মতামত

জাসদের আত্ম প্রকাশ যড়যন্ত্রের তত্ব: ১ম পর্ব

– অপু সারোয়ার

এক

বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র পন্থী ছাত্রলীগের যুদ্ধত্তোর বর্তমান ও ছাত্রত্বোত্তীর্ণ নেতৃবৃন্দ রাজনীতি করতে আগ্রহী ছিল । কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক অনুকল্য লাভ করতে ব্যর্থ হন। এই পরিস্থিতিতে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের প্রয়োজনীয়তায় জাসদের জন্ম। শেখ মুজিবের রাজনৈতিক বিরোধিতা জাসদের রণনীতি রণকৌশল গ্রহণে বড় ধরণের ভূমিকা রাখে। নব গঠিত জাসদ ছিল মননে – চেতনায় বিজয়ী জাতীয়তাবাদী কিন্তু আকাঙ্ক্ষার দিক থেকে সামাজিক সমতা প্রত্যাশী । বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী ছাত্রলীগ এবং পরবর্তীকালে গঠিত জাসদের নেতৃবৃন্দের উদ্দেশ্যবিধেয় যাই হয়ে থাকুক না কেন , বিষয়ে সন্দেহ নেই যে , ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের তরুণদের মধ্যে যারা অপেক্ষাকৃত সৎ এবং ত্যাগী ছিল , তাদের একটি বড় অংশ জাসদ এবং জাসদ প্রভাবিত অঙ্গ সংগঠন সমূহে যোগ দেয় ……জাসদ কর্তৃক মুজিব বিরোধী অবস্থান গ্রহণের পর  রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে সুবিধা প্রাপ্তির আশু সম্ভবনা থাকে না ….যারা বিপ্লবের জন্য অপেক্ষা এবং ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত ছিল , তারাই বেশি হারে জাসদে যোগ দেয়() – জাসদের সম্পর্কে এই মূল্যায়ন সিপিবি ঘরনার বুদ্ধিজীবী নজরুল ইসলামের । মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশের মানুষের মধ্যে বিশেষ করে যুবক শ্রেণীর চিন্তা চেতনার  পরিবর্তন ঘটে।  শুরুতে জাসদ ছিল শত ভাগ মুক্তিযোদ্ধার দল। মুক্তিযোদ্ধারা  জীবনকে বাজী রেখে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিল । স্বাভাবিক ভাবেই দেশ গঠনের অংশ নেওয়ার অধিকার তাঁদের ছিল।  মুক্তিযোদ্ধাদের বিপ্লবী সম্ভবনাকে কাজে লাগানোর জন্য সরকারের তেমন কোন কার্যকর কর্মসূচী ছিল না। অপর দিকে শেখ মুজিবর রহমান  মুক্তিযোদ্ধাদের ” কাজে ফেরত ” যাওয়ার আহ্ববান জানান। যুদ্ধত্তোর দেশে শেখ মুজিবর রহমান সরকারের যুব সমাজের উপলব্ধিকে অগ্রসর করার  উদাসীনতাকে জাসদ সংগঠিত হওয়ার জন্য কাজে লাগায়।

