চলমান সংবাদ

বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরতে ভীত নির্যাতনের শিকার ছাত্রী

কুষ্টিয়া ইসলামি বিশ্বিবিদ্যালয়ে ছাত্রী নির্যাতন ও বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণের ঘটনায় স্তম্ভিত হয়ে পড়েছেন সবাই৷ বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতও বিষয়টি আমলে নিয়ে নির্যাতনের শিকার ছাত্রীর অভিযোগ শুনবেন বলে জানিয়েছেন৷

কিন্তু  নির্যাতনকারী ছাত্রলীগ নেত্রীদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা না নিয়ে দুইটি কমিটি গঠন করেছে মাত্র৷ আর ছাত্রলীগও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি৷

নির্যাতের শিকার ওই শিক্ষার্থী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ”আমি এখন অসুস্থ হয়ে পড়েছি৷ পাবনা গ্রামের বাড়িতে আছি৷ আমাকে এখন হুমকি দেয়া হচ্ছে৷ আামি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরতে বা সেখানে পড়াশুনা চলিয়ে যেতে পারব কী না জানি না৷ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কেউ আমার সঙ্গে এখনও যোগাযোগ করেননি৷”

নির্যাতনের শিকার ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন৷ তবে তিনি চাপ ও আতঙ্কের মধ্যে আছেন৷ অন্যদিকে যাদের বিরুদ্ধে নির্যাতনে নেতৃত্ব দেয়ার অভিযোগ রয়েছে  তারা ক্যাম্পাসে অবস্থান করছেন৷ তারা উল্টো বুধবার নির্যাতনের শিকার ছাত্রীর বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেছেন৷

সাড়ে চার ঘন্টা ধরে শেখ হাসিনা হলে ওই ছাত্রীকে আটকে নির্যাতন ও ভিডিও ধারণ করা করা হয় ১২ ফেব্রুয়ারি রাতে৷ প্রথম বর্ষের ছাত্রী হওয়ায় তার হলে সিট ছিল না৷ তিনি আরেকজনের সঙ্গে অতিথি (দ্বৈত আবাসিক) হিসেবে থাকতেন৷ ছাত্রলীগ নেত্রীদের না জানিয়ে হলে ওঠার অভিযোগে তাকে নির্যাতন করা হয়৷ নির্যাতন ও বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণের ঘটনা প্রকাশ করলে তাকে হত্যারও হুমকি দেয়া হয়৷ মঙ্গলবার বিকেলে তিনি হলের প্রভোস্ট এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন৷

ওই ছাত্রী বলেন, ‘‘৷ এই কারণে আমাকে ৩০৬ নাম্বার রুম থেকে গণরুমে নিয়ে রাত ১১টা থেকে সাড়ে ৩টা পর্যন্ত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়৷ নির্যাতনের পর আমাকে গণরুমেই শুইয়ে রাখা হয়৷ পর দিন আমি ক্লাসে যাওয়ার কথা বলে পালিয়ে আসি৷”

তিনি জানান, ‘‘আমাকে চড়, লাথি, ঘুষি কিছুই দিতে বাদ রাখা হয়নি৷ এক পর্যায়ে আমার কাপড়চোপড় খুলে বিবস্ত্র করে ভিডিও করা হয়৷ আর কয়েকজনের বিরুদ্ধে কিছু অশ্লীল কথা হাসিমুখে পড়তে বাধ্য করে তা রেকর্ড করে রাখা হয়৷”

তিনি অভিযোগ করেন, ‘‘তাদের নির্যাতনে আমরা মুখমণ্ডলসহ শারীরে বিভিন্ন স্থানে কালো দাগ হয়ে যাওয়ায় আমাকে সব সময় মুখ ঢেকে, মাস্ক, বোরকা ও হিজাব পড়ে থাকার নির্দেশ দেয়া হয়৷ আর আমি এই ঘটনা প্রকাশ করলে আমাকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়৷”

‘‘ওই রাতে গণরুমে আমাকে মারার সময় সেখানে অনেক ছাত্রী ছিলো; কিন্তু ভয়ে কেউ কিছু বলার সাহস পায়নি৷ আমাদের হলের কোনো শিক্ষকও আমাকে উদ্ধারে এগিয়ে আসেননি৷ নির্যাতনের সময় আমার মুখ ঘামছা দিয়ে বেধে রাখা হয়,” জানান নির্যাতনের শিকার এই ছাত্রী৷

