বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (৭৩): সাহিত্য সংস্কৃতি ও দেশ

– বিজন সাহা  

গত পর্বে আমরা যুদ্ধকালীন সাহিত্য সংস্কৃতি এসব নিয়ে কথা বলেছিলাম আর কথা বলেছিলাম সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের নিয়ে। যেকোনো সমাজেই বিভিন্ন রকমের মানুষ থাকে আর সেসব মানুষের থাকে বিভিন্ন রকমের আদর্শ, জীবন দর্শন। তার ভিত্তিতেই রচিত হয় তার গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস। পাঠক তার নিজের রুচি থেকে, নিজের জীবন দর্শনের উপর ভিত্তি করে কাউকে পছন্দ করে, কাউকে করে না। এক্ষেত্রে লেখকের রচনার সাহিত্য মূল্যের চেয়ে বড় সেই মেসেজ – যেটা তিনি দিচ্ছেন সমাজকে। মানুষ শুধুমাত্র কবি, সাহিত্যিক, গায়ক, বিজ্ঞানী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি নয়, মানুষ সামাজিক জীব, রাজনৈতিক সত্ত্বা।  এজন্যেই হয়তো বলে রাশিয়ায় কবি কবির চেয়েও বড় কিছু। তাই পেশাগত জীবনে একজন সফল মানুষ যে রাজনৈতিক জীবনে সবার প্রিয় হবে তার কোন মানে নেই। তবে সাধারণ মানুষ পাবলিক ফিগারদের কাছ থেকে দেশপ্রেম আশা করে, আশা করে অন্য সময়ে সমালোচনা করলেও ক্রান্তিকালে তারা যেন দেশের হয়ে, দেশের মানুষের হয়ে লড়ে। আর সেটা যখন হয় না তখন নানা প্রশ্নের জন্ম নেয়। এ কারণেই যারা এ সময়ে দেশের পক্ষে না দাঁড়ায় তাদের প্রায়ই বিশ্বাসঘাতক বলা হয়।  এটা নিয়ে হঠাৎ করেই মনে একটা প্রশ্ন জাগল। এরা কি আসলেই বিশ্বাসঘাতক? কারণ বিশ্বাসঘাতক সে যে নিজের বিশ্বাসের সাথে বেঈমানি করে। কিন্তু এরা সবাই কি সেটা করছে? আর এ নিয়ে ভাবতে গিয়ে কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা মনে পড়ল। দিল্লির সুলতান ইব্রাহিম লোদির সাথে উজ্জয়ীনীর মহারাণা সংগ্রাম সিংহের শত্রুতা সর্বজন বিদিত। ১৫২৬ সালে প্রথম পানিপথের যুদ্ধে এই সংগ্রাম সিংহের সাহায্য নিয়েই বাবুর ইব্রাহিম লোদিকে পরাজিত করেন। যদিও পরবর্তীতে রাজপুতদের অনেকেই মুঘল সাম্রাজ্যে বিভিন্ন উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হন, তারপরেও তাদের হাত ধরেই ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের পত্তন ঘটে। ইতিহাসে সংগ্রাম সিংহ বীর হিসেবেই পরিচিত। অন্যদিকে আলীবর্দি খানের মৃত্যুর পরে তাঁর বন্ধু কাম সভাসদদের অনেকেই তরুণ সিরাজ-উদ-দৌল্লার ব্যবহারে নাখোশ হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে চুক্তি অনুযায়ী মীর জাফর নবাব হন। ধারণা করা যেতে পারে চুক্তিটা এমনই হয়েছিল। তবে পরবর্তীতে মীর জাফরের দুর্বলতা আর ইংরেজদের ক্ষমতালিপ্সা ইতিহাসকে অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেয় আর মীর জাফর বিশ্বাসঘাতক হিসেবে খ্যাত হন। যদি ইতিহাস অন্যদিকে মোড় নিত, যদি দেশের শাসন ইংরেজদের হাতে চলে না যেত মীর জাফর হয়তো অন্য ভাবে