স্বাধীন বাংলাদেশে গণ জাগরণের জন্য ইসলাম পন্থী দল গুলির পক্ষে রাজনীতিতে জায়গা করা কঠিন ছিল।  যুদ্ধকালে চীনপন্থীদের বিভিন্ন উপদলের ধোঁয়াশে রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে রাজনীতির অঙ্গনে জায়গা করে নিতে পারে নাই।   প্রায় সব চীনপন্থী দল বাংলাদেশের পরিবর্তে  দলের নামে ‘ পূর্ববাংলা ‘ ব্যবহার করার কৌশল বেছে নিয়েছিল। পূর্ববাংলা নাম এই ধারার জন্য খুব বেশি সুবিধা বয়ে আনে নাই। এর বাইরে চীন পন্থীরা প্রায় সকলেই প্রকাশ্য গণসংগঠন গুটিয়ে ফেলেছিল। সাধারণভাবে এই সব সংগঠনে যোগ দিয়ে সাধারণ মিছিল মিটিং করার সুযোগ ছিল না। নকশাল পন্থীরা অর্থনীতিকে আধা সামান্তবাদী আখ্যা দিয়ে রাজনীতির কর্মকান্ড গ্রাম মুখী করে ফেলে। এই সব পরিবেশ চীন পন্থীদের বিকাশকে প্রায় গতিহীন করে ফেলেছিল।  মস্কো পন্থী সিপিবি-ছাত্র ইউনিয়ন চীন পন্থীদের সমস্যা মুক্ত ছিল।  মুক্তিযুদ্ধে সিপিবি-ছাত্র ইউনিয়ন অংশ নিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার মধ্য মস্কোপন্থী বাম শক্তি বিজয়ী হিসেবে আবির্ভুত হয়েছিল। তত্বগতভাবে সিপিবি অ-ধনবাদী ধারায় সমাজতন্ত্রে পৌঁছানোর জন্য প্রচলিত ধারার রাজনৈতিক দলের অংশ গ্রহনে ক্রমান্বয়ে শ্রমিক – কৃষক শ্রেণীর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার তত্বে আস্থাশীল ছিল। সাময়িকভাবে মস্কোপন্থীদের রাজনৈতিক পথ কাজে লাগে। ১৯৭২ সালে সারা দেশের কলেজ বিশবিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়ন ব্যাপক ভাবে বিজয়ী হয়েছিল। স্বাধীনতার পর  শেখ মুজিবর রহমান সরকারের পরিকল্পিত ইতিবাচক কর্মসূচীর প্রচন্ড ঘাটতি ছিল। ১৯৭৩ সালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলির ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নের ফলাফল খুব বেশী সুবিধাজনক ছিল না। সরকারের ব্যর্থতার ন্যায্য সমালোচনা থেকে  সিপিবি-ছাত্র ইউনিয়ন নীরব থাকতে শুরু করে। মস্কোপন্থীদের শেখ মুজিব সরকারের সব কিছুতে সমর্থন বা নীরবতায়  রাজনীতিতে বিরোধী দলের শূন্যতা দেখা দেয়। এই শূন্যতাই জাসদের উথানের পথ তৈরী করে দেয়।

ডিসেম্বর ১৯৭২ সালের জাসদের কেন্দ্রীয় আহবায়ক কমিটির বক্তব্যে যুদ্ধত্তোর মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়টি উঠে আসে। ” মুক্তিযোদ্ধা আজ অবহেলিতক্ষমতার আসনে বসে ক্ষমতাসীন দল ভুলে গেছে তাদের যুদ্ধকালীন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোন সুষ্ঠ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি সমাজের এক উচ্ছিস্ট অংশের মতে দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে এই মুক্তিযোদ্ধার দল() যুদ্ধত্তোরকালে মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন সংকট নিয়ে বক্তব্য সামনে আনার পাশাপাশি আওয়ামী লীগ শেখ মুজিবর রহমানের কঠিনতম সমালোচনার মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে জাসদ। আওয়ামী লীগ সরকার মুখে বলছে আইনের শাসন , কিন্তু কার্যত দেশে চালু হয়েছে এক ব্যক্তির শাসন প্রশাসন অন্যান্য ক্ষেত্রে ব্যক্তি পূজার মাত্ৰা মধ্যযুগের নৃপতিদেরও ছাড়িয়ে গেছে ….গণতন্ত্রের নামাবলি গায়ে দিয়ে চলছে ব্যাক্তিপূজার মহোৎসবযার আশ্রয় হচ্ছে ফ্যাসিবাদ () মুক্তিযোদ্ধদের সমর্থন ও শেখ মুজিবর রহমানের রাষ্ট্র শাসনের অদক্ষতার স্পষ্ট বিরোধিতা জাসদকে আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে নিয়ে আসে।

