চলমান সংবাদ

ভরা মৌসুমেও চালের দাম বাড়তি কেন?

বাংলাদেশে এখন আমনের ভরা মৌসুম৷ হয়েছে বাম্পার ফলন৷ তারপরও চালের দাম কমার কোনো লক্ষণ নেই, বরং বাড়ছে৷ এর কারণ কী? এই প্রশ্ন কৃষি মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির৷ তারা এর কারণ অনুসন্ধানের সুপারিশ করেছে৷

বাংলাদেশে এখন আমনের ভরা মৌসুম৷ হয়েছে বাম্পার ফলন৷ তারপরও চালের দাম কমার কোনো লক্ষণ নেই, বরং বাড়ছে৷ এর কারণ কী? এই প্রশ্ন কৃষি মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির৷ তারা এর কারণ অনুসন্ধানের সুপারিশ করেছে৷

প্রাথমিকভাবে বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, চাল ব্যবসা বড় বড় কর্পোরেট গ্রুপের হাতে চলে যাওয়ায় এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে৷ তারা বাজারে নতুন চাল আসার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে কিনে নিয়ে মজুত করে, পরে তারা এই চাল প্যাকেটজাত করে বাজারে ছাড়ে৷ তারা প্লাস্টিকের সুদৃশ্য বস্তায় ৫০ কেজি ছাড়াও বিভিন্ন আকারের প্যাকেটে বাজারজাত করে৷ এই ‘ভিআইপি চালের’ দাম অনেক বেশি৷ আর তার প্রভাবে সাধারণভাবে সব চালের দাম বাড়তি হচ্ছে৷ তাদের প্রভাবে চটের বস্তার চাল বাজার থেকে দিন দিন উধাও হয়ে যাচেছ৷

তবে এটাই একমাত্র কারণ নয় বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা৷ তারা বলছেন, ধানের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া এবং গমের ব্যবহার কমে চালের চাহিদা বাড়ার কারণেও চালের দাম বাড়ছে বা কমছে না৷ এর সঙ্গে মজুত প্রবণতাও কাজ করছে৷ প্রভাব ফেলছে সরকারের ধান সংগ্রহে৷

সাধারণ মিলে ভাঙানো মিনিকেট চালের ৫০ কেজির বস্তার দাম তিন হাজার ৪০০ টাকা হলেও কর্পোরেট কোম্পানির একই পরিমাণ ‘ভিআইপি’ চালের দাম তিন হাজার ৭০০ টাকা৷ বাজারে দামের এই পার্থক্য পুরো চালের বাজারকে অস্থির করে তোলে৷ আর এখন কর্পোরেটরাই চালের বাজারের প্রায় অর্ধেক নিয়ন্ত্রণ করছে৷ তার সংঘবদ্ধ৷ অন্য যে শত শত মাঝারি ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আছেন তারা  চালের বাজারে প্রভাব বিস্তার করতে পারেন না৷ তাই কর্পোরেটরাই এখন চালের দাম ঠিক করে দিচ্ছে৷

কারা চাল ব্যবসায়

ব্যবসায়ীরা জানান, চাল ব্যবসায় এখন বাজারে যেসব কর্পোরেট গ্রুপের প্রভাব তাদের মধ্যে আছে সিটি গ্রুপ (তীর), মেঘনা গ্রুপ (ফ্রেশ), এসিআই, প্রাণ গ্রুপ, বাংলাদেশ এডিবল অয়েল কোম্পানি, আকিজ গ্রুপ, বসুন্ধারা গ্রুপসহ আরো কয়েকটি  শিল্প গ্রুপ৷  এছাড়া সাগর স্পেশাল, আড়ং ন্যাচারাল, মোজাম্মেল স্পেশাল রাইস, সেনা রাইস, ফরচুন রাইস, চাষি ও অ্যারোমেটিক রাইসসহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠানের প্যাকেটজাত চাল বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে৷ কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর ৫০ কেজির মিনিকেট চালের দাম ৩ হাজার ৭০০ টাকা হলে এক কেজির দাম পড়ে ৭৪-৭৫ টাকা৷

