চলমান সংবাদ

চমেক হাসপাতালের বিশেষায়িত বার্ন ইউনিট স্থাপনে গোঁয়াছি বাগানই চীনাদের পছন্দ

বিশেষায়িত বার্ন ইউনিট স্থাপনে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের গোঁয়াছি বাগান এলাকায় প্রস্তাবিত স্থানই অবশেষে চূড়ান্ত হয়েছে। সরেজমিনে পরিদর্শন পরবর্তী সার্বিক তথ্য–উপাত্ত পর্যালোচনা শেষে প্রস্তাবিত জায়গাটি চূড়ান্ত করেছে চীনা কর্তৃপক্ষ। আর এটিকে চূড়ান্ত ধরেই বিশেষায়িত বার্ন ইউনিট স্থাপনে এরই মধ্যে বাজেট প্রাক্কলনসহ ডিজাইন প্রস্তুতের কাজ এগিয়ে নেয়া হচ্ছে, যা বর্তমানে শেষ পর্যায়ে।

এ তথ্য নিশ্চিত করে সারাদেশে বার্ন চিকিৎসা সমপ্রসারণে সমন্বয়কের দায়িত্ব পাওয়া ডা. সামন্ত লাল সেন আজাদীকে বলেছেন, প্রস্তাবিত জায়গাটি নিয়ে চাইনিজদের কিছু কোয়ারি ছিল। এজন্য চিঠি দিয়ে কয়েকটি বিষয়ে তারা স্পষ্ট হতে চেয়েছিল।

পরে চমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ফিরতি জবাবে এসব বিষয় স্পষ্ট করে। এরপরই চাইনিজরা প্রস্তাবিত জায়গাটি চূড়ান্ত ধরে ডিজাইনের কাজ শুরু করে। যা এখন শেষ পর্যায়ে বলে জানিয়েছে। সম্প্রতি ই–মেইলের মাধ্যমে চাইনিজদের পক্ষ থেকে একটি বার্তা দেয়া হয়েছে জানিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, প্রস্তুত করা ডিজাইন ও প্রাক্কলনসহ তাদের (চাইনিজ) একটি টিম চলতি মাসের শেষ দিকে পুনরায় চট্টগ্রাম সফরে আসবে বলে তারা জানিয়েছে। অবশ্য তাদের আরো আগেই আসার কথা ছিল।

কিন্তু চীনে নতুন করে কোভিড সংক্রমণের কারণে তারা এসব কাজ এগিয়ে নিতে পারেনি। ফলে তাদের আসাও পিছিয়ে যায়। সর্বশেষ তারা চলতি মাসে আসার কথা জানিয়েছে। আমরা এখন তাদের অপেক্ষায় আছি।

এদিকে, গত মঙ্গলবার (৭ ফেব্রুয়ারি) স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে অবকাঠামো সংক্রান্ত এক বৈঠকে চমেক হাসপাতালের বিশেষায়িত বার্ন ইউনিটের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রী জাহিদ মালেকের সভাপতিত্বে বৈঠকে স্বাস্থ্য সচিব, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজি, ডা. সামন্ত লাল সেন ও চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসানসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠকের তথ্য নিশ্চিত করে চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান গতকাল রাতে  গণমাধ্যমকে বলেন, বৈঠকে বার্ন ইউনিটের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। গোঁয়াছি বাগানে আমাদের প্রস্তাবিত জায়গাটিতেই বার্ন ইউনিট স্থাপনে চাইনিজরা সম্মত হয়েছে। তারা বাজেটের পাশাপাশি ডিজাইনের কাজও মোটামুটি শেষ করে এনেছে। আর চলতি ফেব্রুয়ারিতেই তাদের বড়সড় একটি টিম পুনরায় আসছে বলে বৈঠকে জানানো হয়েছে।

প্রসঙ্গত, বিশেষায়িত বার্ন ইউনিট স্থাপনে অতি সমপ্রতি নতুন চারটি সাইট নির্ধারণ করে প্রস্তাবনা পাঠায় চমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এসব সাইটের মধ্যে রয়েছে– হাসপাতালের আওতাভূক্ত চট্টেশ্বরী সড়কের পার্শ্ববর্তী গোঁয়াছি বাগান এলাকা, চট্টেশ্বরী সড়কের প্রধান ছাত্রাবাসের উত্তর পার্শ্বে খালি জায়গা, হাসপাতালের পিছন দিকে অক্সিজেন প্লান্ট সংলগ্ন খালি জায়গা ও হাসপাতালের এনসিলিয়ারি ভবনের পশ্চিম পার্শ্বের (ডা. মিজান হোস্টেলের উত্তর দিকে) খালি জায়গা। তবে প্রথম দুটি সাইট (গোঁয়াছি বাগান ও প্রধান ছাত্রাবাসের পার্শ্ববর্তী) হাসপাতাল থেকে কিছুটা দূরে হলেও পর্যাপ্ত পরিমাণ জায়গা রয়েছে।