জাসদের উত্থান উল্কার মত। জাসদের উত্থানের পিছনে অনেকেই যড়যন্ত্রের গন্ধ খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেন । জাসদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি ষড়যন্ত্র তত্ব রয়েছে। এই সব তত্ব বহুল আলোচিত ছিল তুলনামূলক ভাবে কম বিশ্লেষিত। । তবে এই সব গুজব – ষড়যন্ত্র তত্ব নিয়ে তেমন কিছু লেখা হয়  নাই।  এই বিতর্কে যা কিছু লিখিত হয়েছে সেগুলি জনশ্রুতি, অসংহত যুক্তি ও অনৈতিহাসিকতার পল্লবিত রূপ। এই গুজবের অন্যতম হচ্ছে  – সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে সম্ভাব্য বাম  আন্দোলনের উত্থান ঠেকাতে জাসদের মতো একটা বাম দল গঠন করা হয়েছিল। এখানে সম্ভাব্য পরিকল্পকদের মধ্যে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা  ‘র’কে ধরা হয় ।  এই তত্বের সুবিধা জনক দিক হচ্ছে বিএলএফ – মুজিব বাহিনীর বড় অংশ  জাসদের সাথে যুক্ত থাকা। ভারতীয় সমরবিদ জেনারেল উবান ছিলেন বিএলএফ – মুজিব বাহিনীর  প্রধান সিদ্ধিদাতা এবং  ভারত সরকার ও বিএলএফ – মুজিব বাহিনীর প্রধান সংযোজক কারী। যদিও মুজিব বাহিনীর যৌথ কমান্ডার চার জনের একজন সিরাজুল আলম খান জাসদ রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়েছিলেন। ()    জাসদের প্রধান তাত্বিক ও ‘নেপথ্যের ‘ পরিচালক সিরাজুল আলম খান ছিলেন। । ইদানিং কালে জাসদ রাজনীতির ব্যার্থতার দায় দায়িত্ব থেকে  দূরে রাখার জন্য সিরাজুল আলম খান নিজেকে ‘অদলীয়’ হিসাবে উপস্থাপন করে আসছেন।()

দুই

বাংলাদেশের যুদ্ধকালীন সময়ে পশ্চিম বাংলায় নকশাল আন্দোলন তুঙ্গে ছিল। নকশাল আন্দোলন ইন্দিরা গান্ধীর সরকারের জন্য ছিল অস্বস্তিকর ছিল। ভারতীয় রাষ্ট্র যন্ত্র মুক্তিযুদ্ধের অস্ত্র ও ট্রেনিং নকশাল আন্দোলনকে পরিপুষ্ট না করতে পারে সে জন্য সর্বাত্মক ভাবে প্রস্তুত ছিল। এই প্রকল্পের অংশ হিসেবে যুদ্ধ কালীন সময়ে মুজিব বাহিনীর প্রশিক্ষণের সময় ভারতীয় সেনা প্রশিক্ষকরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে একই সাথে পাকিস্থানী ও কমিউনিস্ট মোকাবেলার ছবক দিয়েছিল। মুজিব বাহিনীর অন্যতম প্রশিক্ষক আ ফ ম মাহবুবুল হক অভিজ্ঞতা ”  বিএলএফের প্রথম ব্যাচ হিসেবে আমাদের সামনে বক্তব্য তুলে ধরা হলো১৯৬২ সালের চীনভারত যুদ্ধের পর্যুদস্ত অবস্থা থেকে উন্নীত হয়ে ভারত এই অঞ্চলের সামরিক শক্তি হিসেবে আস্থা যোগ্য অবস্থায় এসে পুনরায় দাঁড়িয়েছে সুতরাং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ বিজয়ের দিকে নিয়ে যাওয়া  তার [ ভারত ] জন্য অসুবিধা জনক নয় আমরা যারা প্রশিক্ষণে অংশ গ্রহণ করছি , তাদের যেমন পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করতে হবে , তেমনি কমিউনিস্টদের মোকাবেলা করতে হবে ()   সম্ভবত এই জাতীয় কিছু বিষয় জাসদ কমিউনিস্ট বিরোধী এই তত্বের জ্বালানী হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকবে।

মুজিব বাহিনী ও জাসদ ছিল যুদ্ধ পূর্ব কালে অবিভক্ত ছাত্রলীগের অগ্রগামী ও সক্রিয় অংশ। ছাত্র রাজনীতির আধিপত্য নিয়ে তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়নের উভয় গ্ৰুপের সাথে ছাত্রলীগের রেষারেষি ছিল নিত্য দিনের ঘটনা। এই রেষারেষির মাত্রা বেড়ে যায় নকশাল আন্দোলনের সূচনাতে। নকশাল আন্দোলনের শ্রেণী শত্রু খতমের খাতায় আওয়ামী লীগ ঘরনার মানুষদের নাম উঠে আসে। নকশাল পন্থীদের হাতে যুদ্ধত্তোর কালে কত জন আওয়ামী ঘরনার মানুষ খুন হয়েছিল তা নিয়ে নির্ভরযোগ্য গবেষণা নেই। তবে নকশাল আন্দোলন ছিল আঞ্চলিক। বৃহত্তর যশোর – খুলনা , পাবনা , রাজশাহীর বিভিন্ন অঞ্চলে এই আন্দোলন দানা বেঁধে ছিল।  নকশালীদের হাতে খুন  প্রতিহিংসার জন্ম দেয়। এই প্রতিহিংসার আগুন যুদ্ধ ও যুদ্ধত্তোর কালে ভয়াবহ রূপ নিয়েছিল। রাজনৈতিক পালা বদলের সাথে খুনাখুনি কমে আসে। যুদ্ধকালীন সময়ে বিভিন্ন স্রোতের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে চীনপন্থী কমিউনিস্টদের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষকে যুদ্ধ পূর্ব কালের সংঘর্ষের ধারাবাহিকতা হিসেবে দেখার অসমর্থতা বিএলএফ ও জাসদ বিরোধী জনশ্রতি ও যড়যন্ত্র তত্বের জ্বালানী মাত্র।

