চলমান সংবাদ

তুরস্ক-সিরিয়ায় কঠিন জীবন সংগ্রামে মানুষ, পাশে গোটা বিশ্ব

তুরস্ক-সিরিয়ায় কঠিন জীবন সংগ্রামে মানুষ, পাশে গোটা বিশ্ব

তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চল এবং সিরিয়ায় উত্তরাঞ্চলের বিস্তৃর্ণ এলাকায় সোমবারের বিধ্বংসী ভূমিকম্পে এখনো পর্যন্ত ২২ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হবার খবর নিশ্চিত হয়েছে। মৃতের সংখ্যা আরও বাড়ার আশঙ্কা আছে। কারণে ধ্বসে পড়া ভবনগুলোর ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজ শেষ হয়নি। ফলে আটকে পড়াদের জীবিদ উদ্ধারের সময়সমীমা দ্রুত শেষ হয়ে আসছে।

ভূমিকম্পের চার দিন পেরিয়ে যাওয়ায় তুরস্ক ও সিরিয়ার ধসে যাওয়া ভবনগুলো থেকে জীবিত মানুষদের উদ্ধারের সম্ভাবনা কমে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূমিকম্পের পর উদ্ধারকাজের জন্য ৭২ ঘণ্টা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ভূমিকম্পের পর যাঁদের জীবিত উদ্ধার করা হয়, তাঁদের মধ্যে ৯০ শতাংশ উদ্ধার হন তিন দিনের মধ্যে।

লাশের সংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে স্বজনহারা মানুষের বুকফাঁটা কান্না; বাড়ছে ঘরবাড়ি হারানো লোকজনের দুর্ভোগও। গৃহহীন মানুষ মাথাগোঁজার ঠাঁই পেতে ছুটে বেড়াচ্ছেন। খাবার পেতেও বেশ বেগ পেতে হচ্ছে।শীতের তীব্রতা বেশি হওয়ায় গৃহহীনদের কষ্ট আরও বেড়েছে।

অন্যদিকে ভুমিকম্প থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষগুলো এখন এক সংগ্রামের মুখোমুখি। বিধ্বস্ত সব শহরে বহু মানুষ এখনও আশ্রয়হীন। তাদের কাছে নিরাপদ খাবার পানি নেই, বিদ্যুৎ নেই। এই পরিস্থিতিতে ভূমিকম্পের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া আরো অনেক মানুষের মৃত্যু হতে পারে।

তুরস্ক ও সিরিয়ার মানুষের অভিযোগ, উদ্ধারকাজ ও ত্রাণ বণ্টন ঠিকভাবে হচ্ছে না। আসলে ভূমিকম্পের অভিঘাতে সড়কপথই বিপর্যস্ত। তার উপর চলছে শৈত্যপ্রবাহ। এই পরিস্থিতিতে কাজ করতে বেগ পেতে হচ্ছে উদ্ধারকারী কর্মীদের। স্থানীয়রা অভিযোগ করছেন, ভূমিকম্পে বাঁচলেও শীত আর খিদে জ্বালায় মরতে হবে তাঁদের।

তুরস্ক ও সিরিয়াজুড়ে আড়াই কোটিরও বেশি মানুষ এই ভূমিকম্পের শিকার হয়েছেন। দু’দেশেই হাজার হাজার ভবন ধসে পড়েছে এবং ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়া মানুষদের বাঁচাতে উদ্ধার কর্মীরা প্রাণপণ প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। তারা রীতিমতো সময়ের সঙ্গে যুদ্ধ করছেন।

অনেকেই এখন খাদ্য ও আশ্রয়ের জন্য ছুটছেন। যাঁদের স্বজন এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে আছেন, তাঁদের অসহায়ত্ব আরও বেশি। কেউ কেউ বলছেন, ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে স্বজনদের উদ্ধারের আকুতি তাঁরা শুনেছেন। তবে তাঁরা কিছু করতে পারেননি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, দুই দেশ মিলিয়ে, তাদের হিসেবে অনুযায়ী, দুই কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ ভূকম্পের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে প্রায় ১০ লক্ষেরও বেশি শিশু রয়েছে। হাজার হাজার মানুষ এই ভূমিকম্পে আহত হয়েছেন। যাদের অনেকেই চিকিৎসা দেয়া যাচ্ছে না রসদের অভাবে।

আর, তুরস্কের সরকারি হিসাব অনুযায়ী দেশটিতে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, এমন মানুষের সংখ্যা এক কোটি ৩০ লাখের বেশি। আর, সিরিয়ায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয় জানিয়েছেন, দেশটিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এক কোটির বেশি মানুষ।

যথেষ্ট ত্রাণ না পৌঁছানোয় খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছে দুর্গত এলাকায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আশঙ্কা, ভূমিকম্পে যাঁরা বেঁচে গেছেন, তাঁদেরও অনেকে মারা যেতে পারেন আশ্রয়, শীতের কাপড়, খাবার, পানি ও জ্বালানির অভাবে। এসব সহায়তা একন সবচেয়ে বেশি জরুরি।

ভূমিকম্প আঘাত হানার পর চার দিন পার হয়েছে এবং সাহায্যের অভাবে উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ার পরিস্থিতি মরিয়া হয়ে উঠেছে। ভূমিকম্পের পর হাসপাতারগুলোতে যে চিকিৎসা সামগ্রী রয়েছে তা দেশের উত্তরাঞ্চলের ২০ শতাংশ মানুষের চাহিদাও পূরণ হবে না।

শুক্রবার, জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি জানিয়েছে, উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ায়, যেখানে ৯০ ভাগ মানুষ সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল, সেখানে খাদ্যের মজুদ দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। ফলে শুধুমাত্র খাদ্যের অভাবেই উপদ্রুত এলাকায় ভয়ংকর বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।