তদন্তে আছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ

ইসাামি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শেখ আব্দুস সালাম বলেন, ‘‘আমি দুই পক্ষের কাছ থেকেই অভিযোগ পেয়েছি৷ আজ (বুধবার) বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছি৷ হলের পক্ষ থেকেও আরেকটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে৷ উভয় কমিটি সাত দিনের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট দেবে৷ রিপোর্ট দেখে ব্যবস্থা নেয়া হবে৷ এর আগে কোনো ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব নয়৷ কারণ আমাকে একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়৷”

তিনি জানান, ‘‘নির্যাতনের শিকার ওই ছাত্রী এখন ক্যাম্পাসে নেই৷ তার সাথে আমরা কথা বলব৷ তবে তার বিরুদ্ধে কয়েক জন ছাত্রী মিলে একসাথে এসে অভিযোগ দিয়ে গেছে৷ সব অভিযোগেরই তদন্ত হচ্ছে৷”

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক সাহাদাত হোসেন আজাদ জানান, ‘‘ঘটনার পরই ওই ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যান৷ মঙ্গলবার লিখিত অভিযোগ করতে এসেছিলেন৷ অভিযোগ করার পর আবার চলে গেছেন৷ আমরা তাকে ক্যাম্পাসে আসতে বলেছি৷ তার নিরাপত্তার কোনো সমস্যা হবে না৷ তবে তদন্ত শেষ হওয়া আগে আমরা কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছি না৷”

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এবং হলে বুধবারও নির্যাতনকারী ছাত্রলীগ নেত্রীরা মহড়া দিয়েছেন৷ তারা ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার অপতৎপরতা চালাচ্ছে৷ সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের ভয়ে কথা বলতে পারছেন না বলে জানান কয়েকজন শিক্ষার্থী৷

বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ইমানুল সোহান বলেন, ‘‘নির্যাতনকারীরা ছাত্রলীগ নেত্রী বলেই হয়তো এখনো আমরা কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখছি না৷ তবে সংবাদ মাধ্যমে খবর প্রকাশ ও বিষয়টি হাইকোর্টের নজরে আসায় তারা আজকে(বুধবার) আজকে কিছুটা নীরব৷ তারা ওই শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ দিয়ে চাপ সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে৷”

তার কথা, ‘‘সাধারণ শিক্ষার্থীরা এখনো প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করার সাহস করছে না৷ তারা ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদ জানাচ্ছে৷ আর বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন বিবৃতি দিয়েছে৷ ছাত্রলীগ চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করেছে৷”

এদিকে ওই ছাত্রীকে নির্যাতনের ঘটনা হাকোর্টের নজরে এসেছে৷ বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের বেঞ্চ বৃহস্পতিবার অভিযোগ শুনবেন বলে জানিয়েছেন৷

এর আগে গত বছরের সেপ্টেম্বরে ঢাকার ইডেন কলেজে সিট বাণিজ্য নিয়ে ছাত্রলীগেরই এক নেত্রীকে মারধর করে ছাত্রলীগের আরেক গ্রুপ৷ এই নিয়ে দুই গ্রুপের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়৷ তখন সিট বাণিজ্য ছাড়াও ছাত্রীদের অনৈতিক কাজে বাধ্য করার অভিযোগ ওঠে৷ তখন ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের ১৬ জনকে সাময়িক বহিষ্কার ও কমিটি সাময়িক স্থগিত করা হয়৷ পরে আবার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার ও কমিটি বহাল করা হয়৷

সম্প্রতি আরো কিছু অঘটন ঘটিয়েছে ছাত্রলীগ৷ পুরানো ঢাকার সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের এক ছাত্রী কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আশিকুল ইসলাম আশিকের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় তাকে শ্লীলতাহানি ও ধর্ষণের হুমকি দেয়া হয়৷

চলতি মাসেই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির চার শিক্ষার্থী৷ তাদের মধ্যে দুইজনকে আইসিইউকে রাখতে হয়৷ আইসিইউতে গিয়ে ছাত্রলীগ নেতারা তাদের কবরে পাঠিয়ে দেয়ার হুমকি দেয়৷ এদিকে একই সময়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের খবর পবিবেশন করায় এক নারী সাংবাদিককে হেনস্তা করে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা৷

তবে এসব নিয়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কোনো নেতার বক্তব্য পাওয়া যায়নি৷