কিন্তু হাসপাতাল সংলগ্ন দুটি সাইটে জায়গার পরিমাণ পর্যাপ্ত নয় বলে প্রস্তাবনায় উল্লেখ করা হয়। পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় শেষের দুটি প্রস্তাবনা (হাসপাতাল কম্পাউন্ডে) ভাবনা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। আর গোঁয়াছি বাগান টার্গেট রেখেই এ প্রস্তাবনা এগিয়ে নেয় হাসপাতাল কর্র্তৃপক্ষ। এর প্রেক্ষিতে গত বছরের (২০২২ সালের) ১১ জুন চাইনিজ টিমের দুই প্রকৌশলীকে গোঁয়াছি বাগানে প্রস্তাবিত জায়গা ঘুরে দেখানো হয়।

সংশ্লিষ্টদের তথ্য অনুযায়ী– প্রস্তাবিত ২ নম্বর সাইটে প্রধান ছাত্রাবাসের উত্তর পার্শ্বে বা পিছনের জায়গাটিতে (গোঁয়াছি বাগান এলাকার) বিশেষায়িত এই বার্ন ইউনিট স্থাপন করা সম্ভব বলে মতামত দেয় চীনা কর্তৃপক্ষ। ইউনিটটি স্থাপনে মোট সাড়ে তিন হাজার বর্গ মিটার জায়গার প্রয়োজনীয়তার কথাও জানায় তারা।

যদিও প্রস্তাবিত এ জায়গাটির নতুন করে সীমানা স্পষ্টকরণ এবং সেখানে থাকা বাসা–বাড়ি ও বিভিন্ন স্থাপনা স্থানান্তর বা সরানোর বিষয়ে আরো তথ্য চায় চীনা কর্তৃপক্ষ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগকে (ইআরডি) প্রদত্ত এক চিঠিতে চীনা কর্তৃপক্ষ দ্রুত এসব তথ্য জানানোর অনুরোধ করে। ঢাকাস্থ চীনের দূতাবাসের মাধ্যমে চায়না কিউওয়ান ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে গত ৪ জুলাই এ চিঠি দেয়া হয়।

ইআরডি–কে প্রদত্ত চিঠিতে চীনা কর্তৃপক্ষ জানায়– তাদের বিশেষজ্ঞ দল প্রস্তাবিত চারটি সাইটেরই সম্ভাব্যতা পর্যালোচনা করেছে। এর মধ্যে জায়গা স্বল্পতার কারণে তিনটি সাইট (১, ৩ ও ৪ নম্বর) বার্ন ইউনিট স্থাপনে উপযুক্ত নয়। প্রস্তাবিত ২ নম্বর সাইটটিতে বার্ন ইউনিট স্থাপন করা সম্ভব।

তবে সাইটটির সীমানা ম্যাপসহ পুনরায় স্পষ্টকরণের পাশাপাশি সেখানে থাকা বাসা–বাড়িসহ বিভিন্ন স্থাপনা স্থানান্তর বা সরানোর বিষয়ে তথ্য জানাতে বলা হয় চিঠিতে। চাহিত তথ্য পাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ দলের সমন্বয়ে পরবর্তী অগ্রবর্তীমূলক পদক্ষেপ নেয়া হবে বলেও চিঠিতে উল্লেখ করে চীনা কর্তৃপক্ষ।

চীনা কর্তৃপক্ষের এই চিঠি পাওয়ার পরপরই চমেক উপাধ্যক্ষ প্রফেসর হাফিজুল ইসলামকে প্রধান করে ৫ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে চমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

কমিটির মতামত ও সুপারিশ সংযুক্ত করে ২৭ জুলাই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে এ সংক্রান্ত ফিরতি চিঠি পাঠানো হয়। নতুন করে সীমানা ম্যাপসহ প্রস্তাবিত জায়গায় থাকা বিভিন্ন স্থাপনা সরানোর বিষয়ে সুস্পষ্ট করা হয় চিঠিতে।

চীনা কর্তৃপক্ষ যেসব বিষয়ে তথ্য চেয়েছিল, তা সুস্পষ্ট করে জবাব দেয়া হয় জানিয়ে চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান বলেন, তাদের যেসব বিষয়ে কোয়ারি ছিল, চিঠিতে আমরা তা পয়েন্ট আকারে স্পষ্ট করার চেষ্টা করেছি। বিশেষ করে প্রস্তাবিত জায়গায় যেসব স্থাপনা রয়েছে, তা সরানোর বিষয়ে আমরা সুস্পষ্ট নিশ্চয়তা দিয়েছি। প্রস্তাবিত জায়গাটিতে আসলে বৈধ কোনও স্থাপনা নেই।