আর এই কারণে চালের বাজারে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে৷ যে চাল প্যাকেটজাত করে ৭৫ টাকা কেজি বিক্রি হচেছ, সেই চালই খোলা ৬০-৬২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে৷ অন্যান্য চালের ক্ষেত্রেও দামের এই পার্থক্য রয়েছে৷ আর টিসিবির হিসাব বলছে গত এক মাসের ব্যবধানে সব ধরনের চাল কেজিতে দুই থেকে থেকে পাঁচ টাকা বেড়েছে৷

আমনের বাম্পার ফলন

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে চলতি আমন মৌসুমে সারা দেশে ৫৮ লাখ হেক্টর জমিতে আমন ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল৷ আবাদ হয়েছিল ৫৯.৫৪ হেক্টর জমিতে৷ এবার আমন ধানের মোট উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল এক কোটি ৬৩ লাখ মেট্রিক টন৷ আর হেক্টরপ্রতি উৎপাদন লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ৩. ৫৬ মেট্রিক টন৷

এখন পর্যন্ত সারা দেশে আমন ধান কাটা হয়েছে ৫০ শতাংশ৷ আমন ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে৷ হেক্টরপ্রতি ৩.৫৬ মেট্রিক টন উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছিলো৷ এখন পর্যন্ত যে পরিমাণে ধান কাটা হয়েছে, তাতে হেক্টরপ্রতি গড় উৎপাদন ৩.৬ থেকে প্রায় ৪ মেট্রিক টন৷ এবার কৃষকও আমনের ভালো দাম পাচ্ছেন৷ ধানের মান অনুযায়ী এক হাজার টাকা থেকে এক হাজার ৩০০ টাকা মণ দরে এখন আমন ধান বিক্রি হচ্ছে৷ এতে কৃষকের যে খরচ হয়েছে তার চেয়ে বেশি পাচ্ছেন তারা৷

 চালের দাম বেশি কেন?

কুষ্টিয়ার খাজা নগরের চাল কল মালিক জয়নাল আবেদিন বলেন, ‘‘আমরা তো এখন কোনঠাসা হয়ে পড়ছি৷ বড় বড় শিল্প গ্রুপ এখন চাল ব্যবসায় ঢুকেছে৷ তারা চালের বাজার খালি করে দিচ্ছে৷ নতুন চাল উঠলেই তারা তা কিনে নিয়ে প্লাস্টিকের সুদৃশ্য বস্তা এবং প্যাকেটজাত করে বেশি দামে বিক্রি করে৷ ৬০ টাকা কেজির চাল তারা ৭৫-৭৬ টাকায় বিক্রি করে৷ আগে তারা সরু, পোলাও ও সুগন্ধি চাল এভাবে বিক্রি করত৷ এখন তারা প্রায় সব ধরনের চালই বিক্রি করছে৷ এর প্রভাব বাজারেও পড়ছে৷”

তবে এবার ধানের দামও বেশি৷ এবার প্রতিমন ধান ২৫০-৩০০ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে৷ তার প্রভাবও আছে৷ তবে শিল্প গ্রুপগুলোর কারণে আরো বেশি বলে জানান তিনি৷ বলছেন, ‘‘আমরা তো পারিনা, তারা বিএসটিআই থেকে প্লাস্টিকের বস্তা, প্যাকেটের অনুমোদন নেয়, নামের অনুমোদন নেয়৷ আর আমরা প্লাস্টিকের বস্তায় ভরলে আমাদের জরিমানা করা হয়৷ এখানে চালের দাম নিয়ে শুভঙ্করের ফাঁকি চলছে৷ মোট চাল ব্যবসায়ীর শতকরা পাঁচ ভাগ তারা৷ কিন্তু বাজারের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে৷”

