জ্বালানির দাম বাঁধবে সরকার, নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভবিষ্যৎ কী
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, নির্বাহী আদেশে সরকারের বিদ্যুৎ ও গ্যাসে দাম বাড়ানোর ক্ষমতা থাকলেও বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের কর্মকান্ডে পরিবর্তন আসবে না ।
বাংলাদেশে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করে নির্ধারণ করে থাকে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন-বিইআরসি বা সংক্ষেপে বার্ক। দাম সমন্বয়ের অংশ হিসেবে, গণশুনানির আয়োজন করে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। যেখানে, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের মালিকদের সাথে সাথে ভোক্তাদের প্রতিনিধিও থাকে।
গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম নির্ধারণের ক্ষমতা সরকারের হাতে চলে যাওয়ার ফলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে যে, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম সমন্বয়ের কাজ যদি সরকার করে তাহলে সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটির কার্যকারিতা গিয়ে কী দাঁড়াবে।
এমন প্রশ্নের উত্তরে বিবিসি বাংলাকে মি. হামিদ বলেন, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন বা বার্ক তাদের কাজ করে যাবে।
সরকার শুধুমাত্র দেশে বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি হলেই সেখানে বার্কের পরিবর্তে নিজেই গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করবে। আর এই কাজটি করার জন্যই বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি আইন সংশোধন করে নতুন একটি ধারা সংযোজন করা হয়েছে।
রবিবার, বাংলাদেশের সংসদে বাংলাদেশে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন সংশোধন বিল ২০২৩ পাস করা হয়। এতে নতুন একটি ধারা সংযোজন করা হয়।
এই ধারা অনুযায়ী, বিশেষ ক্ষেত্রে সরকার, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন, এনার্জি সঞ্চালন, মজুদকরণ, বিপণন, সরবরাহ, বিতরণ এবং ভোক্তা পর্যায়ে ট্যারিফ নির্ধারণ, পুনঃনির্ধারণ বা সমন্বয় করতে পারবে। অর্থাৎ এক কথায় গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম নির্ধারণের ক্ষমতা দেয়া হয় সরকারকে।
মি. হামিদ বলেন, বিশেষ অবস্থা বলতে, যখন স্বল্প সময়ের মধ্যে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর দরকার হবে, তখন বার্কের পরিবর্তে পদক্ষেপ নেবে সরকার।
গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম সমন্বয়ে বার্কের কার্যপ্রণালী সময় সাপেক্ষ উল্লেখ করে তিনি বলেন, বার্ককে গ্যাস বা বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করতে দেয়া হলে তারা এক বছর লাগিয়ে ফেলে। এর মধ্যে তিন বার দাম পরিবর্তিত হয় যায়।
“এই যেমন এখন বিশেষ সময় চলছে। সারা বিশ্বে দাম বেড়ে গেছে অন্য সময়ের চাইতে।”
তবে, এই আইন পাসের পর বার্কের কাজ কী হবে সে বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি সংস্থাটির চেয়ারম্যান।
এরআগে গত ১৩ই জানুয়ারি নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম প্রতি ইউনিটে গড়ে ৫ শতাংশ বাড়ায় সরকার। এটি ছিল বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে পাস কাটিয়ে নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে সরকারের বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রথম পদক্ষেপ।
এর পরে গত ১৮ই জানুয়ারি শিল্প ও বাণিজ্যিক খাতের জন্য গ্যাসের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। এক প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে দাম বাড়ানোর এই ঘোষণা দেয়া হয় যা ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর হবে।
তবে এদিন, সরকার গ্যাসের দাম বাড়ানোর যে ঘোষণা দিয়েছে তার কারণ সম্পর্কে এখনো কোন ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি।
সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কেউ গ্যাসের দাম এতোটা বৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
১৮ই জানুয়ারি পেট্রোবাংলা বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছিল যে, প্রজ্ঞাপন মন্ত্রণালয় থেকে জারি হয়েছে বলে তারাই এর ব্যাখ্যা দিতে পারে। আর মন্ত্রণালয় বলেছিলো, তারা সবকিছু বিশ্লেষণ করে পরবর্তীতে তাদের আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা দেবে। তবে সেই ব্যাখ্যা এখনো পর্যন্ত আসেনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার যদি বিশেষ পরিস্থিতি ছাড়া সবসময়ই বার্ককে পাশ কাটিয়ে জ্বালানির দাম নির্ধারণ করে তাহলে বার্ক অনেকটা অকার্যকর হয়ে পড়বে। যার ফলে ভোক্তা স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়ে পড়তে পারে।
ভোক্তা অধিকার সংস্থা কনজিউমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বা ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, “আমরা আশা করছি যে সরকার এমন কিছু করবে না।”
বাংলাদেশে জ্বালানির ক্ষেত্রে একটি সুষ্ঠু পরিবেশ এবং দক্ষ, সু-পরিচালিত এবং টেকসই জ্বালানিখাত তৈরি করে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে ন্যায্য ও যুক্তিসঙ্গত দামে জ্বালানি সরবরাহ করে ভোক্তাদের স্বার্থ সুরক্ষার লক্ষ্যে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন গঠিত হয়েছিল।
এই অংশ হিসেবে, সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের জন্য সমান সুযোগ দেয়ার মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক বাজার সৃষ্টি, জ্বালানি খাতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, যৌক্তিক দাম ও ট্যারিফ নির্ধারণ ইত্যাদি কাজ করতো সংস্থাটি।
আর এটি করতে গণশুনানির আয়োজন করে সব পক্ষের প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনা করে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করা হতো।
তবে, নতুন নিয়ম অনুযায়ী সরকার যখন দাম সমন্বয় করবে তখন আর এ ধরণের গণশুনারি দরকার হবে না। সরকার প্রয়োজন মনে করলে দাম বাড়াতে পারবে।
ক্যাব বলছে যে, ভোক্তাদের জন্য জ্বালানির দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে সব সময়ই বার্কের প্রক্রিয়াকেই অগ্রাধিকার দেয়া দরকার। তা না হলে দাম নির্ধারণী প্রক্রিয়ায় কোন স্বচ্ছতা থাকবে না।
আর দাম নির্ধারণে স্বচ্ছতা না থাকলে সেটি জবাবদিহিতামূলক হয় না।
মি. রহমান বলেন, সরকার আইন করে জ্বালানির দাম নির্ধারণের ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে নেয়ার পর দাম নির্ধারণের সরকারি প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হবে বলে মনে করেন না তিনি।
বরং এতে করে অনেক কিছু চাপা পড়ে যাবে এবং অনেক অনিয়ম, অমিতব্যয়ীতা, এবং দুর্নীতি বাসা বাধার আশঙ্কা রয়েছে। আর এর ফলে যে দাম নির্ধারণ করা হবে তা ভোক্তাদের ঘাড়ে চেপে বসতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
এরআগে, রবিবার সংসদে বাংলাদেশে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন সংশোধন বিল পাস হওয়ার আগে নতুন সংযোজিত ধারাটির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে ওয়াক আউট করেন একজন সংসদ সদস্য।
মুন্নী আক্তার, বিবিসি বাংলা, ঢাকা