত্র আর সাম্যের কথা। রাম রাজ্য, মদিনা সনদ এসব বলতে তারা বোঝায় ধর্ম বা ন্যায়ের শাসনের কথা। অন্তত ঐতিহাসিক ভাবে এসব শব্দের এরকম মানেই দাঁড়ায়। একই কথা বলা যায় তাদের সম্পর্কে যারা গণতন্ত্রের কথা বলে, বিএলএম, এলজিবিটি এদের অধিকারের কথা বলে। কিন্তু এসব বৈষম্যের মূলে যে শোষণ তার কথা এরা বলে না, বলে না কৃষক, শ্রমিক, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কথা, বলে না সমস্ত শোষিত মানুষের মুক্তির কথা। এর একটাই মানে হতে পারে – তারা সমস্যার সমাধান চায় না। এসব শুধুই রাজনৈতিক স্লোগান। সাদ্দাম বা গাদ্দাফির হাত থেকে সে দেশের জনগণকে বাঁচাতে তারা প্রথমে এই জনগণকেই হত্যা করে। ইউক্রেনে যত অস্ত্র যায় সেটা কোন প্রাণ রক্ষা করে না, হত্যা করে অসংখ্য। কারও পক্ষে বা বিপক্ষে বলার আগে আমরা যদি নিজেদের মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে দাড়াই সেটাই বরং অনেক প্রাণ বাঁচাবে। কিন্তু আমরা সেটা করব কি? না। কারণ আমাদের স্বার্থ অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত এই সব মিথ্যাবাদীদের লাভ লোকসানের সাথে।

টেকনোলজির এই যুগে মানুষ অনবরত হেরে যাচ্ছে। বিজ্ঞানের সাথে পাল্লা দিয়ে সে নিজেকে বদলাতে পারছে না।  জ্ঞানের সাথে সাথে বুদ্ধি বাড়ছে না। প্রযুক্তি যত সার্বজনীন হচ্ছে মানুষ তত অসামাজিক আর আত্মকেন্দ্রিক হচ্ছে। আমরা প্রতিদিন নতুন নতুন জেনারেশনের ডিভাইস তৈরি করছি কিন্তু মানুষকে বদলাতে পারছি না, নতুন মানুষ তৈরি করতে পারছি না। অর্ধ শতাব্দীর বেশি আগে ঔপনিবেশিক শক্তি পাত্তারি গুঁটিয়ে ঘরে ফিরতে বাধ্য হলেও তাদের স্বভাব বদলায়নি। তাই তো তারা এখনও বিভিন্ন প্রশ্নে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর উপরে চাপ সৃষ্টি করেই যায় তা সে পদ্মা সেতু প্রশ্নেই হোক, একাত্তরের ঘাতক দালালদের বিচারের প্রশ্নেই হোক আর রাশিয়ার উপর স্যাঙ্কশনের প্রশ্নেই হোক। কিন্তু তারা নিজেদের স্বার্থের কথা ভুলে না। তাই ফ্রান্সে আন্তর্জাতিক থার্মোনিউক্লিয়ার পরীক্ষামূলক রিয়্যাক্টরের জন্য রাশিয়া থেকে ২০০ টন ভারী ম্যাগনেট সরবরাহে বাধা সৃষ্টি না হলেও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য দরকারি জিনিসপত্র রাশিয়া থেকে আমরা পাইনা পশ্চিমা স্যাঙ্কশনের কারণে। কথায় বলে কয়লা ধুলেও ময়লা যায় না। শোষক কখনই শোষণ করতে ভুলে না।

ছোটবেলায় বন্ধুদের অনেককেই বলতে শুনেছি যে ইসলাম শুধু ধর্ম নয়, পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। পরে সোভিয়েত ইউনিয়নে দেখেছি পার্টি কীভাবে তার সদস্যদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করে। মনে হয়েছে ইসলাম নয় মার্ক্সবাদ লেনিনবাদ পৃথিবীর সর্বশেষ ধর্ম। আজকাল অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামরিক ও