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশ অব বাংলাদেশের(ক্যাব)  সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, ‘‘এখন ভরা মৌসুমে চালের দাম সবচেয়ে কম থাকার কথা৷ কিন্তু কর্পোরেট সিন্ডিকেটের কারণে তা হচ্ছে না৷ তারা এখন বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে৷ তারাই দাম ঠিক করে দিচ্ছে৷ তারা একবার যে দাম ঠিক করে দেয় তার থেকে আর কমায় না৷ ”

তিনি বলেন, ‘‘এখন ৫০ কেজি থেকে শুরু করে ২৫,১০, ৫ এমনকি দুই কেজির সুদৃশ্য প্যাকেটে চাল পাওয়া যায়৷ এই চালের দাম কমপক্ষে শতকরা ১০- ১৫ টাকা বেশি৷ তাদের প্রভাবে বাজার থেকে খোলা চটের বস্তার চাল উধাও হয়ে যাচ্ছে৷ ফলে বাজার তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে৷ এর ফল হচ্ছে  প্রচলিত  চটের বস্তার চালের দামও বেড়ে যাচ্ছে৷ এই কর্পোরেট ব্যবসায়ীরা চাল মজুত করে রাখে৷ ভরা মৌসুম চিন্তা করেনা৷ তারা সারা বছরের ব্যবসার পলিসি ঠিক করে চালের দাম নির্ধারণ করে দেয়, ফলে মৌসুমেও চালের দাম কমে না৷ আমরা চালের দাম ঠিক করে দেয়ার এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করেছি, কিন্তু কাজ হয়নি৷”

এনিয়ে কথা বলতে চাইলে একটি কর্পোরেট গ্রুপের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা দাবি করেন, ‘‘আমরা স্বাস্থ্য সম্মত উপায়ে চাল বাজারজাত করি৷ আমাদের প্রতি গ্রাহকদের আস্থা তৈরি হয়েছে৷ আমরা ভালো প্যাকেটে চালের গুণগত মান বাজায় রেখে প্যাকেটজাত করে ক্রেতাদের দিই৷ তারাও কেনেন৷ আমরা ভ্যালু অ্যাড করি৷ তাই দামও একটু বেশি৷ যারা কম দামে কিনতে চান তারা খোলা চাল কিনতে পারেন৷”

তিনি বলেন, ‘‘এটা আসলে মার্কেটিং পলিসি৷ আমাদের মার্কেটিং পলিসি অনুযায়ী আমরা বাজারজাত করি৷ তবে আমাদের বিরুদ্ধে মজুতের অভিযোগ ঠিক না৷”

আরো কারণ

সেন্টার পর পলিসি ডায়ালগের(সিপিডি) গবেষণা পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘‘বড় বড় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো আসলে একটু উচ্চ মানের চাল বাজারজাত করছে প্যাকেট করে৷ তার একটি প্রভাব থাকতে পারে চালের দাম না কমায়৷ তবে আমি মনে করি এবার কৃষি উপকরণ, সারের দাম বেশি৷ কৃষি শ্রমিকের মজুরিও বেশি, ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে ধানের৷ এরসঙ্গে যোগ হয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গমের আমদানি কমে যাওয়া৷ ফলে বাংলাদেশের মানুষের চালের চাহিদা বেড়েছে৷ সরকার পরিস্থিতির কারণে বেশি ধান সংগ্রহ করে একটি মজুত গড়ে তুলছে৷ এইসব কারণে চালের চাহিদা বেড়েছে৷ তাই ভরা মৌসুমেও দাম কমছেনা৷” তিনি বলছেন,‘‘মিল মালিকদের মধ্যেও মজুত প্রবণতা বেড়েছে৷ কারণ সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় তারা মনে করছেন সামনে আরো বেশি দাম পাওয়া যাবে৷ তাই অতিরিক্তি মুনাফার আশায় তারা মজুত করছেন৷’