পরিচিত হতেন। আসলে মানুষের পরিচয় তার কাজের ফলাফলের উপর নির্ভর করে। যখন মানুষ কাজ শুরু করে তখন সে সাফল্যের কথা মাথায় রেখেই করে। যদি কেউ ব্যর্থতার কথা ভেবে কাজে নামত তার পক্ষে সফল হওয়া কঠিন। তবে কি সংগ্রাম সিংহ আর মীর জাফর একই ক্যাটাগরির মানুষ? না। প্রথম জন স্বাধীন রাজা, নিজের ও রাজ্যের স্বার্থে স্বাধীন ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। দ্বিতীয় জন সিরাজের সেনাপতি, বিভিন্ন ভাবে সিরাজের কাছে দায়বদ্ধ। আর এ কারণেই তিনি বিশ্বাসঘাতক তা যুদ্ধের ফলাফল যাই হোক না কেন। তাই আজ রাশিয়া থেকে যারা বাইরে চলে যাচ্ছে তারা যদি সরকারের কাছে দায়বদ্ধ না হয় তাদের বিশ্বাসঘাতক বলা হয়তো ঠিক হবে না, তবে এদের মধ্যে যারা সচেতন ভাবে দেশের বিরুদ্ধে কাজ করছে তারা নিশ্চয়ই দেশদ্রোহী। উল্লেখ করা যেতে পারে যে রাশিয়ায় ইন্টিলিজেনশিয়া মূলত গড়ে উঠেছে ইউরোপীয় কায়দায়, ফলে ইউরোপের প্রতি তাদের দুর্বলতা সবসময়ই বেশি। তবে এ নিয়ে সমাজে, বিশেষ করে বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে বিভিন্ন মত আছে। এরকম একটা ধারণা সমাজে বিদ্যমান যে সরকারের বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী যে কোন আন্দোলন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আন্দোলনকারীদের দেশের বিরুদ্ধে দাঁড় করায়। এর কারণ দীর্ঘ দিনের সরকার বিরোধী আন্দোলন আন্দোলনকারীদের মধ্যে এমন এক মানসিকতা তৈরি করে যে তারা সরকার যে দেশের জন্য ভালো কিছু করতে পারে সেটা আর বিশ্বাস করতে পারে না বা স্বীকার করতে পারে না। কারণ সেটা  রাজনৈতিক ভাবে তাদের ভোট ব্যাংকের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। ফলে তাদের অনেক কর্মসূচি দেশ ও দেশের মানুষের বিরুদ্ধে যায়। এটা আমাদের দেশেও দেখি। মনে রাখতে হবে যে নির্বাচনের সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিভিন্ন পপুলিস্টিক স্লোগান বা প্রোগ্রাম দিলেও বাস্তবতা তাদের সেভাবে কাজ করতে দেয় না। বিভিন্ন সময়ে জনকল্যাণমূলক কাজের পাশাপাশি সরকারকে অনেক সময় অজনপ্রিয় সিদ্ধান্তও গ্রহণ করতে হয়। এটা সব সরকারই করে। কিন্তু কোন দল যখন রাজনৈতিক জমাখরচের হিসাব করে সরকারের সব কাজকেই নেগেটিভ আলোতে দেখে তখন সেটা জনগণের পক্ষে কমই যায়। মনে রাখা দরকার সাধারণত সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভোট পেয়েই গঠিত হয়, তাই সব কাজে সরকার বিরোধিতা মানে এই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতার মতামতকে উপেক্ষা করা। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে যে আমাদের দেশে বিরোধী দলের জ্বালাও পোড়াও আন্দোলন যেটা আর যাই হোক জনগণ বা দেশের স্বার্থে নয়। একই কথা বলা যেতে পারে যখন রাশিয়ার তথাকথিত লিবারেল রাজনীতিবিদরা বিদেশে গিয়ে ইউরোপ আমেরিকার বিভিন্ন দেশকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরণের স্যাঙ্কশন আরোপ করতে উদ্বুদ্ধ করে। এদের অধিকাংশই সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও পরবর্তীতে রাশিয়ার অর্থনীতি ধ্বংস করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে আর নিজেরা দেশের সম্পদ আত্মসাৎ করেছে। এখন তাদের মূল লক্ষ্য দেশ বা গণতন্ত্র নয়, দেশের সম্পদ যা নতুন করে লুট করে তারা ইংল্যান্ড বা অন্যান্য পশ্চিমা দেশে নিশ্চিন্তে বসবাস করবে। তাই এদের বা যারা এদের সমর্থন করে তাদের বিশ্বাসঘাতক না বললেও দেশদ্রোহী বলাই চলে। ফলে সমাজে এখন প্রশ্ন উঠছে যেসব শিল্পী, সাহিত্যিক, গায়ক, অভিনেতা রাশিয়া ছেড়ে চলে গেছে, বাইরে গিয়ে বিভিন্ন ভাবে রাশিয়ার বিরোধিতা করছে তাদের লেখা, তাদের গান এদেশে নিষিদ্ধ করা উচিৎ কি না। সরকার বলছে এটা অগণতান্ত্রিক, এটা বেআইনি। কিন্তু যারা এসব নিষেধ আরোপের পক্ষে তারা বলছে যদি ইউরোপ, আমেরিকা রুশ ভাষা, রুশ সাহিত্য, রুশ সংস্কৃতির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে রাশিয়া কেন পারবে না যারা দেশের শত্রু তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে? এরা বলছে যে পশ্চিমা বিশ্ব এক সময় এইসব আদর্শের অনুসারি ছিল, এখনও আছে বলে মনে করে তারা যেখানে উঠতে বসতে এসব আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখায় রাশিয়া কোন আশায় সেসব নিয়ম মেনে চলবে?  এক্ষেত্রে তারা মাক্সিম গোরকি, আলেকসান্দার সলঝেনিৎসিন, এডুয়ারদ লিমনভ প্রভৃতি লেখকদের উদাহরণ টানেন। উল্লেখ করা যেতে পারে যে অক্টোবর বিপ্লবের পর পর মাক্সিম গোরকি ইটালি চলে যান যেখানে রচিত হয় তাঁর বিখ্যাত ইটালির গল্প। সেসময় তিনি ছিলেন পৃথিবীর অন্যতম জনপ্রিয় লেখক। তাঁর লেখা তখন ইবসেন বা চেখভের চেয়েও বেশি মঞ্চস্থ হত। তাঁর লেখা সেসময় পৃথিবীর প্রধান প্রধান সমস্ত ভাষায় অনূদিত হয়েছিল। কিন্তু এরপর যখনই তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নে ফিরে আসেন আর স্তালিনকে সমর্থন করেন এর পরবর্তী প্রায় পঞ্চাশ বছর পশ্চিমা বিশ্বের জন্য তিনি অস্পৃশ্য হয়ে যান। তাঁর লেখা হয় নিম্নমানের। বলতে গেলে পশ্চিমা বিশ্ব গোরকিকে নাই করে দেয়। একই ঘটনা ঘটে নিকোলাই অস্ত্রভস্কির সাথে যার “ইস্পাত” বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। শলখভ, গাইদার, কাতায়েভ, পলেভই এরকম অনেক লেখক তাঁদের লেখার মাধ্যমে পশ্চিমা বিশ্বের মানুষের মন জয় করলেও পরবর্তীতে রাজনৈতিক কারণে সেখান থেকে নির্বাসিত হয়েছেন। একই ঘটনা ঘটেছে লিমনভ আর হালে প্রিলেপিনের সাথে। এদের কথা গণতন্ত্রের ধারক বাহকরা যদি চোখের পলক না ফেলে জনপ্রিয় আর সত্যিকার অর্থে বিশ্বমানের কবি সাহিত্যিকদের নাই করে দিতে পারে কি হবে যদি রাশিয়া যে সমস্ত কবি, লেখক, শিল্পী পশ্চিমা