প্রযুক্তির শক্তি ব্যবহার করে নিও লিবারেল মতবাদ যেভাবে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে চাইছে তাতে মনে হয় এরাই নতুন ধর্ম। আমরা যারা বাইরে থাকি, যারা অর্থনৈতিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে গগণচুম্বী স্বাধীনতার সাথে সাথে কৌশলে চাপিয়ে দেয়া পরাধীনতার অদৃশ্য শৃঙ্খল অনুভব করি তারা এ নিয়ে লেখালেখি করে মানুষকে সমাজের আসল চরিত্র জানতে সাহায্য করতে পারি। আমার ধারণা, অবশ্য সেটা ভুল হতে পারে, আমরা যারা বিদেশে বসেও বাংলা সাহিত্য, বাংলার সংস্কৃতি চর্চা করি তারা শুধু নিজেদের মনের আনন্দেই এসব করি না, দেশের প্রতি ভালবাসা থেকেই এসব করি। সব কিছুর মধ্যে যেমন ভাল আছে তেমনি খারাপও আছে। এই ভাল আর মন্দের অনুপাতই নির্ধারণ করে কোন দেশ, কোন সমাজ কি রকম। তবে আমার জন্য যেটা ভাল অন্যের জন্য সেটা নাও হতে পারে। ভালমন্দ ব্যাপারটা খুবই সাবজেক্টিভ। মনে পড়ে দেশে থাকতে সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে আমরা নানা রকম খবর পেতাম। একদলের কাছে এটা ছিল স্বর্গের মত, অন্যদের কাছে নরকের মত। স্টিং এর একটা গানের একটা লাইন ছিল এমন  “I hope Russins love their children too” (Sting). সোভিয়েত ইউনিয়নে শিশুদের এত আদর করা হত, সব দিক থেকে ওরা এত প্রিভিলাইজড ছিল যে বলার মত নয়। তারপরেও এই গান। এটাই প্রমাণ করে বহির্বিশ্ব এ দেশ সম্পর্কে কত কম জানত। এমনকি ওরা এদের মানুষ বলে মনে করত কিনা সন্দেহ। এখনও সে ধারণায় পরিবর্তন এসেছে কিনা বলা কষ্ট। যেহেতু এদেশে পড়াশুনা করতে আসত তারাই যারা পজিটিভ ন্যারেশনে বিশ্বাস করত, এখানে এসে অনেকেরই স্বপ্ন ভঙ্গ হত। জানি মানুষ তার সাফল্যের কথা বলতেই ভালবাসে। তবে আমাদের লেখায় যদি বিদেশের একটা অবজেক্টিভ ছবি ফুটে উঠত হয়তো তাতে অনেকেই লাভবান হত।

আমাদের অনেকেই বিভিন্ন দেশে ভাল ভাল অবস্থানে আছেন, অনেকে এমনকি রাজনীতিতেও সাফল্য লাভ করেছেন। কিন্তু কেন যেন মনে হয় এসব দেশের পলিসি মেকিং-এর আমাদের হাত বলতে গেলে নেইই। আমরা প্রতিষ্ঠিত আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কাজ করার সুযোগ পেয়ে এসব সিস্টেমের গণতান্ত্রিক চেহারা দিচ্ছি মাত্র। অন্য দিকে এই আমরাই দেশের জন্য ভাবছি, দেশের পশ্চাৎপদতার জন্য দেশের রাজনৈতিক দলগুলকে দোষারোপ করছি। এটাও এক ধরণের ভেল্কিবাজি। আমরা আত্মসমালোচনা করি নিজেদের বদলানোর জন্য নয়, আত্মতুষ্টির জন্য। দেশের কথা যদি সত্যিই ভাবি আমাদের অবশ্যই আরও সক্রিয় হতে হবে। যদি আমাদের কাজকর্ম, লেখালেখি কিছুটা হলে মগজ পাচার বন্ধ করতে পারে সেটাই হবে জন্মভূমির প্রতি আমাদের আংশিক ঋণ শোধ।

দেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী দেখে অনেকেই ভাবছেন বর্তমানে এ ধরণের আবেদন অসম্ভব। যেখানে একের পর এক শিক্ষকদের উপর আক্রমণ হচ্ছে, জুতার মালা গলায় দিয়ে ঘুরানো হচ্ছে, এমনকি হত্যা পর্যন্ত করা হচ্ছে তখন মানুষ শুধু শিক্ষকতা পেশার প্রতিই অনাগ্রহী হবে না, যাদের কিছুটা সুযোগ আছে তারাই নিরাপত্তার জন্য হলেও দেশ ত্যাগ করবে। যদিও আজ আক্রমণের শিকার হচ্ছে মূলত হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন, কিন্তু দিনের শেষে এটা শিক্ষকদের উপরই হামলা। কেন? ইচ্ছেয় হোক আর অনিচ্ছায় হোক শিক্ষককে প্রশ্ন করতে শেখাতে হয়। প্রশ্ন করা মানে সন্দেহ প্রকাশ করা। সব সময় না হলেও অনেক ক্ষেত্রে তো বটেই। আজ হোক কাল হোক, হিন্দু শিক্ষকদের পরে অন্যান্য শিক্ষকদের পালা আসবে। তাই প্রতিবাদ করতে হবে এখন থেকেই আর সবাই মিলেই। কারণ শিক্ষকদের হাতের আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ। দেশের ভবিষ্যৎ। বাইরে যাওয়া মানে পালিয়ে যাওয়া, যারা বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির শত্রু তাদের ওয়াক ওভার দেওয়া। আজ যে দেশে শিক্ষকের বা যোগ্য শিক্ষকের অভাব সেটা কি এই মগজ পাচারের কারণে নয়। ওরা চেষ্টা করবে দেশকে নিজেদের তালুক বানাতে। সেই চেষ্টায় বড় বাধা প্রতিবাদী কণ্ঠ, যুক্তিবাদী মানুষ। তারাই যদি একে একে দেশ ছাড়ে তাহলে বাংলাদেশ কি আর আদৌ বাংলাদেশ থাকবে। তাই আজকেই আরও বেশি করে প্রয়োজন এই মগজ পাচার রোধ করা, যেসব প্রতিবাদী কণ্ঠ এখনও সব বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে দেশে রয়ে গেছে তাদের পাশে দাঁড়ানো। বহির্বিশ্বের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা এভাবে হলেও দেশের প্রতি, বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারে।

আমার ধারণা আমরা নিজেরাই নিজেদের অনেক ক্ষেত্রেই ধোঁকা দিচ্ছি। আমার বিশ্বাস আমরা যারা দেশের বাইরে থাকি ও সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা করি তারা কমবেশি যাকে বলি প্রগতিশীল মনোভাবাপন্ন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যারা বিদেশ বিভূঁইয়ে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির চর্চা করে তারা প্রগতিশীল না হলেও স্বাধীনতার পক্ষের লোক। কেননা বাহান্নর হাত ধরেই এসেছিল একাত্তর আর বাহান্ন ছিল বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে প্রতিষ্ঠা করার লড়াই। তাই বলা যায় যারা বাংলা ভাষার চর্চা করে তারা বাই ডিফল্ট মৌলবাদ বিরোধী, বাংলাদেশকে ইসলামিক প্রজাতন্ত্রে পরিণত করার বিরোধী। যদি সেটা না হয়, তাহলে তাদের এই চর্চা বৃথা। এদের অধিকাংশই কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় মহাশ্মশানের পরিবর্তে গোরস্থান লেখাকে অমার্জনীয় অপরাধ বলে মনে করে। আবার এরাই শেক্সপিয়ার, চেখভ ও অন্যান্য লেখকদের নাটকে প্রচলিত নায়ক নায়িকাদের বদলে আধুনিক ফ্যাশান অনুযায়ী কোন