নকশাল আন্দোলনের পর অঞ্চল বিশেষে ছাত্রলীগ ও চীনপন্থী ছাত্র ইউনিয়নের মধ্যে রোষারেষি , হাতাহাতি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের দিকে এগুতে থাকে। ১৯৭০-১৯৭১ সালের শুরুর দিকে  কোথায় কোথায় এই জাতীয় সংঘর্ষ খুনাখুনিতে পরিনিত হতে থাকে। নকশাল পন্থীরা আদর্শিক ভাবে সশস্র সংগ্রামের চেতনায় উৎজীবিত ছিল। শুরুতে নকশাল পন্থীরা বিভেদ খুনাখুনিতে নিজেদের অবস্থান পোক্ত রাখতে পেরেছিল। ২৫শে মার্চ ১৯৭১ সালের পাকিস্তানী আক্রমণের পর তৎকালীন ছাত্রলীগ নিজেদেরকে সশস্র করতে থাকে। সশস্র রেষারেষি নতুন মাত্রা পায়। রাজনৈতিক সমঝোতার পথ চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়।  আওয়ামীলীগ এর পাশাপাশি মস্কোপন্থী ন্যাপ – ছাত্র ইউনিয়ন নকশাল পন্থীদের আক্রোশের শিকার হয়েছিল। পাবনা জেলা ন্যাপ ( মোজাফ্ফর ) সভাপতি সাইফুল ইসলামের লেখা থেকে জানতে পারি এলাকায় যুদ্ধ শুধু পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে ছিল না ছিল বাঙালী অবাঙালী সংঘাত ছিল স্বাধীনতা স্বপক্ষবিপক্ষ রাজনৈতিক দল গুলোর মধ্যে অঘোষিত লড়াই চরম বামেরা শ্রেণী শত্রু নিধন যজ্ঞে আমাদের তালিকা ভুক্ত করেছিল ডানদের প্রচারের স্রোতধারা অব্যাহত ছিল ….. স্বাধীনতার স্বপক্ষের দল গুলোর মধ্যে ছিল বৈরিতা () নকশাল পন্থীদের ‘ পোস্টার রয় ‘ নামী -দামী নেতাদের উৎপত্তি স্থল সেই এলাকা গুলিতে সশস্রতার মাত্রা বেশি ছিল। বৃহত্তর যশোর ও পাবনা জেলা ‘ নকশাল পোস্টার রয় ‘ দের অবস্থান ছিল। পাবনায় টিপু বিশ্বাস – আলাউদ্দিন – আব্দুল মতিনরা পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির পতাকা নিয়ে সক্রিয় ছিল। যশোরে আব্দুল হক ১৯৭৮ সাল অবধি পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি নামে সক্রিয় ছিল।

আহমেদ রফিক  ১৯৭০ সালের নিবাচনে পাবনার সাঁথিয়া- বেড়া থেকে নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য  ছিলেন। নির্বাচনে জয়লাভের পাঁচদিন পর ২২ ডিসেম্বর সন্ধ্যার পর পাবনা শহরে নিজ বাড়ির সামনে নক্সালপন্থীদের  ছুরিকাঘাতে আহমেদ রফিককে নিহত হন।  এই হত্যাকান্ডের পর পাবনায় নক্সালদের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়।  হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ ও শোক সভায় শেখ মুজিবুর রহমান ২৫ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে পাবনায় আসনে। ১৯৭১ সালে খুনের আগেও আহমেদ রফিক নকশাল পন্থীদের হামলার শিকার হয়েছিল। ১৯৭০ সালের মাঝামাঝি পাবনা টাউন হলে আওয়ামী লীগের জনসভায় নক্সালপন্থী ছাত্র ইউনিয়নের সশস্ত্র হামলায় আহমেদ রফিককে মারাত্মকভাবে  ছুরিকাঘাত হয়েছিলেন। পুরানো রাজশাহী বিভাগের বিভিন্ন অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন স্রোতের সাথে নকশাল পন্থীদের হানাহানির প্রাথমিক যোগসূত্র পাবনার আহমেদ রফিক খুন। যুদ্ধকালীন সময়ে পাবনা শহরে নকশাল পন্থীদের সশস্র রাজনৈতিক অবস্থান আলোচনার দাবী রাখে। মুক্তিযুদ্ধের শেষ নাগাদ, মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন স্রোত ( এফ , বিএলএফ , স্থানীয় ভাবে প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধারা ) পাবনার শানির দিয়ারে নকশালদের ঘাঁটি আক্রমণ এলাকা ছাড়তে বাধ্য করেছিল। যুদ্ধের মধ্যে একটি উপ যুদ্ধ ছিল পাবনার শানির দিয়ারের যুদ্ধ। যুদ্ধে উভয় পক্ষেই হতাহত হয়েছিল। তিন জন মুক্তিযোদ্ধা নিহত হয়েছিলেন এই যুদ্ধে। শানির দিয়ারের যুদ্ধ – যুদ্ধের মধ্যে উপযুদ্ধকে বামপন্থী নিধন হিসেবে দেখার সুযোগ থেকে যায়। যদি শুরু থেকে শেষ শুধু মাত্র শানির দিয়ারের উপযুদ্ধকে পৃথক ভাবে দেখা হয়। আর যদি শানির দিয়ারের উপযুদ্ধকে ১৯৭০ সালের ডিসেম্বররের আহমেদ রফিকের হত্যা, যুদ্ধকালীন সময়ে পাবনা শহরে নকশাল পন্থীদের তৎপরতার সাথে মিলিয়ে দেখা হয় তবে উপসংহার পুরোপুরি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হয়।

বিএলএফের প্রথম ব্যাচের প্রশিক্ষণের পর ভারতীয় রাষ্ট্র বিএলএফ ক্যাম্প পরিচালনার দায়িত্ব প্রশিক্ষিন প্রাপ্তদের হাতে ছেড়ে দিয়েছিল। বিএলএফ ক্যাম্প অনেকটা ‘ আধা স্বায়ত্ব শাসিত ‘ প্রতিষ্ঠান হিসেবে চলতে থাকে। যদিও চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ ভারতীয় রাষ্ট্র যন্ত্রের হাতেই থেকে যায়। বিএলএফ ক্যাম্পে ভারতীয় প্রশিক্ষকদের কমিউনিস্ট বিরোধী ছবক – মন্ত্রণা খুব বেশী কর্যকর হয় নাই। আ ফ ম মাহবুবুল হকের বর্ণনায় বিষয়টি উঠে এসেছে আমরা স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলাম বিধায় চতুর্দশপঞ্চদশ ব্যাচ পর্যন্ত যারা ভারতীয় প্রশিক্ষক আমাদের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ নিয়েছিল তারা মূলত আমাদের মতাদর্শ দ্বারাই প্রচলিত হয়েছিল আমাদের তখন পাঠ্য ছিল চে গুভেয়ার , নগুয়েন গিয়াপ , মোঃ সেতুংয়ের গেরিলা যুদ্ধের ওপর লিখিত বক্তব্য সুমুহ এই সব গেরিলা মিলিটারি স্ট্রাটেজিস্টদের বক্তব্য আমাদের মতাদর্শের কাজকে ত্বরান্তিত করতে সহায়তা করেছে () বিএলএফ- মুজিব বাহিনীর প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের নজরদারী অব্যাহত ছিল। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সবসময়ই রাজনৈতিক আলোচনাকে নিরুৎসাহিত ও অবদমন করতে সক্রিয় ছিল। “আমাদের রাজনৈতিকআদর্শিক বিষয়বস্তু একপর্যায়ে ভারতীয় সামরিক প্রশিক্ষকদের গোচরীভূত হয় আমাদের প্রশিক্ষকদের সবাইকে ডেকে নিয়ে আসেম্বলী হলে একত্র করা হলো জিজ্ঞাসা করা হলো, বিএলএফের যোদ্ধাদের নাকি কমিউনিস্ট বানানো হচ্ছেযা কেন্দ্রীয় ভারত সরকারের নীতি বিরুদ্ধ()