বিশ্বে গিয়ে দেশের বিরুদ্ধে কাজ করছে তাঁদের বই, তাঁদের গান, তাঁদের সিনেমা রাশিয়ায় নিষিদ্ধ করলে? আজ যারা দনবাসে যুদ্ধ করছে, দেশের জন্য, দেশের মানুষের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য প্রাণ দিচ্ছে তারা কি মেসেজ পায় যখন এই সব কবি লেখক তাঁদের শিল্পকর্ম থেকে প্রাপ্ত অর্থ ঘোষণা দিয়েই ইউক্রেনের তহবিলে জমা দেয়? আবার ফিরে আসি দেশের কথায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের শিল্পীরা গান গেয়ে টাকা তুলতেন, রবিশঙ্কর, আলী আকবর খান, জর্জ হ্যারিসনের কথা কে না জানে? আচ্ছা যদি আমাদের কোন শিল্পী সে সময় পাকবাহিনীর জন্য তহবিল সংগ্রহে গান গাইত, আমরা সেটা কিভাবে দেখতাম? উত্তর বলতে হবে না। বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমের সাথে ম্যাচের সময় দেশের কেউ পাকিস্তান বা ভারতকে সমর্থন করলেই আমরা দেখি কি প্রতিক্রিয়া হয়। আমার ধারণা দেশের মুক্তিযোদ্ধারা নামকরা রাজাকারদের বাংলাদেশের ফ্ল্যাগধারী মন্ত্রীর গাড়িতে উপবিষ্ট দেখে বা দেশের সেনাবাহিনীর জওয়ানদের এসব লোককে স্যালুট করতে দেখে যেমনটা মানসিক আঘাত পেয়েছিল, দনবাসে যুদ্ধরত রুশ সেনারা সেরকমটাই অনুভব করবে।

প্রশ্ন উঠতে পারে যুদ্ধের সময় সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়ে কথা বলার কি আছে? এর আগে আমি প্রগতির যাত্রী, আজকের পত্রিকা, জ্বলদর্চি ইত্যাদি পত্রিকায় ইউক্রেনের যুদ্ধ সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে লিখেছিলাম যে এই যুদ্ধের সাথে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের অনেক মিল। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ যেমন ভাষা আন্দোলন দিয়ে শুরু হয়েছিল এদেরও তাই – নিজের ভাষায় কথা বলার, নিজের ভাষায় লেখাপড়া করার দাবি নিয়েই শুরু দনবাসের আন্দোলন। আমরা যেমন স্বায়ত্ব শাসন চেয়েছিলাম, এরা কিছুদিন আগে পর্যন্তও সেটাই চেয়েছিল। আসলে জাতির জন্য ধর্ম বা রাজ্য থেকেও ভাষা আর সংস্কৃতির গুরুত্ব বেশি বলেই মনে হয়। তাই বলা যায় ইউক্রেন যুদ্ধ আন্দোলনের শুরু নয়,  শেষ পর্যায়। যেমনটা ছিল আমাদের জন্য একাত্তর। আমার ধারণা ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবে টু স্টেটস বা দুটো রাষ্ট্রের কথার মধ্য দিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু। পরবর্তীতে জিন্নাহর কারসাজিতে এক রাষ্ট্র হলেও সেটা মুহূর্তেই ভেঙে পরে। দরকার ছিল অজুহাত আর বাঙালি সেটা পায় ১৯৪৮ সালেই। পরবর্তী সমস্ত আন্দোলন ছিল ভাষা আর সংস্কৃতিকে ঘিরে যার চূড়ান্ত রূপ একাত্তর। একই কথা বলা চলে দনবাস বা ইউক্রেনের ক্ষেত্রে। যদিও ১৯৯১ সালে পপুলিস্টিক স্লোগানে বিশ্বাস করে ইউক্রেনের মানুষ স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দিয়েছিল পরবর্তী পর্যায়ে তাদের