আফ্রিকান, ট্র্যান্সজেন্ডার বা অন্য কাউকে বসানো মনেপ্রাণে সমর্থন করে। না, আমি এদের বিরুদ্ধে নই, কিন্তু যদি এদের কোন নাটকে ও সিনেমায় স্থান দিতেই হয় তাহলে নতুন করে এসব লিখলেই তো হয়। পূর্ব  পাকিস্তানের কবিদের রবীন্দ্র সঙ্গীত লেখার দরকার ছিল না, তারা উঁচু মানের কবিতা বা গান লিখলেই পারতেন। একই কথা এদের ক্ষেত্রে। আগেই বলেছি মানুষ প্রকৃতির অংশ। প্রকৃতির মত তাই এরাও পাওলির এক্সক্লুশন প্রিন্সিপল মেনে চলে। প্রাকৃতিক ভাবেই দুজন আইডেন্টিক্যাল মানুষ হতে পারে না। আমাদের নিজেদের সুবিধার জন্যই আমরা কোন না কোন ভাবে একজন থেকে আরেকজনকে আলাদা করি। তাহলে বাবা মা কী দোষ করল? প্যারেন্ট ১ আর প্যারেন্ট ২ কি বাবা মার মতই না? আসলে এসবই মানুষকে বোকা বানানোর একেকটা পদ্ধতি মাত্র। একই কথা বলা চলে সমলিঙ্গের বিয়ের ব্যাপারে। এখানে মূল প্রশ্ন তো উত্তরাধিকার নিয়ে। সেটা কি অন্যভাবে করা যায় না? আসলে এটা যতটা না কারও অধিকার আদায় করা তারচেয়ে বেশি অন্যদের অধিকার খর্ব করা, সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা। আমি বলছি না এটা ভালো বা মন্দ, তবে আমার ধারণা এ নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিৎ এ কারণেই যে আজ হোক কাল হোক পশ্চিমা বিশ্ব তাদের এই নতুন সংস্কৃতি আমাদের উপর চাপিয়ে দিতে চাইবে। অবস্থা দৃষ্টে মনে হয় এসব ধারণা আজ চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সমাজে টেনশন সৃষ্টি করার জন্য। আসলে আমাদের যেমন ধর্ম পালনের স্বাধীনতা থাকা উচিৎ তেমনি উচিৎ সেটা না পালনের। কোনটাই কারো উপর চাপিয়ে দেয়া উচিৎ নয়। আর রাষ্ট্র থাকবে ধর্ম থেকে আলাদা। কিন্তু সেটা থাকছে কি? আংলিকান চার্চকে বাধ্য করা হয়েছে বাইবেল উপেক্ষা করে সমলিঙ্গের বিয়েকে স্বীকৃতি দিতে। এই যে চাপিয়ে দেবার প্রবণতা সেটাই কি স্বৈরাচার নয়? এবং এসবই করা হচ্ছে ক্ষমতা দেখানোর জন্য। এটাও কি ডিভাইড অ্যান্ড রুলের অংশ নয়? ক্ষমতা মানুষকে নষ্ট করে আর চরম ক্ষমতা মানুষকে নষ্ট করে চরম ভাবে। এটা মনে হয় রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও সত্য। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আমেরিকা হয়েছে চরম ক্ষমতার একচ্ছত্র অধীশ্বর। আর এটাই তার কাল হয়েছে। আজ সারা বিশ্বে যে সাংস্কৃতিক বিপর্যয়, উগ্রবাদের উত্থান তা সে ইসলামিক স্টেট, বিএলএম, এলজিবিটি বা যে নামেই হোক না কেন সেটা এই অসীম ক্ষমতার অপব্যবহারের হাত ধরেই। আমরা সেই ক্ষমতার হাত যত শক্তিশালী করব, সমাজের, বিশ্বের সর্বনাশ তত দ্রুত ডেকে আনব। তাই আমরা যারা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে বিদেশে চলে যাই তাদের নতুন করে ভাবার সময় এসেছে ছেলেমেয়েদের জন্য এই ভবিষ্যৎ আমরা চাই কি না?

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো