চলমান সংবাদ

সুবর্ণচরে নারীরা অসহায় আর ধর্ষকরা অপ্রতিরোধ্য

সুবর্ণচরের পশ্চিম চরমজিদ এলাকার আশ্রয়ণ প্রকল্পে বরিবার রাতে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। পুলিশ  এপর্যন্ত দুইজনকে গ্রেপ্তার করেছে। ধর্ষণের শিকার কিশোরীকে জেলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

সুবর্ণচর প্রথম আলোচনায় আসে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর৷ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ধানের শীষে ভোট দেয়ায় ওই দিন রাতে চর জুবিলি এলাকায় এক নারীকে ধর্ষণ করা হয়। এর মাত্র তিন মাস পরই উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আবারো সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটে।

গত ২৬ অক্টোবর সুবর্ণচরে এক রোহিঙ্গা কিশোরীকে চার মাস মোহাম্মদপুর ইউনিয়নে আটকে রেখে ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া যায়। তাকে উদ্ধার করা হলেও কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। তাকে বিয়ের কথা বলে আনা হয়েছিল। গত ৭ আগস্ট সুবর্ণচর সদরে ছয় বছরের একটি শিশুও ধর্ষণের শিকার হয় বলে অভিযোগ রয়েছে৷

পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যাকশন নেটওয়ার্ক (রিন) নামে একটি স্থানীয় এনজিও সুবর্ণ চরের ধর্ষণ নিয়ে কয়েক বছর ধরে কাজ করছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী নুরুল আলম মাসুদ বলেন, “দেশের অন্য যে কোনো এলাকার চেয়ে সুবর্ণচরে ধর্ষণের সংখ্যা বেশি। কিন্তু অধিকাংশ ঘটনায়ই থানায় মামলা হয় না।” তিনি বলেন,” সুবর্ণচরের বেশিরভাগ মানুষ ভূমিহীন। এখানে অনেক খাস জমি আছে। দরিদ্রদের ওই খাস জমি দখলে রাখতে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অনেক সন্ত্রাসী গ্রুপ তৈরি হয়েছে। তারা জমির দখল নিতে প্রতিপক্ষকে দুর্বল করতে নারীদের টার্গেট করে। ধর্ষণ করে। কারণ, ভূমিহীনরা ওই খাস জমিতে থাকে। আবার ভোটের সময় ভয় সৃষ্টির জন্য নারীদের টার্গেট করা হয়।”

নুরুল আলম মাসুদ বলেন, এমন অভিযোগও রয়েছে যে কোনো নারী ধর্ষণের শিকার হয়ে চেয়ারম্যানের কাছে গেছেন, কিন্তু বিচার না করে তাকে উল্টো বেঁধে রাখা হয়েছে। জনপ্রতিনিধিরা সালিশের নামে অনেক ঘটনাই ধামাচাপা দেয়।

তিনি বলেন, “চর মজিদে সর্বশেষ যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে সেটা সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পে। ওই এলাকা সন্ত্রাসী হোসেন বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। তাদের আবার রাজনৈতিক গডফাদার আছে। ওই সন্ত্রাসী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আবার আশ্রয়ণ প্রকল্পের সব পুকুর । এটা স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের ছত্রছায়ায়ই হচ্ছে।”

তার কথা, “স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনও তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয় না। যেগুলো আলোচনায় আসে, তারা সেগুলো নিয়ে তৎপর হয়।”

নোয়াখালী নারী অধিকার জোটের সভাপতি লায়লা পরভীন বলেন, “সুবর্ণচরে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা বেশি। এর সঙ্গে জমিজমা ও স্বার্থের বিষয় আছে। তাদের জন প্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতারা শেল্টার দেয়। ওই সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো কোনো না কোনো প্রভাবশালী গ্রুপের আশ্রয়ে থাকে, ফলে বিচার হয় না। মিমাংসা করে দেয়া হয়। গত কয়েক মাসে বেশ কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনা ধামাচাপা দেয়া হয়েছে।”

তার কথা, “সাংবাদিকরা এই বিষয়গুলো প্রকাশ করতে গেলে তারাও হয়রানির মুখে পড়েন। বেশ কয়েকজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলাও করা হয়েছে। আর যারা ধর্ষণের শিকার হন, তারা দরিদ্র। তারাও প্রভাবশালীদের কথার বাইরে যেতে পারেন না।”

তিনি বলেন, “যদি মামলা হয়ও তারপরও সাক্ষীদের হয় ভয় দেখিয়ে, নয় হুমকি দিয়ে থামিয়ে দেয়া হয়। আর বাদিও শেষ পর্যন্ত এগোতে পারেন না। ফলে বিচার হয় না।”

স্থানীয় সাংবাদিক আবদুল বারি বাবলু বলেন, সূবর্ণচরের আটটি ইউনিয়নের প্রায় সবাই কৃষিজীবী। তবে অধিকাংশেরই জমি নাই। তারা প্রভাশালীদের জমি বা খাস জমি চাষ করেন। পুরুষরা বছরের ছয় মাসই উপজেলার বাইরে থাকেন কাজের খোঁজে। কেউ অন্য এলাকার ইটভাটায় কাজ করেন। আবার কেউ শহরে রিকশা চালান। ফলে নারীরা অধিকাংশ সময় একা থাকেন। ধর্ষকরা এর সুযোগ নেয়। তবে তার কথা, “এখানে ধর্ষণ মামলার পিছনে রাজনীতিও আছে। আবার ধর্ষণের পিছনেও আছে রাজনীতি। বছরে পর বছর ধরে এই অবস্থা চলছে।”

সুবর্ণচর উপজেলার থানা হলো চর জব্বার। থানার ইন্সপেক্টর( তদন্ত) জয়নাল আবেদিন জানান, রোববারের সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় জড়িত সন্দেহে দুইজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং কিশোরীর জবানবন্দি নেয়া হয়েছে। মেয়েটির মেডিকেল টেস্টও করানো হয়েছে। অন্য আসামিদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি বলেন, “হোসেন বাহিনীর হোসেন প্রভাবশালী হলেও তাকে আমরা গ্রেপ্তার করবো।”

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “গত মাসে কোনো ধর্ষণের মামলা হয়নি। এই মাসে হলো। তবে প্রতি মাসেই দুই-তিনটি ঘটনার খবর আমরা পাই। মামলা হলে আমরা পদক্ষেপ নিই।”

সুবর্ণ চরে ধর্ষণের ঘটনা দেশের অন্য এলাকার চেয়ে বেশি জানিয়ে তিনি বলেন, “এই এলাকায় জমিজমা নিয়ে অনেক দ্বন্দ্ব, অনেক সমস্যা। এছাড়া নানা ধরনের বিরোধও আছে। এসবের শিকার হন নারীরা।” তবে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতেও কখনো কখনো ধর্ষণের মামলা হয় বলে তিনি দাবি করেন।

সূত্রঃ ডয়চে ভেলে