অন্যদিকে উত্তর তুরস্কে উদ্ধারকাজে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তীব্র ঠান্ডা, বৃষ্টি, যোগাযোগে বিপর্যয়সহ নানা সমস্যা। আশ্রয়, খাবার, পানি, জ্বালানি ও বিদ্যুতের অভাবে চরম দুর্দশায় রয়েছেন উপদ্রুত এলাকাগুলোর বেঁচে থাকা মানুষেরা।

দেশ দুটিতে যেমন পর্যাপ্ত উদ্ধারকর্মী নেই, তেমনি যন্ত্রপাতির সংকট রয়েছে। সেই সঙ্গে আছে বৈরী আবহাওয়া। তবে এরইমধ্যে অনেক দেশ থেকে তুরস্কে আসছে ত্রাণ ও উদ্ধারকারী দল। দেশটির মৌলিক অবকাঠামো পুনর্নিমাণ ও ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় তুরস্ককে তাৎক্ষণিক একশ’ ৭৮ কোটি ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিশ্বব্যাংক।

বাংলাদেশ, ভারত, আমেরিকা ও ইউরোপের বহু দেশ থেকে উদ্ধারকর্মী দল পৌঁছে গেছে তুরস্কে। এরমধ্যে ৬৯ লাখ ডলার আর্থিক সহায়তাসহ উদ্ধারকাজে অংশ নিয়েছে অস্ট্রেলিয়া থেকে আসা ৭২ সদস্যের দল। নিউজিল্যান্ডও দুই দেশের জন্য নতুন করে ১৯ লাখসহ ২৮ লাখ ডলারের ত্রাণ সহায়তা পাঠিয়েছে। অনেক জুরুরি ত্রাণ সহায়তা দেশ দুটির পথে রয়েছে।

তুরস্ককে সহায়তার জন্য ১৯টি দেশের ২৭টি অনুসন্ধান, উদ্ধার ও মেডিকেল টিম গঠন করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। এক হাজার ১৫০ জনেরও বেশি উদ্ধারকর্মী ও ৭০টি বিশেষ কুকুর পাঠানো হয়েছে। সিরিয়ায় মানবিক সংস্থাগুলোকে অর্থায়ন করা হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের জানিয়েছে, ৭৯ জন করে দুটি অনুসন্ধান ও উদ্ধারকারী দল পাঠাচ্ছে তারা। চীন জানিয়েছে, দেশটির প্রথম উদ্ধারকারী দল মঙ্গলবার তুরস্কে কাজ শুরু করেছে। উদ্ধার ও চিকিৎসক দলসহ ৫৯ লাখ ডলার অর্থ সহায়তা পাঠিয়েছে বেইজিং।

যুক্তরাজ্যের ৭৭ জনের অনুসন্ধান ও উদ্ধার বিশেষজ্ঞ টিম, প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও উদ্ধারকারী কুকুরসহ জরুরি মেডিক্যাল টিম গাজিয়ানতেপে পৌঁছেছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোয়ানকে বলেছেন, উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ার পরিস্থিতি নিয়েও তিনি উদ্বিগ্ন।

ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত দুই দেশে সহায়তার জন্য আড়াই কোটি ডলার অনুদান ঘোষণা করেছে জাতিসংঘ। সংস্থাটির মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, আমরা এই দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হাজার হাজার পরিবারকে সাহায্যের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ওপর ভরসা রাখি। ক্ষতিগ্রস্তদের মানবিক সহায়তা দরকার; কিন্তু সেখানে পৌঁছানো একটি চ্যালেঞ্জ।

তুরস্কে ১৬টি কুকুরসহ উদ্ধারকারী টিম পাঠিয়েছে মেক্সিকো। বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত কুকুরসহ সেনাবাহিনীর অনুসন্ধান দল, উদ্ধার বিশেষজ্ঞ, নৌবাহিনীর সদস্য, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাঁচ কর্মকর্তা এবং রেড ক্রসের ১৫ সদস্যকে তুরস্কে পাঠানো হয়েছে।

সিরিয়ার জন্য সহায়তা পাঠানোর সিদ্ধান্ত অনুমোদন দিয়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। যদিও দেশটির সঙ্গে সিরিয়ার কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। তুরস্কেও সহায়তা পাঠানোর কথা জানিয়েছেন নেতানিয়াহু।

তুরস্ক ও সিরিয়াকে ১০০ মিলিয়ন ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। এটি ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত দুই দেশের জন্য এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় অঙ্কের অর্থ সহায়তা। সিরিয়াকে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে সৌদি আরবও।

বাংলাদেশের ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারী দল ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ তুরস্কে পৌঁছেছে। তুরস্কে উদ্ধারকাজে সহায়তার জন্য ফায়ার সার্ভিসের ১২ সদস্যের উদ্ধারকারী দলটি সেনাবাহিনীর উদ্ধারকারী দলের সঙ্গে ২৪ ঘণ্টার ভ্রমণ শেষে আদানা বিমানবন্দরে পৌঁছেছে। সেখান থেকে তারা ৩৫০ কিলোমিটার দূরে আদিয়ামানে বাসে করে রওনা হয়েছেন।

গত সোমবার সিরিয়ার সীমান্তবর্তী তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানে। তুরস্কের স্থানীয় সময় সোমবার ভোর ৪টা ১৭ মিনিটে ভূমিকম্পটি হয়। ভূমিকম্পটির কেন্দ্র ছিল সিরিয়ার সীমান্তবর্তী তুরস্কের গাজিয়ানতেপ শহরের কাছে।