মতামত

 বিচ্ছিন্ন ভাবনা

-ডা. গৌতম দত্ত

-১-

পাইতে পারছি না এবং বাচ্চা কুত্তার গল্প

অসাবধানে নিতে গিয়ে টিভি সেটের ওপরে রাখা রিমোটটা পড়ে গেল টিভি আর দেয়ালের মাঝখানে চাপা জায়গায়। মিনিটকতক সেটা উদ্ধার করার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে ছয় বছরের অভি হতাশ হয়ে তার মা’কে বললো, ‘ মা, আমি পাইতে পারছি না! অর্থাৎ বলতে চাইছে ‘I can’t reach it!’ দেশান্তরে বড় হওয়া সন্তান বাংলা বলুক মা তাই চান, সন্তানও চেষ্টা করছে। আরেকদিন, জন্মদিনে কী উপহার চাই জিজ্ঞেস করায় অভি বললো, ‘কুত্তার বাচ্চা!’ মা, শুধরে দিলেন, ‘কুত্তার বাচ্চা না বাবা, বাচ্চা কুত্তা বলতে পার’। এই চিত্রে একরকম নিষ্পাপ নির্মলতা আছে। নয় কি? তবে খোদ বঙ্গভূমে পড়ালেখা করে কেও অমন ধারা চলতে দেখলে হতাশই লাগে! সেখানে , বাংলা ভালো না বলতে পারা বা শুদ্ধভাবে না লিখতে পারাটা ইংরেজি ভালো জানার সমার্থক ভাববার করুণ বাস্তবতা তৈরী হয়েছে। ইংরেজি বানান ভুল মর্যাদাহানী করে, বাংলা ভুল হলে কিছু এসে যায় না। এই নৈরাজ্য আরও উৎকট হচ্ছে বলে মনে হয় ‘প্রমিত বাংলা অভিধান’-এর অতিসাম্প্রতিক কাটা-ছাঁটায়! স্কুলগুলোয় কোন বানানরীতি অনুসরণ করছে কে জানে! সময়ের পরিক্রমায় ভাষা বদলায় , তবে অভিধানগুলো ধরে রাখবে অতীতটাও , এমনটাই হওয়া দরকার নয় কি? ভাষাসমৃদ্ধি ধরে না রাখলে নিজেদের ইতিহাস-সংস্কৃতির নাগালটাও হয়তো একসময় আর ‘পাইতে পারবো না!’ সবকিছু কি দখলে যাবে ‘বাচ্চা কুত্তার’, এই আতঙ্কে আছি!

-২-

সত্য কেন বান্দর?