বাপমন্থীরা পাকিস্তান পর্বে (১৯৪৭-১৯৭১ সাল ) রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন উপেক্ষা করে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্ব শাসনের  দাবী তুলেছিল। ১৯৬০ এর দশকে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট দ্বন্ধে প্রথমে কমিউনিস্ট পার্টির বিভক্ত ঘটে। বামপন্থীরা  সমাজতন্ত্রের শিবিরের আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্ব – বিপ্লব- সংশোধনবাদ ইত্যাকার বিষয় নিয়ে  মশগুল  হয়ে পড়ে। উপেক্ষিত হয়  জাতিগত নিপীড়ন ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিষয় গুলো ।  আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্ব নিয়ে মশগুলতা দেশীয় সমস্যা থেকে বামপন্থীদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। এই শুন্যতায় ৬ দফা , ‘সোনার বাংলা শ্বশান কেন ‘ ‘ জয়বাংলা’ স্লোগানে দেশকে সয়লাব করে ফেলে আওয়ামীলীগ। পরবর্তীতে বামপন্থীরা ১১ দফার মাধ্যমে শূন্যতা পূরণের চেষ্টা করেও রাজনীতিতে জায়গা ফিরে পায় নাই। যুদ্ধ পূর্ব কালে চীন পন্থী কমিউনিস্ট পার্টি আধা ডজন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই বিভক্তির কারণে চীনপন্থী কমিউনিস্ট গ্ৰুপ গুলি আঞ্চলিক দল হিসেবে পরিগণিত হয়। একেক অঞ্চলে একেক উপদলের প্রভাব বলয় গড়ে উঠে। এর বাইরে চীন পন্থী কোন গ্ৰুপের বিভ্রান্তকারী অবস্থান বিকল্প বামপন্থী দল হিসেবে জাসদের উত্থানকে সহজ করে তোলে।

 

তথ্যসূত্র

(১) পৃষ্ঠা ৪০-৪১। আগামী দিনের বাংলাদেশ ও জাসদের রাজনীতি – লেখক নজরুল ইসলাম। প্রকাশ কাল: এপ্রিল ২০১৩।

(২) জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের প্রথম কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্মেলন –  আহবায়ক কমিটির বক্তব্য। ২৩ ডিসেম্বর ১৯৭২।

(৩) পূর্বোক্ত

() মুজিব বাহিনীর যৌথ কমান্ড: (১) শেখ ফজলুল হক মনি (২) সিরাজুল আলম খান (৩) আব্দুর রাজ্জাক (৪) তোফায়েল আহমেদ

(৫) আমি সিরাজুল আলম খান -একটি রাজনৈতিক জীবনালেখ্য:  অনুলিখন শামসুদ্দিন পেয়ারা। পৃষ্ঠা-১৬৮

(৬) বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীদের ভূমিকা, সম্পাদনা মেসবাহ কামাল, গনপ্রকাশনী, ২০০১। পৃষ্ঠা ২৬২-২৬৩.

(৭) পৃষ্ঠা ২৭। স্বাধীনতা ভাসানী ভারত – সাইফুল ইসলাম। প্রকাশক: বর্তমান সময়। পঞ্চম প্রকাশ: ২০০৫। সাইফুল ইসলাম ১৯৭০ ও ১৯৭৩ সালের ন্যাপ (মস্কোপন্থী) এর প্রার্থী হিসেবে সিরাজগঞ্জ সদর আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। যুদ্ধ কালীন সময়ে পাবনা জেলা ন্যাপের সভাপতি ও সিরাজগঞ্জ মহকুমার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭১ সালের মওলানা ভাসানীর ভারত প্রবাস কালে ‘খোলদ্বার কারাগার ‘ভাসানীর রাজনৈতিক সচিব হিসেবে কাজ করেন।

(৮) পৃষ্ঠা ২৬৪। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীদের ভূমিকা, সম্পাদক মেসবাহ কামাল। গনপ্রকাশনী, ২০০১। ঢাকা।

(৯) পূর্বোক্ত

 

দ্বিতীয় পর্ব: “সিরাজুল আলম খান ও শেখ মুজিবের আঁতাত” প্রকাশিত হবে আগামী ১৭ নভেম্বর ‘২২

তৃতীয় পর্ব: “যুদ্ধত্তোর বাংলাদেশে মস্কো ও চীন পন্থী কমিউনিস্টদের উত্থানের সম্ভবনা কত টুকু বাস্তব দাবী?” প্রকাশিত হবে আগামী ২৪ নভেম্বর ‘২২

অপু সারোয়ারঃ ফ্রি ল্যান্স লেখক