চমেক হাসপাতালের ফিরতি চিঠির পরই বিশেষায়িত বার্ন ইউনিট স্থাপনে প্রস্তাবিত জায়গাটি এক প্রকার চূড়ান্ত করে চীনা কর্তৃপক্ষ। এর প্রেক্ষিতে প্রস্তাবিত ওই জায়গা ঘিরেই বাজেট প্রাক্কলন ও ডিজাইনের কাজে হাত দেয় তারা। যা বর্তমানে শেষ পর্যায়ে। ডিজাইনের কাজ শেষ হলে চলতি মাসের মধ্যেই ১৫/২০ জনের একটি টিম পুনরায় চট্টগ্রামে আসার কথা জানিয়েছে চীনা কর্তৃপক্ষ।

এর আগে গত ১১ জুন চীনের দুই প্রকৌশলী এসে গোঁয়াছি বাগান এলাকায় নতুন প্রস্তাবিত জায়গাটি পরিদর্শন করেন। এসময় চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান, চমেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের প্রধান ডা. রফিক উদ্দিন আহমেদ, হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. রাজিব পালিত, গণপূর্ত বিভাগের (ইমারত–১) উপ–বিভাগীয় প্রকৌশলী জাহেদুন নবী চৌধুরীসহ অন্যান্যরা সাথে ছিলেন।

হাসপাতালের আওতাভূক্ত চট্টেশ্বরী সড়কের পার্শ্ববর্তী গোঁয়াছি বাগান এলাকা এবং চট্টেশ্বরী সড়কের প্রধান ছাত্রাবাসের উত্তর পার্শ্বে খালি জায়গা ঘুরে দেখানো হয় তাদের। পরিদর্শনকালীন প্রস্তাবিত জায়গার ছবি ও ভিডিও চিত্র ধারণ করেন চীনের দুই প্রকৌশলী। তারও আগে (৬ জুন) ডা. সামন্ত লাল সেনও সংশ্লিষ্টদের সাথে নিয়ে প্রস্তাবিত এ জায়গা পরিদর্শন করেন।

উল্লেখ্য, চমেক হাসপাতালে বাতিল হওয়া ১’শ শয্যার বিশেষায়িত বার্ন ইউনিট স্থাপন প্রকল্পের জন্য চিহ্নিত করা আগের জায়গাতেই (হাসপাতালের পিছনের অংশে) বিশেষায়িত বার্ন হাসপাতাল স্থাপনে পুনরায় প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছিল। তবে একই জায়গাতে দেয়া সে–ই প্রস্তাবনাও বাতিল করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

প্রস্তাবনা বাতিলের বিষয়টি অবহিত করে প্রকল্পটির জন্য অন্যত্র জায়গা নির্ধারণে ফের নির্দেশনা দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার প্রেক্ষিতে গত বছরের ২৭ এপ্রিল এ সংক্রান্ত চিঠি চমেক হাসপাতাল পরিচালক বরাবর পাঠানো হয়।

অধিদপ্তরের পরিচালক (পরিকল্পনা ও গবেষণা) ডা. আফরিনা মাহমুদ স্বাক্ষরিত চিঠিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য বিকল্প সাইট (ভূমি) নির্ধারণ পূর্বক পুনরায় প্রস্তাব প্রেরণের জন্য বলা হয়। চিঠি পাওয়ার পরপরই (২৮ এপ্রিল) বিকল্প সাইট (ভূমি) নির্ধারণসহ নতুন প্রস্তাবনা প্রস্তুতে ৬ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেন চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান।

হাসপাতালের উপ–পরিচালক ডা. অংসুই প্রু মারমাকে আহ্বায়ক এবং বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের প্রধান ডা. রফিক উদ্দিন আহমদকে কমিটির সদস্য সচিব করা হয়।

এছাড়া হাসপাতালের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) ডা. রাজিব পালিত, গণপূর্ত বিভাগের (ইমারত–১) উপ–বিভাগীয় প্রকৌশলী জাহেদুন নবী চৌধুরী, হাসপাতালের আবাসিক সার্জন (জেনারেল) ডা. মঈন উদ্দিন মাহমুদ ও হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. নজরুল ইসলামকে কমিটির সদস্য হিসেবে রাখা হয়। প্রস্তাবিত বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ভবন নির্মাণের লক্ষ্যে প্রাথমিক ভাবে চারটি বিকল্প সাইট নির্ধারণ করে এ কমিটি।

কমিটি কর্তৃক নির্ধারিত চারটি সাইটের প্রস্তাবনা চূড়ান্তের পর সেটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠায় চমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এরপরই চীনের দুই প্রকৌশলী এসে প্রস্তাবিত সাইটগুলো পরিদর্শন করেন।