পুরনো ঢাকার বানর অধ্যুষিত এলাকায় কেটেছে আমার ছেলেবেলার একটা বড় অংশ। বানরের ভ্যাংচি কাটা থেকে শুরু করে নানারকম উৎপাত সয়েছি। বস বা নেতা বান্দরের দাবড়ানি খাওয়া, বানর ছানা জানালা গলে ঢুকে ঘরে আটকে পড়ায় পুরো বাড়ি বান্দরবাহিনী দিয়ে ঘেরাও হওয়া , রান্নাঘর থেকে লবণের পোটলা ( বা অন্যান্য জিনিস) নিয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়া মায়ের মুখ, রান্নায় বিলম্ব এমনই আরও নানা ঘরাণার উৎপাত। সত্য অমনই উৎপাত করে কখনও কখনও! ভেঙচি কেটে বোঝায় আমাদের ভণ্ডামী বা লুকনো অসুন্দর, কেড়ে নেয় আত্মতৃপ্তির লবণ! নির্বিচারে নির্লিপ্ততায় প্রকৃতির বন্দনাগীত করতে করতে আমরা প্রকৃতি ধ্বংস করি, জীবে প্রেমের কথা বলতে বলতে অন্য প্রাণীর দেহ ভক্ষণ করি, পুঁজির একচেটিয়াবাদ ( মনোপলি) মন্দ বুঝেও দু’আনা কমে পাবো বিধায় আমাজনের পণ্য কিনি, মানুষের সাম্যতার বুলি আওড়ে বৈষম্য প্রক্রিয়ায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমর্থন দিই , বিজ্ঞান বা যৌক্তিক চিন্তার অনুসারী দাবী করেও অযৌক্তিক বিশ্বাস আঁকড়ে থাকি, প্রচার করি … এমনই আরও বহু সত্য আমাদের ভেঙচি কাটে, তুলে ধরে আমাদের অসুন্দর, বুঝায় মানুষ নিজেরে যত বড় মহান ভাবে তা সে নয়, আমাদের আত্মতৃপ্তির লবণ চুরি হয়ে যায়! আমি মনে করি সত্য স্থিত কিছু নয়। সত্য বদলায়। মানুষের অর্জিত জ্ঞান আর বোধের বিবর্তন হয়। বহুযুগের লালিত সত্যকল্পনা হঠাৎ বদলে যেতে পারে।এই বদলানোর প্রক্রিয়া পাখির ওড়ার মতো স্থিত নয় বরং বানরের উল্লম্ফনের মতো আচমকা আনপ্রেডিক্টেবল! ‘সত্য বড় বান্দর’ এই শিরোনামে আমার আগের পোস্টটার প্রতিক্রিয়ায় সত্যকে কেন বান্দর বলছি, জানতে চেয়েছেন দুয়েকজন। তাই এই বাঁদরামিমূলক কথাগুলো বলা। তাছাড়া শব্দ বা ভাবনা নিয়ে বাঁদরামি করা আমার বদভ্যাস। আমি কবিতা বিশেষজ্ঞ নই মোটেও, এমনকি ঐ লেখাকে কবিতা বলেও দাবী করি না। আমি ঘরে বসে ঘরের দেয়াল দেখি, জানালা দিয়ে ঘরের বাইরে যতদূর দেখা যায় দেখি, যা দেখি আর যে ঘরে বসবাস তার অনুভবই এ লেখায় প্রকাশিত। প্রবন্ধের দায় থাকে সব খোলাসা করে বলবার। কবিতা রহস্য রাখে কিছু। হাত ধরে ভাবনার প্রাঙ্গণে নিয়ে এসে কবিতা আপনাকে ছেড়ে দেবে, আপনিই ভাবুন। ভাবনার বাইরে শব্দগত ব্যুৎপত্তি / প্রয়োগ নিয়ে যদি জিজ্ঞাসা থাকে , তবে বলতে পারি , বান্দর বা বাঁদর নানা গুণগত অর্থেই ব্যবহৃত হয়। আভিধানিক কিছু নমুনা: বাঁদর, বানর, বান্দর এর অর্থ → [বাঁদোর্‌, বানোর্‌, বান্‌দোর্‌] (বিশেষ্য) মর্কট; কপি; শাখমৃগ > বাঁদর নাচ (বিশেষ্য) বাঁদরের নাচের মতো উৎকট নাচ; নাজেহাল অবস্থা; দুর্ভোগ (বিশ্বসংসার আমাকে বাঁদর নাচ না নাচিয়ে ছাড়বে না-সৈয়দ মুজতবা আলী)। বাঁদরমুখো (বিশেষণ) বাঁদরের মতো বিশ্রী মুখবিশিষ্ট। বাঁদরামি, বাঁদরামো (বিশেষ্য) শয়তানি; বানরপ্রকৃতি সুলভ আচরণ; বানরের মতো বিকট দুষ্টামি(প্রকৃত বাঁদুরে হাঙ্গামে বাজারে নানারকম গান উঠলো- কালীপ্রসন্ন সিংহ)। বাঁদুরে বুদ্ধি (বিশেষণ) বানরের মতো দুষ্টামি বুদ্ধি (বাঁদুরে বুদ্ধি খুব আছে)

-৩-

প্রবাদ প্রবচন বানীর কুপ্রভাব প্রসঙ্গে ছাত্রজীবন থেকেই দেশীয় প্রবাদ

-প্রবচন-বানী চরিত্রের উদ্ধৃতিগুলোর অধিকাংশই আমার বেশী সুবিধার মনে হতো না। আর এখন লাগে চরম বিরক্তিকর! একটা সীমিত ফ্রেমে আটকে ভাব সম্প্রসারণ করার ছাত্রকালীন যন্ত্রণা এখন পোহাতে হয় না। তবুও বিরক্তি আসে এজন্যই যে এসবের অধিকাংশকেই সত্য আড়ালের এবং গণমানুষকে নিম্নবোধবিশিষ্ট ধরে নিয়ে পিঠ চাপড়ানোর একপ্রকার প্রয়াস (সচেতন বা অচেতন) বলে মনে হয়! মানুষের মতো জটিল সামাজিক প্রাণী তো দূরের কথা, এমনকি জীব-জন্তু নিয়ে বলা চিরায়ত ভাবনা প্রবাদ-প্রবচনগুলোও প্রায়ই ভুলভাল! সীমিত ফ্রেম বা পরিসীমা উল্লেখ করছি এজন্য যে, প্রবাদ প্রবচনের বিষয়গুলোর সংজ্ঞা অতিবিস্তৃত এবং বহুমুখী হতে পারে , কাজেই একমুখী সিদ্ধান্তগুলো ভুলভাবে ব্যবহার হতে পারে। এখন ফেসবুক খুললেই মানুষের ভাবনা অনুভূতি নিয়ে আপ্তবাক্য আওড়ানোর যে জোয়ার দেখি, তা বোধ হয় ঐসকল বচন-প্রবচন-বানীনির্ভর মানসিকতারই ফসল! অনুসন্ধান নেই, জিজ্ঞাসা নেই, এমনকি অবিশ্বাসগুলোও বিশ্বাস-নির্ভর! “অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী” – এখানে বিদ্যা বলতে কী বোঝানো হচ্ছে? প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা? বেশীবিদ্যাওয়ালা কারা? প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যা কম যাদের, তাদের মতামত উপেক্ষার প্রেক্ষিত রয়েছে কি এখানে? আর বৃহত্তর রাষ্ট্রের জ্ঞানসম্পদ ধরলে বিশ্বের বড়মাপের ক্ষতিগুলোর উৎস যে সেখানেই, সে বিষয়ে আমরা কী ভাববো? না কি এসব কিছুই ভাবার দরকার নেই, শুধু পাঠ্যপুস্তক-নির্ভর বিদ্যাকে মাপকাঠি ধরলেই চলবে?

# “ইচ্ছা থাকলেই উপায় হয়” – তাই বুঝি? ধরে নিলাম চেষ্টা থাকতে হবে, একাগ্রতা থাকতে হবে এই উদ্দেশ্যে বলা। কিন্তু এর মাধ্যমে সমাজ-রাষ্ট্র, আর্থসামাজিক অবস্থানের ভূমিকা কি আড়াল হয় না? এমনকি ইচ্ছাটা জাগাতেও যে পরিবেশ-পরিস্থিতি নিয়ামক তা উপেক্ষা করবো আর দোষ দেবো ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে?

# “এক হাতে তালি বাজে না” – ক্ষমতার অপব্যবহার বিচারে আনলে , অবশ্যই বাজে। # “ কপালে নাই কো ঘি, ঠকঠকালে হবে কী?” – ‘ইচ্ছা থাকিলেই উপায় হয়’ এর উল্টো অনেকটা এবং নিয়তিকে দায় করে সামাজিক ভূমিকা আড়ালের প্রয়াস নয় কি? # “কপালের লিখন যায় না খন্ডন” – মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন!

# “ চক চক করিলেই সোনা হয় না” – ভুলে যাবার সম্ভাবনা থাকে যে চকচক না করলেও সোনা হয় না!

-৪-

হাড়ের সাথে পারের সংগ্রাম!

জীবনের অর্ধশতক পার হতে হতেই হাড়গুলো বিদ্রোহী হয়ে উঠছে যেন, দেহের খাঁচা ত্যাগ করতে চায় বুঝি। মিনিট দশেক মেঝেতে বসে কিছু করলে কোমড় ধরে যায়; বুঝতে পারছি রাধাকে কোলে নেবার দিন শেষ! তবে শরীরের যত্ন-আত্তি নিলে, একটু হাল্কা ব্যায়াম করলে ব্যথাগুলো থাকে না; কিন্তু মহা অলস আমি, ‘বেদনা মধুর’ হয়ে যাবার ভ্রান্তিবিলাসে থাকি! জীবন যাপন করতে করতে, মানুষের সাথে আর প্রকৃতির সাথে পথ চলতে চলতে, যখন মনে হলো কিছু অলিগলি চেনা গেলো বুঝি; তখনই হাড়-মাংসের বিদ্রোহ এক প্রহসন বটে! এই বিশ্বপ্রকৃতির অসীমতায় , নিষ্ঠুরতায়, মায়ায়, ভালোবাসায় ‘প্রাণমন লয়ে’ আরও বহুদূর হেঁটে যাবার ইচ্ছেটা অপূর্ণই রয়ে যায়! আবার নশ্বরতার, অপূর্ণতার এই দুর্বলতার কারণেই হয়তো টিকে থাকে জানতে চাইবার, বুঝতে চাইবার, ভালোবাসবার, ভেঙে ফেলবার এবং গড়ে তুলবার অসীম ক্ষুধা! কৃষ্ণের পায়ের তলার মতোই একিলিসের পায়ের গোড়ালি … এই দুর্বলবিন্দু মানুষ চিহ্নিত করেছে , প্রকাশ করেছে কথায় কাব্যে বহুবার! একক মানুষের নশ্বরতার বিপরীতে সমগ্র মানব জাতির জীবনকালকে একক প্রক্রিয়া বা প্রাণ ধরা যেতে পারে, তবে এই প্রক্রিয়াও একসময় থেমে যাবে। তবে, যেভাবে ভাবা যায় মহাবিশ্বও জীবিত, সেভাবে ভাবলে আমরা সবাই বিশ্বাণু , অমর! প্রতিটি জীবন , এমনকি জড়বস্তুও হয়তো তাই! ভাবনার এই স্তরে পৌঁছানোর অবকাশ সকলের হোক, এটিই চাইবার। একা পথ চলার তীব্র নিঠুর আনন্দের সাথে যোগ হোক, সবে মিলে পথ চলার জীবনানন্দ!