স্বপ্নভঙ্গ হয় ঠিক যেমনটা ঘটেছিল রাশিয়ার সাধারণ মানুষের সাথে, যারা ভেবেছিল গণতন্ত্র এলেই, আমেরিকার সাথে বন্ধুত্ব হলেই তাদের দেশ আমেরিকার মত ধনী হবে, তাদের ঘরে ঘরে থাকবে বিদেশী গাড়ি, টিভি ইত্যাদি। যখন তারা বুঝতে পারল পুঁজিবাদে সব ধরণের আরাম আয়েশ আর ধন দৌলতের আগে আসে শোষণ তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। ইউক্রেনের মানুষও সেটাই ভেবেছিল। তার পরিবর্তে এল শোষণ আর সেটাকে ধরে রাখার জন্য এল চির পরিচিত ডিভাইড অ্যান্ড রুল। ফলে বহুজাতির দেশ ইউক্রেনে দেখা দিল জাতিগত বৈষম্য। রুশ, পোলিশ, হাঙ্গেরিয়ান, রোমানিয়ান, তাতার – এরা ইউক্রেনে আর আগের মর্যাদায় রইল না। ফলে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন এলাকায় অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। তাই আজকের এই যুদ্ধ আসলে শুরু হয়েছে সেই ১৯৯১ সালে – যখন ইউক্রেনের নব্য এলিট বহুজাতিক এই দেশকে একটা মনোলিট জাতিতে পরিণত করার প্রয়াস নেয়।

একটু খেয়াল করলেই দেখবেন কুর্দিরা নিজেদের দেশ না থাকা সত্বেও এবং চার চারটি দেশে বাস করা সত্বেও নিজেদের একজাতি বলে মনে করে। ভূগোল এখানে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি যেমনটি হয়নি বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইহুদিদের বেলায়। তাদের ধর্মের বাইরেও ছিল সাংস্কৃতিক মিল। এমনকি কয়েক প্রজন্ম ধরে ইংল্যান্ড আমেরিকায় থাকার পরেও অন্তত যারা নিজেদের মাতৃভাষায় কথা বলতে পারে তারা বাপদাদার দেশকেই নিজেদের দেশ বলে মনে করে, বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশ থেকে আসা লোকজন। কারণ আরবানাইজেশন আমাদের এখনও তেমনটা হয়নি। ঈদে, পূজায় বা ছুটিতে গ্রামমুখী মানুষের ঢল দেখলেই সেটা বোঝা যায়। আর একারণেই একাত্তরের পরাজিত শত্রুরা সেই পাকিস্তানি কায়দায় পাঠ্যপুস্তকের উপরে হাত দিয়েছে, চেষ্টা করে চলছে বাংলা থেকে বাঙ্গালীত্ব মুছে ফেলতে। ভাষা মানুষকে মানুষ করেছে, অন্য প্রাণী থেকে আলাদা করেছে। তাই ভাষার উপর, সংস্কৃতির উপর আঘাত হানার মধ্য দিয়ে শুরু হয় বিজাতীয়করণ। ফলে বাংলাদেশ ভৌগলিক সীমানা ধরে রাখতে পারলেও প্রতিনিয়ত হারাচ্ছে তার সাংস্কৃতিক সত্ত্বা। এভাবে চলতে থাকলে একদিন জাতি হিসেবে আমরা থাকব কি না সেটাই হবে বড় প্রশ্ন। আর এ জন্যেই দেশে যাতে দেশমুখী শিল্প সাহিত্য বিকাশ লাভ করে সে জন্যে সমাজ ও সরকার সবারই সচেষ্ট হওয়া একান্ত জরুরী। আজকাল একটা কথা প্রায়ই শুনি – রাশিয়া দনবাসকে ইউক্রেনের হাত থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করছে না, দনবাস রাশিয়াকে শেখাচ্ছে নিজের অস্তিত্বের জন্য ঘুরে দাঁড়াতে।  বিন্দু থেকে যেমন সিন্ধু জন্ম নেয় তেমনি করেও এই দনবাসেই জন্ম নিচ্ছে নতুন রাশিয়া।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো